ফিলিস্তিন বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল যে সাহসী সুন্দরী


এই লেখাটি লেখার সময় আমার হৃদয় ভার হয়ে আসে। কারণ এটি এমন একজন নারীর গল্প যিনি কেবল একজন রাজনীতিবিদ নন বরং ইতিহাসের পাতায় সাহস, দৃঢ়তা, প্রতিবাদ আর নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। তিনি লায়লা খালেদ। একজন ফিলিস্তিনি নারী যাঁর গল্প জানলে বোঝা যায় একটি জীবন কতটা গভীরভাবে ইতিহাস বদলে দিতে পারে।
লায়লার শৈশব কেটেছে কঠিন বাস্তবতার মধ্যে। তাঁর পরিবার ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত হয়ে চলে আসে। তার শরণার্থী জীবন তাঁকে শিক্ষা দেয় লড়াই কাকে বলে। তিনি বেড়ে উঠেছিলেন ইংল্যান্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এক শ্রমজীবী এলাকায়। সেখানে বেঁচে থাকাটাই ছিল সংগ্রাম। চেহারায় ছিল এক ধরনের কোমলতা। অনেকটা অড্রে হেপবার্নের মতো। কিন্তু এই নরম চেহারার আড়ালে লুকিয়ে ছিল অটল এক ইচ্ছাশক্তি ও আগুনঝরা আত্মবিশ্বাস।
লায়লা ছিলেন সেই মানুষ যিনি ফিলিস্তিনের যন্ত্রণা ও নির্যাতনের কাহিনি বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছিলেন এমন এক সময় যখন মিডিয়া বা সমাজ এই গল্প শুনতে চাইত না। তিনি এমন সব কাজ করে দেখিয়েছেন যা অনেক পুরুষও করতে ভয় পায়। মাত্র ২৫ বছর বয়সে ১৯৬৯ সালে তিনি রোম থেকে তেল আবিবগামী একটি বিমান ছিনতাই করেন। বিশ্বজুড়ে সবাই তখন চমকে উঠেছিল, কে এই নারী?
মাথায় ফিলিস্তিনি কেফায়া, হাতে একে-৪৭ রাইফেল, সেই সময় হয়ে উঠেছিল ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতীক। বিপ্লবী ফ্যাশনে, রাজনৈতিক পোস্টারে, ছাত্র-ছাত্রীদের হ্যাভারস্যাকে, দেয়ালে দেয়ালে উঠে এসেছিল তাঁর মুখ। এই ছবি কেবল বিদ্রোহের নয় তা ছিল অসম লড়াইয়ে সাহসী হয়ে ওঠা একজন নারীর মুখ।
লায়লা শুধু সাহসী নন, ছিলেন বুদ্ধিমান, সংগঠিত এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন। তিনি পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন (PFLP) এর সদস্য ছিলেন। এই সংগঠনটি ফিলিস্তিনিদের জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার অধিকারের পক্ষে সশস্ত্র সংগ্রাম করছিল। সেই সময় বিশ্বজুড়ে চে গুয়েভারা, ভিয়েতনামের হো চি মিন বা আফ্রিকার লুমুম্বার মতো বিপ্লবীদের চেতনায় জাগরণ চলছিল। আর লায়লা ছিলেন এই বৈশ্বিক বিপ্লবী তরঙ্গের এক নারীকণ্ঠ।
১৯৭০ সালে চেহারা বদলে আবারও এক বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনায় যুক্ত হন লায়লা। এইবার তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় লন্ডনে। তবে একটি জিম্মি বিনিময়ের মাধ্যমে তিনি আবারও মুক্তি পান। এই ঘটনাগুলো তিনি ঘটিয়েছিলেন যখন তাঁর বয়স ৩০ বছরেরও কম। এটা ছিল তাঁর আদর্শ ও জাতির অধিকারের জন্য নিঃস্বার্থ আত্মনিবেদনের বহিঃপ্রকাশ।
সেই সময়ে যারা নিজেরা নারী হিসেবে সমাজে কোনো স্বীকৃতি বা কণ্ঠ খুঁজে পেত না, লায়লার মধ্যে তারা দেখেছিল নতুন এক আশা, নতুন এক শক্তি। অনেকে মেয়ের নাম রেখেছিল লায়লা। তাঁর মুখ আঁকা টি-শার্ট হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের প্রতীক। তিনি নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় ঢেউয়ের এক নিরব জোয়ার হয়ে এসেছিলেন এমন এক মুসলিম নারীর চেহারায় যাঁকে সাধারণত শুধু নির্যাতিত বা পেছনে ফেলে আসা কেউ বলে দেখা হতো।
কিন্তু সময় বদলে গেছে। এখন ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে বামপন্থী সংগঠনগুলো দুর্বল হয়ে গেছে, আর জায়গা নিয়েছে ইসলামপন্থী দলগুলো। লায়লার মতো আদর্শবাদী, মানবিক, সেক্যুলার নেতৃত্ব আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। ইতিহাস থেকেও তাঁকে অনেকটাই মুছে ফেলা হয়েছে।
বর্তমানে লায়লা খালেদ ৮০ বছর বয়সে জর্ডানে বাস করছেন। তিনি গুরুতর অসুস্থ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের পর শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন। হয়তো আজকের ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব, আরব বিশ্বের নিস্ক্রিয়তা তাঁকে ভীষণভাবে হতাশ করেছে। তিনি যদি এখনও তরুণ হতেন হয়তো আবার রাইফেল হাতে তুলে নিতেন।
লায়লা খালেদ একজন মানুষ, যাঁর জীবনের গল্প আমাদের শেখায় একজন নারীও ইতিহাস লিখতে পারেন, শাসকদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারেন, এবং নিজের অস্তিত্ব দিয়ে জাতিকে পথ দেখাতে পারেন। তাঁর গল্প কোনো রূপকথা নয়। তার গল্প এক কঠিন বাস্তবতার সাহসী দলিল।
আজকের দিনে লায়লার কথা বলা মানে শুধুই তাঁকে সম্মান জানানো নয় বরং সেই সংগ্রাম, মানবতা ও নারীর ক্ষমতায়নের মূল্যবোধকে স্মরণ করা যেগুলোকে আজকের দুনিয়া বারবার ভুলে যেতে বসেছে।