প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া মানেই কি ইনফেকশন?

‘প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া’ এই শব্দ দুটো আমাদের অনেকের কাছেই পরিচিত ও অস্বস্তিকর এক অভিজ্ঞতা। জীবনের কোনো না কোনো সময়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বেশিরভাগ মানুষই এই সমস্যায় ভোগেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া মানেই কি ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI) বা মূত্রনালির সংক্রমণ?
এই ধারণাটি অনেকাংশেই প্রচলিত এবং কিছুটা সঠিক হলেও সবসময় নয়। প্রকৃতপক্ষে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়ার পেছনে ইনফেকশন ছাড়াও আরও অনেক কারণ থাকতে পারে।

ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI) এর সবচেয়ে সাধারণ কারণ হল মূত্রনালিতে ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক বা প্যারাসাইট ঢুকে গেলে সংক্রমণ হতে পারে। বিশেষ করে নারীরা শারীরিক গঠনের কারণে তুলনামূলক বেশি এই ইনফেকশনে আক্রান্ত হন।
ইনফেকশনের লক্ষণগুলো হল বারবার প্রস্রাব লাগা, কিন্তু অল্প অল্প করে প্রস্রাব হওয়া, প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া বা ব্যথা, তলপেটে ভারী বা চাপ অনুভব, প্রস্রাবে দুর্গন্ধ বা রক্ত দেখা, জ্বর ও পিঠে ব্যথা (যদি কিডনিতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে)
ইনফেকশনের চিকিৎসার জন্য প্রথমেই ইউরিন রুটিন এবং ইউরিন কালচার টেস্ট করে সংক্রমণ নিশ্চিত করতে হয়। এরপর চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করেন। এতে সাধারণত কয়েক দিনের মধ্যেই উপসর্গগুলো ভালো হয়ে যায়। তবে মনে রাখতে হবে নিজে নিজে ওষুধ শুরু করা যাবে না। অনেক সময় সংক্রমণ কোন অ্যান্টিবায়োটিকে সংবেদনশীল (sensitive) তা জানার জন্য ইউরিন কালচারের ফল জানা গুরুত্বপূর্ণ।
চিকিৎসা শেষ হওয়ার অন্তত ৪৮ ঘণ্টা পর আবার টেস্ট করে নিশ্চিত হওয়া দরকার, সংক্রমণ পুরোপুরি সেরে গেছে কি না।
অনেক সময় ইউরিন টেস্টে কোনো ইনফেকশন ধরা পড়ে না, কিন্তু জ্বালাপোড়া বা অস্বস্তি থেকেই যায়। এমনকি কখনো কখনো দীর্ঘদিন ধরেও এ সমস্যা চলতে পারে। চলুন দেখে নিই সংক্রমণ ছাড়াও জ্বালাপোড়ার পেছনে কী কী কারণ থাকতে পারে।
পানি কম খাওয়া বা ডিহাইড্রেশন – গরমকালে আমরা অনেক সময় যথেষ্ট পানি পান করি না। ফলে প্রস্রাব ঘন ও গাঢ় রঙের হয়ে যায়। ফলে ত্বকে ও প্রস্রাবের পথে জ্বালাপোড়া হতে পারে। এটা কোনো ইনফেকশন নয় বরং হাইড্রেশনের অভাবে সাময়িক অস্বস্তি। এর সমাধান পেতে হলে দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন। ফলমূল বা পানি-সমৃদ্ধ খাবার বেশি খান।
দীর্ঘমেয়াদি প্রস্টেটের সমস্যা (পুরুষদের ক্ষেত্রে) – তরুণদের মধ্যে ‘ক্রনিক প্রস্টেটাইটিস’ নামের একটি সমস্যা দেখা যায়। এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ। এ কারণে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, ব্যথা বা ঘন ঘন প্রস্রাবের প্রবণতা থাকে। বয়স্ক পুরুষদের (৫০ বছর বা তার বেশি বয়সে) ক্ষেত্রে প্রোস্টেট গ্রন্থি বড় হয়ে যাওয়ায় প্রস্রাব ঠিকভাবে বের হয় না, মূত্রথলিতে চাপ পড়ে এবং জ্বালাপোড়া হতে পারে।
নারীদের ব্লাডার পেইন সিনড্রোম (Interstitial Cystitis) – এটি একটি জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। এটি সাধারণ ইনফেকশন থেকে একেবারে আলাদা। এতে মেয়েরা প্রায়ই প্রস্রাবে ব্যথা, চাপ বা জ্বালাপোড়া অনুভব করেন। সাধারণ ইউরিন টেস্টে কোনো জীবাণু ধরা পড়ে না ফলে রোগ নির্ণয় করাটাও কঠিন হয়ে পড়ে। এই সমস্যার চিকিৎসায় ধৈর্য ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাহায্য খুব জরুরি।
বিরল জীবাণুর সংক্রমণ – সব জীবাণু সাধারণ পরীক্ষায় ধরা পড়ে না। যেমন কিছু মাইক্রোপ্লাজমা বা ফাঙ্গাল সংক্রমণ থাকলেও ইউরিন রুটিন টেস্ট নেগেটিভ আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিশেষায়িত পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। তাই বারবার সমস্যা হলে অবশ্যই অভিজ্ঞ ইউরোলজিস্ট বা নেফ্রোলজিস্টের পরামর্শ নিতে হবে।
প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যা
ডায়াবেটিস – ডায়াবেটিসে প্রস্রাবে অতিরিক্ত গ্লুকোজ ও জলীয় অংশ চলে আসে, যা ব্যাকটেরিয়ার জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে।
কেমিক্যাল বা প্রসাধনীর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া – অনেক সময় অ্যালার্জি বা কেমিক্যালযুক্ত প্রসাধনীর কারণে প্রস্রাবে অস্বস্তি হতে পারে।
মূত্রনালির পাথর – প্রস্রাবের পথে পাথর থাকলে তা ঘষে গিয়ে জ্বালাপোড়া বা ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে।
প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হলে প্রথমেই কিছু বিষয় খেয়াল করুন।
-পানি খাওয়া ঠিক আছে তো?
-প্রস্রাবের রং গাঢ় বা দুর্গন্ধযুক্ত কি?
-জ্বর, পিঠে ব্যথা বা প্রস্রাবে রক্ত আছে কি?
যদি উপরের উপসর্গ থাকে, তবে দেরি না করে ইউরিন টেস্ট করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

আর যদি নিয়মিত পানি খাওয়া সত্ত্বেও বারবার জ্বালাপোড়া হয় অথবা ইউরিন টেস্ট নরমাল আসে তাহলে বিশেষজ্ঞ ইউরোলজিস্টের পরামর্শ নিন। কারণ তখন এটি ইনফেকশন ছাড়াও অন্য কোনো জটিল কারণ হতে পারে।
প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া একটি অস্বস্তিকর কিন্তু খুব সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা। কিন্তু এটি হালকাভাবে নিলে সমস্যা বাড়তে পারে। সঠিক সময়ে পরীক্ষা, পর্যাপ্ত পানি পান এবং চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা নিলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সমস্যা নিরাময় সম্ভব। তাই জ্বালাপোড়া মানেই ইনফেকশন এই ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে নিজের শরীরের প্রতি সচেতন হোন সুস্থ থাকুন।
চাইলে এই ফিচার আর্টিকেলটি আরও নির্দিষ্ট শ্রেণির পাঠকদের (যেমন কিশোর-কিশোরী, গর্ভবতী নারী, প্রবীণ) জন্য আরও কাস্টমাইজ করেও লিখে দিতে পারি। প্রয়োজন হলে বলো, সঙ্গে সঙ্গেই করে দিচ্ছি!