দ্য নেমব্যাজ!
লন্ডনের এই ওল্ড এজ হোমটা বেশ নামকরা।এখানে কারও সাথে দেখা করতে হলে অনেক নিয়ম কানুনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।আর বহিরাগত হলে তো কথাই নেই।সুতরাং বুঝতেই পারছেন কতটা কাঠখড় পুড়িয়ে আমাকে এখানে আসতে হয়েছে।
ও হ্যা,আমি তো বলতে ভুলেই গিয়েছি যে আমি এখানে একজনের সাথে দেখা করতে এসেছি।তার নাম জে. এন সিদ্দিকী।অবসরপ্রাপ্ত একজন আর্মি পারসন।যুদ্ধ ও সমরাস্ত্র নিয়ে বেশ কটি নামকরা বইয়ের লেখক তিনি।বেশ ক বছর ধরে তাকে খুঁজছি আমি।অবশেষ জানতে পারলাম তিনি এই ওল্ড এজ হোমে প্রায় পাঁচ বছর ধরে আছেন।জগৎ সংসারে কেউ নেই তার।স্ত্রী গত হয়েছেন বছর দশ হয়েছে।একমাত্র ছেলে সেও সুইসাইড করেছে ছয় বছর আগে।কারন হিসেবে জানলাম রোড এক্সিডেন্টে তার পুত্রবধূ ও নাতি মারা যায়।সেই শোক সামলাতে না পেরে ছেলেও আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
এই দুর্বিষহ একাকী জীবনে তিনি যখন স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে গেলেন তখন থেকেই এই ওল্ড হোমে।তিনি তার সমস্ত সম্পত্তি ডোনেট করে দিয়েছেন এই হোম কে।
ওল্ড হোমের নিয়মানুযায়ী কেন আমি তার সাথে দেখা করতে চাই,তিনি তো আমার পরিচিত কেউ নন,আত্মীয়ও নন। তাই নানা জিজ্ঞাসাবাদের ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে আমাকে।ওদিকে তিনি অচেনা কারও সাথে দেখা করবেন না বলে দু একবার ওল্ড হোম থেকে আমাকে ভদ্রভাবে না বলাও হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তিনি যখন জানতে পেরেছেন বিখ্যাত সায়েন্টিস্ট এস.বি মিছিল দেখা করতে চেয়েছেন তিনি হ্যা বলেছেন এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের সাক্ষাতের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে।
আমি এস.বি মিছিল।বিখ্যাত নিউক্লিয়ার সাইন্টিস।যদিও আড়ালে আমাকে সবাই মিসাইল বলে ।সে যাই হোক,ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে ঢুঁ মারলেই আমার সম্পর্কে জানতে পারবেন তাই ওদিকে আর গেলাম না।
গতরাত থেকেই আমি বেশ উৎকণ্ঠায় আছি।আমি ওল্ড এজ হোমে আগেই বলে রেখেছিলাম আমি তার সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে চাই।তারা ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।বড় একটা গাছের নিচে ব্যবস্থা হয়েছে বসার।
মুখোমুখি জে. এন সিদ্দিকী আর আমি।একসময়ের জাঁদরেল আর্মি পারসন আজ পঁচাশি বছর বয়সের একজন প্যারালাইজড বৃদ্ধ ,হুইল চেয়ারে বন্দী।
করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন।কিন্তু কি অদ্ভুতভাবে গতকাল রাতে গ্লাস ভেঙে আমার হাতটা কেটে যাওয়ায় এক বড়সড় ব্যান্ডেজ।করমর্দন আর হলোনা।
জানতে চাইলেন কেন আমি এত উৎসুক তার সাথে দেখা করার জন্য।আমি হেসে বললাম,আপনি বাংলা জানেন আর আমিও উর্দু। চাইলে আমরা যেকোন ভাষায় শুরু করতে পারি কিন্তু সেটা আমাদের নিজ মাতৃভাষাকে অপমান করা হবে তাই চলুন আমরা ইংরেজিতেই শুরু করি।(পাঠকদের সুবিধার্থে তার সাথে কথপোকথন আমি বাংলাতেই দিলাম)
-আপনি কি বাঙালি মি:মিছিল?
-আমি বাংলাদেশি মি: সিদ্দিকী।মাতৃসূত্রে বলতে পারেন।আমার জন্ম লন্ডনে।আমার মা বাংলাদেশ থেকে এখানে পড়তে এসেছিলেন তারপর সেটেল্ড।আমার জন্ম,পড়াশোনা সব এখানেই।আমি লাস্ট নয় বছর ধরে বাংলাদেশে আছি।
আমি বাংলাদেশি বলে মি: সিদ্দিকী একটু বিরক্ত হলেন।বিরক্তি ভাব কাটাতে জিজ্ঞেস করলেন
-ফ্যামিলি?
-হুমম,মা আছেন পঁচাত্তর বছর বয়স,স্ত্রী আর দুই ছেলে।একজন ক্লাস ইলেভেন আরেকজন ক্লাস এইট।
-ফাদার?
-ডেড..
-ওহ সরি।
-সরি হওয়ার কিছু নেই।
-তো কি জন্য এসেছেন আমার কাছে?
-আপনার বইগুলো পড়েছি।অনেক গবেষণালব্ধ বই।ভালো লিখেছেন।
-থ্যাঙ্কস,শুধু কি এজন্য?
-না,বিষয়টা তা না?আপনার বন্ধু রাহাত শাহরিয়ার।মনে আছে?তার কাছে আপনার গল্প শুনেছি।আপনি নাকি সেরকম বড় ফাইটার ছিলেন।একাই বিশাল সৈন্য নিয়ে ফাইট করেছিলেন সেভেন্টি ওয়ানে?
সপ্রতিভ চোখে তাকালেন এক সেনা মানুষ।
-হুমম।মনে আছে।সেভেন্টি ওয়ানের পর তার সাথে আর যোগাযোগ হয়নি।অবশ্য যোগাযোগ হওয়ার মত পরিস্থিতি তো আর ছিলনা।তা কেমন আছে সে?
-তিনি নেই।ইন্তেকাল করেছেন তিন বছর আগে।আমার বন্ধুর বাবা ছিলেন।
-শুধু এটুকু শুনেই দেখা করতে এসেছেন মি: সায়েন্টিস্ট?নাকি আরও অন্য কিছু?আপনারা বাংলাদেশিরা তো পাকিস্তানিদের সহ্য করতে পারেন না।আপনাদের দেশ ফ্রি হওয়ার শুধু শুধু একান্ন বছর পর কেউ একজন এত আয়োজন করে কেন দেখা করতে আসবে?কেন এসেছেন?
আমি হেসে ফেললাম।লম্বা চওড়া ফর্সা টিকালো নাকের পক্ষাঘাতগ্রস্ত মেজর সাহেবের নাক কান লাল হতে শুরু করেছে?
-কিছু জানতে ও জানাতে এসেছি।
-বলুন?আমার সময় খুব কম।
-ওল্ড হোমের কর্তৃপক্ষ জানালেন আপনি আপনার ছেলেকে,নাতিকে খুব মিস করেন।
-সেটা কি অস্বাভাবিক??
-হুমম।এত সম্পত্তি আপনি তাদের লিখে দিয়েছেন।এমনকি বইয়ের রয়ালিটি পর্যন্ত।ছেলে নাতি বেঁচে থাকলে কি সেটা দিতেন?আমাদের সাউথ এশিয়াতে তো বংশধর না থাকলে আক্ষেপের শেষ থাকেনা।
-সেটা কি অস্বাভাবিক?চোখের সামনে নাতি মারা গেল,ছেলেটাও।বংশ শেষ হয়ে গেলো।এটা কি সহ্য করার মত।আপনার প্যারেন্টস লাকি।আপনিও।আপনার দুই ছেলে।লম্বা বংশ আপনার।
-আমি মনে মনে হেসে ফেললাম।এই বুড়ো খাটাশ বংশ ছাড়া কিছুই বোঝেনা।
আমি মি: সিদ্দিকী কে বললাম,আপনার একটা জিনিস আমার কাছে আছে।
-কি সেটা?
-আপনার নেম ব্যাজ ?হারিয়ে ফেলেছিলেন।সেটা ফেরত দিতে এসেছি।
খুব সন্তর্পনে নেম ব্যাজটা কফি টেবিলের উপর রাখলাম।
খুব অবাক হয়ে সিদ্দিক সাহেব তাকালেন।কোথায় পেলেন এটা?ইট ওয়াজ লস্ট!
-হুমম।সেভেন্টি ওয়ানে হারিয়েছিলেন।কিভাবে পেলাম???তারচে আমি বরং একটা গল্প বলি আপনাকে …
মি:জে. এন সিদ্দিক আমার জন্ম এই লন্ডনে সেটা আপনাকে আগেই বলেছি।আমার নানা অনেক প্রতাপশালী ছিলেন।সেসময় মেয়েরা পড়াশোনা সেভাবে করতো না কিন্তু আমার নানাজি আমার মাকে ব্যারিস্টারি পড়ানোর জন্য সব আয়োজন করেছিলেন।তাই আমার মা উচ্চতর পড়াশোনার জন্য সেভেন্টি টু তে এই দেশে আসেন।তখন খুব অদ্ভুতভাবে আমি আমার মায়ের গর্ভে চার মাস।সেটা আমার নানার পরিবারের মাত্র দুজন জানতেন আমার নানা ও নানী।হয়তো মা আরও পরে এদেশে আসতেন কিন্তু প্রেগন্যান্ট হয়ে যাওয়ায় দরুন নানা অনেক চেষ্টা তদবির করে মাকে এই লন্ডনে তড়িঘড়ি করে নিয়ে আসেন।বলা যায় মাকে এখানে ফেলে যান।কেন বলুন তো?
-কেন?
-কারন আমি যুদ্ধ শিশু।
আপনার মনে আছে সেভেন্টি ওয়ানে নভেম্বরের মাঝামাঝি আপনি শরীয়তপুর এর একজন নামকরা নেতার মেয়েকে সাতদিন নিজের কাছে রেখে ফেরত দিয়েছিলেন শুধুমাত্র সেই নেতা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছিলেন বলে।
আপনার হয়তো মনে নেই।কজন মেয়েকে মনে রাখবেন?মাকে আপনি ফেরত দিয়েছিলেন উচ্চ মূল্যে ।তাঁকে মেরে ফেলেননি।এজন্য আপনাকে থ্যাঙ্কস।
মা ফিরে আসার পর আপনার নেম ব্যাজটা তাঁর কাছে থেকে গিয়েছিল …হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা ছিল!…জে. এন সিদ্দিকী!!।হয়তো ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে …..যাই হোক !!
লাস্ট নয় বছর আগেও আমি জানতাম আমার বাবা মারা গেছেন।কিন্তু মায়ের অসুস্থতার সময় পুরনো ডায়েরি আর কাগজপত্র ঘেঁটে সব জানতে পারি।আমার নানা মাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন,জন্মের পর আমাকে অরফ্যানেজ এ দিয়ে দিতে। মা রাজি হননি।বলা যায় পারেন নি।আমি তো না চাইলেও তার গর্ভের সন্তান।যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশ হল কিন্তু মা একাত্তরের যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন।সেই যুদ্ধ মা এখনও করে যাচ্ছেন তার মননে, স্বত্বায়,সন্তানের চেহারায়।খুব ভালো করে দেখুন তো আমার চেহারায় আপনার ছাপ পান কিনা!
এরও অনেক পরে মা আমাকে আপনার নেম ব্যাজটি দেন।তারপর থেকে আমি আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।আপনি পাকিস্তানে থাকলে আপনাকে খুঁজে বের করা কোন ব্যাপার ছিলনা।কিন্তু আপনি তো সেখানে নেই!!আজকে এদেশ তো আগামীকাল আরেকদেশ।
এরপর খোঁজ পেলাম রাহাত শাহরিয়ার আঙ্কেলের।তিনি জানালেন আপনি আমেরিকা বা লন্ডনে কোথাও আছেন।আপনার বইয়ের কথা জানালেন।এরপরের খোঁজ অনেক দীর্ঘ অনেক পরিশ্রমের।
মি:জামশেদ নওশাদ সিদ্দিকী ওরফে জে এন সিদ্দিকী আপনার সাথে যদি আমার পাঁচ বছর আগেও দেখা হত আমি আপনাকে খুন করে ফেলতাম।কিন্তু পাঁচ বছরে এই সিদ্ধান্ত বদল হলো কেন জানেন ?কারন আপনার সকল আশা ভরসা শেষ করে দিয়ে আপনার প্রানপ্রিয় পুত্রটি আত্মহত্যা করেছে।আপনার চোখের সামনে আপনার সাধের বংশ নির্বংশ হয়ে গেছে।আপনার বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই মরে গেছে।আপনি বেঁচে আছেন মরে যাওয়ার জন্য।এখন আপনি পুরোপুরি মরে যাবেন।কারন আপনার সামনেই আপনার বংশের আরেক ধারক আপনার নাজায়েজ পুত্র ঠিক আপনার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে যে আপনাকে একজন জোরপূর্বক শুক্রানুদাতা ছাড়া কিছুই দেখেনা।
আমি হাতের ব্যান্ডেজটি খুলতে খুলতে বললাম,ভদ্রতা ও রেওয়াজ সুলভ আপনার সাথে আমার হ্যান্ডশেক করতে হত।কিন্তু আমি আপনাকে ছুঁতে চাইনি।ওই নোংরা হাত আমি ছোব না বলে হাত কাটার নাটকটুকু করেছি।আমি দেখতে চেয়েছিলাম আপনাকে।জানাতে চেয়েছিলাম একজন পিতা কতটুকু দুর্ভাগা হলে তার সন্তান তার মৃত্যু কামনা করে তার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে।অপেক্ষা করে মৃত্যুর পর কখন বিজয়ল্লাস করবে।
আমি স্বোপার্জিত বিজয় মিছিল ওরফে এস.বি মিছিল সদম্ভে ওল্ড হোম থেকে বেরিয়ে এলাম।পিছনে ফেলে রেখে এলাম পুরোপুরি পরাজিত এক মানুষকে যাকে মৃত্যুও আলিঙ্গন করতে ইদানিং পিছিয়ে যাচ্ছে।
পরিশিষ্টঃ
ছাব্বিশ মার্চের এই দিনটা নায়লা আর আমার দুই ছেলে হাজারটা পতাকা বানিয়ে ঘর সাজাতে থাকে।এবার তারা মহা উৎসাহে লাল সবুজের ঘুড়ি বানিয়েছে।আমাকেও ওড়াতে হবে বলে কিছুক্ষন আগে এলার্ট করে গেছে।ওদের পাগলামিটা উপভোগ করি মা আর আমি।সকালে চা হাতে পত্রিকা নিয়ে মাত্র বসেছি এমন সময় একটা পার্সেল পেলাম।একটা চিঠি।খুব গোটা গোটা বাংলায় লেখা
“আমাকে ক্ষমা করে দিও আমার সন্তান”
নিচে সাইন দেয়া
“জামশেদ নওশাদ সিদ্দিকী”
আর ওল্ড এজ হোমের একটা চিঠি।মি: জে. এন সিদ্দিকী মারা গিয়েছেন।তার অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী এই চিঠিটা বাংলাদেশে আমাকে পাঠানো হয়েছে।
আমি চিঠিটা মায়ের হাতে দিয়ে বললাম যাও মা তোমার নাতীদের সাথে গিয়ে ঘুড়িতে চিঠিটা বেঁধে উড়িয়ে দাও।তোমার যুদ্ধ শেষ হয়েছে।বিজয় পতাকা উড়াও।
আমি বাচ্চাদের আনন্দ উল্লাস ধ্বনির পাশাপাশি মায়ের আনন্দের বাধনহারা আনন্দ উল্লাস দেখছি।আমি আমার প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সের এই জীবনে মাকে কখনো এত আনন্দিত, এত উচ্ছল দেখিনি।
“ওগো মা ,তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে..”