Skip to content

২৬শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ | বুধবার | ১২ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নারী দিবসের ইতিকথা

বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে আলাদা করে নারীদের জন্যই শুধু একটা দিন। ভাবতে অবাক লাগলেও এটাই ঠিক। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে এই দিনটিকে বিশেষ ভাবে পালন করা হয়। তালিকায় রয়েছে ভারতও।

কিন্তু নারী দিবসের ইতিহাস জানেন কি?

বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন অঞ্চলে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা, তাঁদের কাজের প্রশংসা এবং ভালোবাসা প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে মহিলাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাফল্য অর্জনের উৎসব হিসেবেই পালন করা হয়।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ইতিহাস রচনা করেছেন নারী শ্রমিকরা। প্রায় দুইশত বছর আগে শিল্প বিপ্লবের পর নারীরা শ্রমিক হিসেবে কাজে যোগ দিতে শুরু করেন। শ্রমিক হিসেবে নারীরা ছিল ভীষণ অমানবিক আচরণের শিকার। স্বল্পমজুরি দিয়ে তাদের সস্তা শ্রম কেনা হত। এমনকি নির্ধারিত ছিল না তাদের শ্রম ঘণ্টাও। এমন কাজ তাদের দেয়া হতো যা ছিল। সময়সাপেক্ষ। অথচ মজুরি ছিল পুরুষদের তুলনায় অর্ধেক। কিন্তু জীবনধারনের জন্য শ্রম বিক্রি ছাড়া নারীদের আর কোন উপায়ও ছিল না।

সেই সময়ের পরিস্থিতি অনেকটা আজকের বাংলাদেশের সঙ্গে মিলে যায়। গার্মেন্টসে এখন ৩৫ শতাংশ পুরুষ, বাকি সবাই নারী শ্রমিক। আজকের মতো সেদিনও শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি, ছুটি ও কর্মঘন্টার দাবি তুলেছিল। ১৮২০ সালের দিকে আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে বিভিন্ন কারখানায় অমানবিক কাজের পরিবেশ, বেতন বৈষমা এবং নানা নির্যাতনের প্রতিবাদে নারী শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াইয়ে সামিল হয়ে ধর্মঘট আহবান করেন। একই সময়ে আমেরিকায় বর্ণবাদের প্রতিবাদেও শ্রমিকরা প্রতিবাদ গড়ে তোলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৪৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ায় বস্ত্র কারখানার প্রায় ৫০০০ নারী পুরুষ আন্দোলনে অংশ নেয়। দানা বাঁধতে থাকে আন্দোলন।

১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কের সেলাই কারখানায় নারী শ্রমিকরা উপযুক্ত বেতন, উন্নত কর্মপরিবেশ ও ১০ ঘন্টা

কর্মদিবসের প্রতিবাদে আন্দোলনে নামে। এ আন্দোলন দমনে পুলিশ সেদিন হাজার হাজার নারী শ্রমিকদের মিছিলে গুলি চালায়। ধারণা করা হয়, নারী আন্দোলনের ইতিহাসে এটি ছিল প্রথম গুলি চালানোর ঘটনা। গ্রেফতার হন অসংখ্য নারী শ্রমিক। ফলে আন্দোলন আরও জোরদার হয়। এর তিন বছর পর ১৮৬০ সালে সুই কারখানার নারী শ্রমিকরা তাদেরা। নিজস্ব ইউনিয়ন গঠন করেন। একদিকে নারী আন্দোলন যেমন সংগঠিত রূপ নিতে থাকে, অন্যদিকে শ্রমিক আন্দোলনও দানা বাঁধতে থাকে। সে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আসে ১৮৮৬ সালের ১ মে। জন্ম নেয় বিশ্ব শ্রমিক দিবসের ইতিহাস।

অন্যদিকে ১৮৮৮-৮৯ সালে ইংল্যান্ডে ম্যাচ ফ্যাক্টরির নারী শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করে। ম্যাচ ফ্যাক্টরির নারী শ্রমিকদের সাথে যোগ দেয় সিগারেট, বিস্কুট, কম্বল, পার্ট, জ্যাম ও আচার ফ্যাক্টরির শ্রমিকরাও। অর্থাৎ পুরো উনিশ শতক জুড়ে চলতে থাকে নারীশ্রমিকদের আন্দোলন। এসময়কালেই ১৮৮৯ সালে মহামতি ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের উদ্যোগে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলন। এ সম্মেলনে জার্মান কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিন নারী-পুরুষের সমানাধিকারের প্রশ্ন উত্থাপন করে বক্তৃতা দেন। তাঁর এ বক্তব্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নারীদের মধ্যে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরপর ১৯০৭ সালে স্টুটগার্ডে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে ১৫টি দেশের ৫৯ জন প্রতিনিধি অংশ নেন। এই সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একই সালে ‘আন্তর্জাতিক নারী সংস্থা (International women’s Bureau) প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি তার সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই সম্মেলনেই নারীদের ভোটাধিকারের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে।

এরপর ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ আমেরিকার নিউইয়র্কে শ্রমঘণ্টা কমানো, মজুরি বৃদ্ধি ও জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের ভোটাধিকারের দাবিতে প্রায় ১৫,০০০ নারী ও অভিবাসী শ্রমিকদের অংশগ্রহণে মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তাদের স্লোগান ছিল ‘Bread and Roses”, “Bread’ ছিল তাদের অর্থনৈতিক নিশ্চয়তার প্রতীক এবং ‘Roses’ হলো তাদের জীবনমান উন্নয়নের প্রতীক।

এই সমাবেশ বিভিন্ন দেশের সমাজতান্ত্রিক নারী আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছিল। ঐ দিবস স্মরণে ‘সোসালিস্ট পার্টি অব আমেরিকা ১৯০৯ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি আমেরিকাব্যাপী ‘জাতীয় নারী দিবস’ পালনের ঘোষণা দিয়েছিল। একই বছরের নভেম্বর মাসে ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট কারখানায় শ্রমিকরা ধর্মঘট শুরু করেন। ধর্মঘটরত শ্রমিকদের ৮০ শতাংশই ছিলো নারী। তাদের এ ধর্মঘট ১৯১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলতে থাকে। সেবছরের ‘মে দিবসে’ ৬০ হাজার শ্রমিক প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। সবদিক থেকেই এ আন্দোলনের প্রভাব ছিল প্রচুর। একদিকে শ্রমিক আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ যেমন বৃদ্ধি পেয়েছিল, অনাদিকে নারী-পুরুষের ভোটাধিকারের দাবিও জোরালো হয়ে উঠেছিল।

এই উত্তাল পরিস্থিতিতে ১৯১০ সালের আগস্ট মাসে কোপেনহেগেনে সমাজতন্ত্রীদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে সমাজতন্ত্রী নেত্রী ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ পালনের প্রস্তাব দেন।

ওই বছরই কোপেনহেগেনে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারীদের দ্বিতীয় সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে নিউইয়র্কের নারী শ্রমিকদের আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিয়ে ক্লারা জেটকিন প্রতিবছর ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ পালনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। মহামতি লেনিনের সমর্থনে অপরাপর সদস্যবৃন্দ সেই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন। সম্মেলনে ঠিক হয় মার্চ মাসের যেকোন দিন এই দিবসটি পালন করা হবে। পরের বছর অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড এবং জার্মানিতে প্রথমবারের মতো নারী দিবস পালিত হয়। ১৯১৩ ও ‘১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিবাদ হিসেবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়।

১৯১০ থেকে ১৯১৩ পর্যন্ত মার্চের যেকোন দিন বিভিন্ন দেশে নারী দিবস পালন করা হত। কিন্তু, ১৯১৪ থেকে সুনির্দিষ্টভাবে ৮
মার্চ নারী দিবস পালিত হতে থাকে। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালকে জাতিসংঘ ‘নারী বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে। তখন থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে ৮ মার্চ কে ‘আন্তজার্তিক নারী দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

কেমন আছেন এদেশের নারী

এ তো গেল নারী দিবসের ইতিহাস। কিন্তু আসল প্রশ্ন প্রয়োজনীয়তার এবং সমানাধিকারটা ঠিক কী সেটা। প্রশ্ন আরও একটা। নারী এবং পুরুষ কি কোথাও আলাদা নয়? সব ক্ষেত্রে এক হওয়ার লড়াইটা কি খুব দরকার। না, নারী এবং পুরুষ এক নন। পার্থক্য আছে। একটি বিরাট পার্থক্য আছে। ইস্ট্রোজেন এবং টেস্টোস্টেরন’। এবং এই দুই হরমোনের দৌলতে অনেক কিছুই আলাদা। তা হলে লড়াইটা কীসের? লড়াই প্রকৃতি প্রদত্ত পার্থক্যের নয়, লড়াই মানুষের তৈরি ভেদাভেদ নিয়ে।

বাসে ট্রেনে রিজার্ভড সিটের লড়াই নয়, লড়াইটা বাড়ি থেকে শিক্ষাক্ষেত্র, কর্মক্ষেত্র থেকে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে নারীর যোগ্যতা অনুযায়ী সম-অধিকার পাওয়ার। উদ্দেশ্য এইটা নয় যে আমার বেতন আমার পুরুষ সহকর্মীর সমান হবে না কেন? উদ্দেশ্য এইটা আমার বেতন আমার যোগ্যতা অনুযায়ী হোক। আমি ছেলে না মেয়ে সেই নিরিখে মাপা নয়। বাবা, মা, পরিবারের বড়দের একটি মেয়ের ভালো মন্দ ভাববার অধিকার অবশ্যই আছে, কিন্তু সেই ভাবনার মাপকাঠি তার জেন্ডার হলে। সমস্যার।

পৃথিবীর সব ক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা সত্ত্বেও, মেয়েরা ভালো গাড়ি চালাতে পারে না বা মেয়েদের মন বোঝা খুব শক্ত, লড়কি হাসি তো ফাঁসি কিংবা মেয়েদের মতো কাঁদিস না। সমস্যা এই মানসিকতাগুলো নিয়ে। আরে বাবা, গাড়ি চালাতে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, তাতে জেন্ডারের সমস্যা কোথায়? মন বোঝা শক্ত বুঝলাম কিন্তু মনটাকে তার মতো করে বুঝতে চেষ্টা করা হয় কি? না নিজের মতো করে? আর হাসলেই কেল্লাফতে? কারও বোকামি দেখেও যদি হাসি, তার মানে ফাঁসি? আর কান্না? মন খারাপটাকে কেবল আমি খুব শক্ত এইটা প্রমাণ করতে চেপে রাখার কি খুব দরকার? তা এতে মেয়ে বা ছেলের পার্থক্যটা এল কোথায়?

হ্যাঁ, এটা ঠিক ফেমিনিজমের আড়ালে, ক্ষেত্র বিশেষে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার চেষ্টা অনেকেই করেন। কিন্তু তাতে তো সবার মানসিকতার প্রকাশ পায় না? একদিন নারী দিবস পালন করে কিছুই পরিস্থিতি বদলানো যায় না। বরং তাদের জন্য উদ্যাপন করা যায় যাঁদের হাত ধরে ঘটেছে পরিবর্তন। যাঁদের দৌলতে শুরু হয়েছে সমান অধিকারের লড়াই। যদি সমান হয়েই থাকি তবে একটি বিশেষ দিন কেন? প্রতিটা দিনই নারী দিবস, প্রতিটা দিনই পুরুষ দিবস। বিচার হোক যোগ্যতায়।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ