Skip to content

ছায়া

লশটা দেখে যে যার মতো মন্তব্য করে যাচ্ছে। যেন কতো কিছু জানে। অসহ্য! আহা উহু করে সবাই অপমৃত্যু বলছে।

কিন্তু কিভাবে? এদিকে আত্মীয় স্বজনেরা কাটা-ছেঁড়া চাইছে না। মানে পোস্টমর্টেম না করার ব্যাপারে সবাই সহমত। সাবিনা বেগম মানে আমার মা আহাজারি করে বলছে, আমার মেয়েই যখন বেঁচে নেই, এই কাটা ছেঁড়ার কি দরকার। ওকে একটু শান্তিতে ঘুমাতে দিন আপনারা।

কি আজব। আমি কখন ঘুমাতে চাইলাম।

সারাদিন সংসারের সব কাজ সেরে যখন খেতে বসেছি, ঠিক তখন পেছন থেকে কে যেন আমায় জড়িয়ে ধরলো। আমি ভেবেছিলাম রাতুল অফিস থেকে হঠাৎই এসে আমাকে সারপ্রাইজ দিতে ফিরে এসেছে। যাই হোক রাতুলের কথা বলতেই আমার আবার পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ে গেলো।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পাগলের মতো ভালোবাসতাম দুজন দুজনকে। সবাই দেখে বলতো মানিকজোড়। দুই পরিবারের নিমরাজীতে বিয়ে হলেও আমাদের সুখের কোন কমতি ছিলো না। কোল জুড়ে রাজ্য এলো। শাশুড়ী মার মুখে যেন মধু ফিরে এলো। আর যখন তখন খোঁটা দেয় না। বংশের প্রদীপ বলে কথা। আমি সেই খুশিতে সংসারে আরও মনোযোগী হলাম। দুবছরের মাথায় রাইমা এলো।

আমি আমার সংসার দুই বাচ্চা, শ্বশুড়বাড়ি সামলাতে ব্যস্ত।

রাতুল মাঝে মাঝেই অভিযোগ করতো, আমি ওর দিকে একদম নজর দিইনা। কিন্তু’ তাঁর দাবিদাওয়া পূরণ করতে আমার কোনদিন ক্লান্তি ছিলো না। বড্ড ভালোবাসি যে ওকে।
আচ্ছা, এতো মানুষ কেন? দূরে দাঁড়িয়ে যে কাঁদছে তাকে আমার খুব চেনা লাগছে। আহারে নিশ্চয়ই আমাকে অনেক ভালোবাসতো।

ওওওওহহ যা বলছিলাম। হঠাৎই রাতুলের প্রমোশন, কাজের চাপ বেড়ে গেলো। মাইনেও বেড়ে গেলো। কি’ আমার কোন বাড়তি চাহিদা ছিলো না। শুধু রাতুলের ভালোবাসা ছাড়া। রাতুল বুঝতো সারাদিন কাজ সেরে আমি শুধু ওর জন্যই অপেক্ষা করি। তবুও দিন দিন ইগনোর বেড়ে যাওয়ায়

আমি প্রথমে অভিমান। পরে অভিমান উবে গিয়ে ছোট খাটো কথা কাটাকাটিও হতো। মাঝরাতে হঠাৎই হাসির শব্দে ঘুম ভেঙে দেখতাম রাতুল ব্যালকনিতে ইজি চেয়ারে পা দুলিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্পে মশগুল ল্যাপটপ নিয়ে।

জানতে চাইলে বলতো তুমি চিনবে না। মানুষের সাথে খাতির না রাখলে কি প্রমোশন হয়? টাকা তো আর এমনি এমনি আসে না। আমি সরল স্বভাবের মেয়ে। খুব বেশি জটিলতা ভালো লাগে

না।

আবার কিছুটা আন্দাজ করলেও অশান্তিও চাইনি। তাই মনে মনে কিঞ্চিৎ সন্দেহ থাকলেও তা কখনও প্রকাশ করে অশান্তি বাড়াতাম না। শুধু মনে হতো তবুও প্রিয় মানুষটা, ভালোবাসার মানুষটা, আমার বা”চাদের বাবা একটু শান্তিতে থাকুক।

আ”ছা, এতো ঘুম

পা”ছে কেন?

এই মেয়েটাকে এতো চেনা লাগছে কেন? নাহহহ ওতো আমাদের কোন আত্মীয় নয়। তাহলে এখানে কি করছে?

কত্তো বড় সাহস আমার বা”চাদের জড়িয়ে ধরে মরা কান্না কাঁদছে। কোথায় দেখেছি, কোথায়?

এই তো মনে

পড়েছে। এই মেয়েটার সাথেই তো রাতুলকে আমি হাতে নাতে ধরেছিলাম সিলেট ট্রিপে। সেবার বা”চাদের বায়না মেটাতে আমার স্বামী বাধ্য হয়ে আমাদের নিয়ে গিয়েছিলো।

অফিসের কাজে ভীষণ ব্যাস্ততা দেখিয়ে আমাদের সময় দিতে পারবে না, সাফ জানিয়ে দিয়েছিলো।

তবে একটা গাড়ি সর্বক্ষণের জন্য আমাদের দিয়ে রেখেছিলো যেন ঘুরতে যেতে পারি।

প্রথম দিকে আমার মন সায় না দিলেও বা”চাদের সুখের জন্য ওদের নিয়ে বেড়াতে বেড়িয়েছিলাম, জাফলং। ফিরতে রাত হয়নি। রাতুল সাথে না থাকায় মন খারাপ করে ফিরে এসে জানতে পারি, আমার হাসবেন্ড অফিসের সবাইকে নিয়ে বিশেষ মিটিং এ ব্যস্ত। আমি যেন ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব না করি।

বা”চাদের খাইয়ে দিয়ে একাই সুইমিংপুলের পাশে বসে ছিলাম। হঠাৎ পাশের একটা কটেজ থেকে হাসির শব্দে খটকা লাগলো। দরজায় নক করতেই রাতুল আর তার সেটারী মেয়েটিকে যে অব’তায় পেলাম, তাতে আমার ভীমড়ি খাবার জোগাড়। আমি শাউট করতেই মেয়েটি পায়ে ধরে ম্যাডাম ম্যাডাম করতে লাগলো।

মেয়েটিকে ইশারায় চলে যেতে বলেই আমি রাতুলের কলার চেপে ধরে চার্জ করতেই রাতুলের সে কি কান্না। কতোভাবে যে মাফ চাইছিলো, আর বলছিলো তুমি আমার বা”চাদের মা। তুমি আমাকে ফেলে, সংসার ফেলে যেওনা প্লিজ। আমাকে এবারের মতো মাফ করে দাও। নাহলে যে আমি সমাজে মুখ দেখাতে পারবো না।

কি বোকা আমি। এর পরেও দিনের পর দিন কতো মেয়ের সাথে, এই মেয়েটার সাথেও রাত জেগে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতে দেখেছি আমি ভিডিও কলে।
আহারে আমার বা”চারা বুঝতেও পারছে না তার মায়ের চরম শত্রার কোলে মাথা রেখে তারা আহাজারি করছে।

মেয়েটার সাথে বা”চারা আমার কাছে এলো। কি’ নাহহহহ। যে আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছিলো এই মেয়েটার গায়ের গন্ধ তো মিলছে না। তাহলে কে রাতুল? ফ্যানে ঝোলানোর সময় রাতুলের মতো অবয়ব দেখেছিলাম, কি’ আমার এখনো বিশ্বাস হয় না।

কি’ রাতুলকে তো আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না।

ধিরে ধিরে ভীড় বেড়েই চলেছে। সবাই সিদ্ধান্ত নিলো খুব দ্রুত দাফনকাজ শেষ করতে হবে।

আমার ভীষণ শীত লাগছে। মাকে জড়িয়ে ছোট বেলার মতো মুখ গুজে খুব কাঁদতে ই”ছে করছে।

কতো দিন মায়ের হাতের ছোট মাছের চ”চড়ি দিয়ে ভাত খাই না। আমি তো কতো সহ্য করেছি।

তবুও মরতে চাইনি। আজ সবাই আমাকে মাটি চাপা দিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। ফুল, পাখি, প্রজাপতি, বৃষ্টি, সবুজ পৃথিবীটাকে অন্যের ই”ছায় বিদায় জানাতে হ”ছে।

আহারে আমার বোনটা। কি যে কাঁদছে। ই”ছে করছে ওকে আদর করে দিয়ে বলি ধুর পাগলি, এই তো আমি।

আমার নিজের বোন না থাকায়, আমার এই মামাতো বোনটাই

আপনের চেয়েও আদরের ছিলো।

ভীষণ ক্যারিয়ারিস্ট। মামার অব’ ভালো না থাকায়ও জোর জুলুম করে জমি বিকি করিয়েও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই উঠেছিলো আমার বাসায়।

আমাকে আর রাতুলকে কফি বানিয়ে খাওয়াতো। একসাথে

শপিংয়ে যেতাম। প্রায় প্রায় রাতুল অফিস যাওয়ার আগেই রেডি হয়ে রাতুলের কাছে লিফট চাইতো। আমি হাসতাম। আর কদিন পরে তো হোস্টেলে চলে যাবে। আহারে আমার বোনটা কি যে কাঁদছে। আলুথালু হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রলাপ বকছে।

আমি এতোক্ষণে বুঝে গিয়েছি আমি মৃত। এই সুন্দর পৃথিবীর আলো, রঙ রূপ আমার জন্য নয়।

কি’ আমি তো মরতে চাইনি। আমি তো মন দিয়ে শুধু আমার স্বামী সন্তানকে নিয়েই সুখী থাকতে চেয়েছিলাম। বা”চাদুটোকে নিয়ে কতো স্বপ্ন ছিলো আমার? কারও ক্ষতিও করিনি, তাহলে কেন আমার সাথে এমন হলো?

আমার শক্তি ফুরিয়ে আসছে। তলিয়ে যা’ছি। চোখ বুজে আসছে। হে পরম করুণাময়, আমি তোমার কাছে আরও কিছুক্ষণ সময় ভিক্ষা চাইছি। প্রিয় মানুষগুলোকে প্রাণ ভরে শেষ বারের মতো অনুভব করার জন্য।

কে? কে আমার বুকের উপর মাথা রেখে এভাবে আহাজারি করছে? মুখ দেখতে পারছি না, কি’ গায়ের গন্ধটা আমার কাছে এক্কেবারে স্ফটিকের মতো পরিষ্কার। উফফফ এই মুহুর্তে কেন চোখ বুজে আসছে, তলিয়ে যা”ছি। কি’ আরেকটু, আরেকটুক্ষণ আমায় শক্তি দাও খোদা।

আরে এই গায়ের গন্ধ তো আমার মামাতো বোন ইরার। কদিন আগেই আমার জন্মদিনে জার্মানির পারফিউম আর একটা ডায়মন্ড রিং রাতুল আমায় গিফট করেছিলো। ইরা বলছিলো দুলাভাই তো তোকে কত্তোকিছু দেয়, আমার কপাল তো পোড়া কপাল। শুনে সাথে সাথে আমি পারফিউমটা ওকে দিয়েছিলাম। আর পাশ থেকে একথা শুনে রাতুল পরের দিন একটা ডায়মন্ড নাকফুল ইরার জন্য এনেছিলো। আমার যে কি শান্তি লেগেছিলো। জন্ম থেকে অভাব থাকলেও আমিই পুষিয়ে দিয়েছি ওর সব আবদার।

শেষ পর্যন্ত তুইইইই আমার অস্তিত্ব বিলীন করে দিলি ইরা? যাকে আমি ছোট্টবেলা থেকে সন্তানেরমতো আগলে রেখেছিলাম। আর রাতুল সে তো অনেক আগেই টেকেন ফর গ্রান্টটেইড করে রেখেছিলো আমায়। বা”চাদের মুখ চেয়ে অভিমান বুকে নিয়ে সংসার করে গেছি। কাউকে বুঝতে দেইনি। এ সমাজে অসংখ্য মেয়েই তো অসংগতি নিয়ে মুখ বুঝে সংসার করে যায়। খুব কাছের বাবা মা ভাই বোন বুঝেও না বোঝার ভান করে। প্রতিকার তো দূরের কথা, প্রতিবাদ করতেও কেউ এগিয়ে আসে না। আর সহ্য করতে করতে আজ আমার এই পরিনতি।

তাই কাকে বলবো? কেউ তো আর আমার কথা শুনতে পারবে না। আর শুনলেই বা কি এসে যায়।

আহা উহু করা ছাড়া।

এতোক্ষণ পর রাতুলকে দেখলাম। আহহহা আমার ক্সকশরের ভালোবাসা, প্রেম। এতো নিগৃহিত হওয়ার পরেও আমি রাতুলকে অসম্ভব ভালোবাসি, ঠিক প্রথম দিনের মতো। তাই সব জেনেও মেনে নিয়েছিলাম।

কি’ ওর পাশে পুলিশ কেন?

মনে পড়েছে, পেছন থেকে কি যেন একটা পেচিয়ে ধরে আমাকে মারার সময় আমি ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে পেছনের মানুষটির গলার চেইন আমার হাতের মুঠোয় পুরেছিলাম। তারপর দুজন আমাকে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দিয়েছিলো।

মিস ইরা, উঠে আসুন, ইউ আর অলসো আন্ডার এরেস্ট। তার মানে আমার বা’চারা সুবিচার পেলো!! আল্লাহর বিচার এখনো উঠে যাইনি তাহলে।

আহারে সোনা বা”চারা মাকে ছেড়ে কিভাবে থাকবি এতোবড় ভন্ড দুনিয়ায়?

মায়েদের ঋণ কি শোধ করা যায়? আমার মা পাখি ঠিকই আগলে রাখবে আমার সোনা পাখিদের।

আমার চোখ বুজে আসছে, শরীর অসার হয়ে আসছে। আমি যা”ছি আমার বাবার কাছে। বাবার পাশেই আমার কবর নির্ধারণ করা হয়েছে। বাবার সাথে কতো গল্প জমা আছে।

হোকনা বাঁশঝাড়, হোক কীটপতঙ্গ। পৃথিবীর আর কেউ না হোক একজন বাবা তার মেয়েকে পরম মমতায় আগলে রাখবে, ঠিক যেমন দুনিয়ায় ঝড় ঝঞ্জায় মা পাখি আগলে রাখবে আমার সন্তানদের।

আর প্রকৃতির নিষ্ঠুর আইন আগলে রাখবে দুই দন্ডপ্রাপ্ত আসামীকে।

প্রকৃতির হিসেব যে বড্ড বেমানান……

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ