চারিদিকে শুধু ধর্ষণ, নারী নিরাপত্তা তাহলে কোথায়!
কিসে নিরাপত্তার কথা বলছি আমি? নিরাপত্তা কেন চাইতে হবে আলাদা করে? এত নিরাপত্তাহীনতা কেন থাকবে? নিরাপত্তার কথা উঠলেই বা কেন?
চারিদিকে এখন কিসের সব কথা শোনা যাচ্ছে। চারিদিকে এখন ভয়ের কথা শোনা যাচ্ছে। সেই ভয়টা হলো ধর্ষণের। দিন হোক বা রাত বাহির শব্দটাই এখন নারীর জন্য আতঙ্ক। এই আতঙ্কের শেষ আসলে কোথায় সেটা কারোই জানা নেই তবে সমস্যার সমাধানও দেখা যাচ্ছে না। চারপাশে শুধু ধর্ষণ আর ধর্ষণ। প্রশাসন নীরব হয়ে গিয়েছে। অপরাধীরা নির্বিচারে ঘুরছে। আর এ কারণেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে নারীরা। নারীরা কোথায় নিরাপদ? ঘরে বাহিরে সব জায়গায় নারীর উপর বর্তমানে চলছে অমানবিক নির্যাতন।

সাম্প্রতিক সময়ে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান ঘেটে দেখলে দেখা যায় গত কিছুদিনে ধর্ষণের পরিমাণ অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে অন্তত ৫৭৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এছাড়া, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আরও ৫০৭ জন নারী।
২০১৯ সালে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১,৪১৩ জন নারী ও শিশু, যা আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া, ২০২০ সালে ১,৬২৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ৩১৭ জন গণধর্ষণের শিকার এবং ৫৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে।
গত পাঁচ বছরে (২০১৮-২০২৩) দেশে ধর্ষণের মামলা দায়ের হয়েছে ২৭,৪৭৯টি। এছাড়া, ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসেই নির্যাতনের ফলে ৪৯ জন নারী মারা গেছেন এবং ৪১ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশে প্রতি ৯ ঘণ্টায় অন্তত ১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২,৮৬২ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে যা প্রতি পাঁচজন ভুক্তভোগীর মধ্যে তিনজন শিশু।
২০২৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী একটি চলন্ত বাসে ডাকাতি ও নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটে। নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার থানার মোড় থেকে বাসটি জব্দ করা হয় এবং ডাকাতিতে জড়িত সন্দেহে বাসটির চালক, সুপারভাইজার ও হেলপারকে আটক করে পুলিশ। যাত্রীরা জানান, ডাকাতরা বাসের ৫০ জন যাত্রীর কাছ থেকে নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ও মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যায় এবং দুই নারী যাত্রীকে ধর্ষণ করে। তবে টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান যে, ডাকাতি ও নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটলেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি।
বর্তমান সময়ে প্রতিদিনই পত্রিকার হেডলাইনে ধর্ষণের খবর থাকে৷ একজন মাদ্রাসাছাত্রী একুশে ফেব্রুয়ারি ফুল কিনতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হন। অন্যদিকে নিজ গৃহে গৃহবধূও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এমন খবরও পত্রিকায় দেখা যায়। নারীরা কোথায় নিরাপদ? ঘরে নাকি বাহিরে?
এই পরিসংখ্যান ও ঘটনাগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে, বাংলাদেশে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং এই ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলের মাধ্যমে দুস্থ, অসহায় ও নির্যাতিত মহিলাদের বিনা খরচে আইনগত পরামর্শ প্রদান, কাউন্সেলিং এবং মামলা পরিচালনা করে আসছে। এছাড়া, ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার এবং ডিএনএ ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে নির্যাতিত নারীদের সহায়তা প্রদানের জন্য।
তবে শুধুমাত্র সরকারি উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। সমাজের সকল স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধি, শিক্ষা, এবং নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় সকলকে সচেষ্ট হতে হবে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কার্যকারিতা বৃদ্ধি, দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি, ভুক্তভোগীদের মানসিক ও শারীরিক সহায়তা প্রদানে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
সমাজে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্য দূর করে সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই কেবল আমরা একটি নিরাপদ ও সম্মানজনক পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারব, যেখানে নারী ও পুরুষ সমানভাবে শান্তি ও মর্যাদার সাথে বসবাস করতে পারবেন।