Skip to content

২৬শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ | বুধবার | ১২ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আঁধারে বায়ান্নর নারীরা

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে নারীর অবদান কম নয়। ভাষা আন্দোলনে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নারীর অনবদ্য ভূমিকা ছিল। মিছিল, মিটিং থেকে শুরু করে প্রায় সব রাজনৈতিক কর্মকান্ডে নারীরা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে। অথচ স্বাধীনতার বায়ান্ন বছর অতিক্রান্তেও মেয়েদের দৃশ্যমান ভুমিকাগুলোকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ সম্মানের বদলে অবহেলা করা হয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সেই সংগ্রাম মুখর দিনগুলোতে নারী সমাজের সক্রিয়ভাবে আরো যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন-বেগম সুফিয়া কামাল, সানজিদা খাতুন, সৈয়দা লুৎফুন্নেসা খাতুন, রাণী ভট্টাচার্য, নুর জাহান বেগম, মাহমুদা খাতুন, বেগম জাহানারা মতিন, সারা তৈফুর, সোফিয়া খাতুন, জোবেদা খাতুন, রাবেয়া খাতুন, মিসেস কাজী মোতাহার হোসেন, সৈয়দা শাহরে বানু চৌধুরীসহ আরো অনেক নাম না জানা নারী। প্রত্যেকের অবদানই আজকের রাষ্ট্রভাষা বাংলা অর্জনের পথ সুগম করেছে। বায়ান্ন আমাদের জাতীয় ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আমরা অর্জন করেছি স্বাধীনতা।

পুরুষদের সহযোদ্ধা হয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবি নিয়ে নারীরা সব মিছিলেই থেকেছে সামনে। সব ধরনের মিটিং-মিছিল, সভা-সমাবেশে নারীরা অংশ নিয়েছে। আন্দোলনের পোস্টার, ব্যানার, কার্টুন লেখায় নারীদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ভাষাপ্রশ্নে নারীদের তৎপরতা সারাদেশে শুরু থেকেই ছিল। তবে ইতিহাসের বইয়ে তা কোনো অদ্ভুত কারণে ঠাঁই পায়নি। যেন নারীরা রাজনৈতিক অঙ্গনে নেতৃত্বের জায়গায় ছিলেন না প্রতীয়মান হয়। তবে কিছু কিছু ইতিহাস গ্রন্থে কিংবা সংবাদপত্রের সুত্র ধরে জানা যায়, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৮ সালে সিলেটের নারীরা তৎকালীন মন্ত্রী আবদুর রব নিশতারের মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেন। নারীদের এই প্রতিনিধিদলে ছিলেন জোবেদা খাতুন চৌধুরী, শাহেরা বানু, লুৎফুন্নেসা খাতুন, নজিবুন্নেসা খাতুনসহ স্থানীয় অনেক নারী। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল অনন্য। সেখানে নারীরাও ছিলেন। উজ্জ্বল করেছেন আন্দোলনের মঞ্চ। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিম উদ্দিন পল্টন ময়দানে জিন্নাহ্র সুরে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। ২৯ জানুয়ারি থেকে এ বক্তৃতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ শুরু হয়। ৩১ জানুয়ারি আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে ৪০ জন প্রতিনিধি নিয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটিতে নারীদের মধ্যে নাদেরা চৌধুরী, লিলি খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সংগ্রাম কমিটির লিফলেট বিলি, নারী জমায়েত, প্রণোদনা দান প্রভৃতি কাজে নিয়োজিত হন কামরুন্নাহার লাইলী, হামিদা খাতুন, নূরজাহান মুরশিদ, আফসারী খানম, নিবেদিতা নাগ, রানু মুখার্জি, প্রতিভা মুৎসুদি, রওশন হক প্রমুখ নেতা-কর্মী।

৮ ফেব্রুয়ারি এক সভার মাধ্যমে ২১ ফেব্রুয়ারি সারা পূর্ববাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। ধর্মঘট উপলক্ষে নাদেরা বেগম ও সাফিয়া খাতুনকে পরিষদ পোস্টার লেখার দায়িত্ব দেয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এর প্রস্তুতি নেয়া হয় আগের দিন। অর্থাৎ ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কর্মসূচি নির্ধারণের জন্য ৯৪, নবাবপুর রোডের আওয়ামী লীগ অফিসে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সংগ্রাম কমিটির জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বেগম আনোয়ারা খাতুন এমএলএ নারীদের প্রতিনিধি হিসেবে এ সভায় অংশ নেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ভোরে গাজীউল হক, মহম্মদ সুলতান, এসএ বারী দুজন-দুজন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হওয়ার নির্দেশ দিয়ে চিঠি পাঠাতে শুরু করে। সকাল ৯টার মধ্যে বিপুলসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীর সমাবেশ ঘটে আমতলায়। সাফিয়া খাতুন, শামসুন্নাহার আহসান, নাদেরা বেগম, সোফিয়া খান ছাত্রীদের সংগঠিত করেন। মেয়েদের বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে বিভিন্ন স্কুলে পাঠান। মেয়েরা হেঁটে বাংলাবাজার গার্লস স্কুল ও কামরুন্নেসা স্কুলে গিয়ে আমতলার সভায় যোগ দেয়ার জন্য ছাত্রীদের সংগঠিত করেন। নারী নেতৃবৃন্দের তৎপরতার কারণে ২১ ফেব্রুয়ারির সমাবেশে বিপুলসংখ্যক মেয়ে উপস্থিত হতে পেরেছিল। আমতলার সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার প্রক্রিয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। সমাবেশ শেষে ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী ছাত্রদের দুই-তিনটি দল বেরিয়ে যাওয়ার পরই ছাত্রীদের দল বেরিয়ে পড়ে। সেদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সাফিয়া খাতুন, সুফিয়া আহমেদ, রওশন আরা বাচ্চু ও শামসুন্নাহার আহসানের নেতৃত্বে কয়েকটি দল রাস্তায় নামে। নারীদের প্রথম দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন সাফিয়া খাতুন। এসব দলে ছিলেন সারা তৈফুর, সোফিয়া করিম, সুফিয়া আহমেদ, হালিমা খাতুন, চেমনআরা, মনোয়ারা ইসলাম, আমেনা আহমেদ, জুলেখা, নুরী, সুরাইয়া প্রমুখ। ছেলেদের একটি দল বের হওয়ার সাথে সাথে পুলিশ তাদের গেট থেকে ট্রাকে তুলে নিচ্ছিল। ছেলেদের পক্ষে ব্যারিকেড ভাঙা এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ব্যারিকেড ভাঙার কাজটি শেষে করেন ছাত্রীরাই। সেদিন পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেলে অনেক ছাত্রী আহত হন। আমতলা থেকে মেডিক্যাল কলেজের গেট পর্যন্ত যেতে রওশন আরা বাচ্চু পুলিশের লাঠির আঘাতে এবং সুফিয়া ইব্রাহিম, সারা তৈফুরসহ ৮ জন মেয়ে পুলিশ কর্তৃক ছোড়া ইটের আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন। অনেক মেয়েকে গ্রেফতার করে পুলিশভ্যানে নিয়ে যাওয়া হয়। একপর্যায়ে পুলিশ নির্বিচারে ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। তারপর বায়ান্নর ট্র্যাজেডি। ইতিহাসের পাতায় এই ঘটনা ঠাই পেলেও নারীদের এই ফাল্গুনে উপস্থিত রাখা হয়নি। নারীরা রয়ে গেছে আঁধারেই। বায়ান্নর ইতিহাসে নারীর ভূমিকার ইতিহাস নানা সূত্র থেকে পাওয়া যায়। আমাদের এবার নতুন করে ধারাবাহিক ইতিহাস লেখার বিষয়ে ভাবতে হবে। নারীর সাহসী ভূমিকার ইতিহাস উল্লেখ করা জরুরি। ইতিহাসে নারীর ভূমিকার স্বীকৃতিও নারীর ক্ষমতায়নের বড় পদক্ষেপ।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ