সৌন্দর্যবর্ধক প্রসাধনী নাকি বর্ণবাদের প্রোমোশন!
টিভি খুললেই বিভিন্ন ধরণের প্রসাধনীর বিজ্ঞাপন চোখের সামনে চলে আসবেই। তার উপর আবার সোশ্যাল মিডিয়ার দৌরাত্ম্যে বিজ্ঞাপনগুলো যেনো আরো সহজেই ঘরের দরজায় পৌঁছে যাচ্ছে। তার মধ্যে সৌন্দর্যবর্ধক প্রসাধনীর চাহিদা একটু বেশিই বটে। কারণ আমাদের গায়ের রং দিয়ে সৌন্দর্যের পরিমাপ করা হয়। তাইতো মানুষ উঠেপড়ে লাগেন কিভাবে নিজেকে আরো সুন্দর করা যায় সেই প্রতিযোগিতায়। এ কাজে সাধারণ জনগণকে সাহায্য করে টিভি, পত্রিকা, ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পোর্টাল,ওয়েবসাইট।
এবার আরেকটি দিকে নজর দেয়া যাক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু দিন পর পরই বেশ কিছু বিষয় নিয়ে উত্তাল হতে দেখা যায়। এই ধরুন আমেরিকাতে কোনো শ্বেতাঙ্গ পুলিশ ধারা নিগ্রোদের উপর অত্যাচার হলো। এ নিয়ে বাঙালিদের রক্ত গরম হয়ে গেলো কয়েক সেকেন্ডে। একের পর এক প্রতিবাদী পোস্ট, যেখানে মানবতার বুলি আওড়াচ্ছেন সবাই। যেন জাত, ধর্ম, বর্ণ কোনোকিছুকে পাত্তাই দিচ্ছেন না তারা। আবার এ দেশেই দিনে কোটি টাকার বিউটি প্রোডাক্ট বিক্রি হয় যা কেবল গায়ের রং পরিবর্তন করতে সক্ষম।
ছোটবেলা থেকেই ‘ফেয়ার এন্ড লাভলী’ এর নাম শুনেছি। তখন বুঝতাম না ফেয়ার মানে কি, লাভলী মানে কি, আর এই ক্রিম কেন ব্যবহার করা হয় তাও জানতাম না। শহরের অলিগলি থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চল ‘ফেয়ার এন্ড লাভলী’র নাম শুনেননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দায়। অনেকে আবার জানতেনও না এই ক্রীমের গুণাবলী কি। অনেকে শুধু টিভিতে নানান রকমের বিজ্ঞাপন দেখে আকৃষ্ট হতেন এর উপর। এমন অনেক সৌন্দর্যবর্ধক প্রসাধনী রয়েছে যা মানুষের ভরসার জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এইযে একদিকে পুরো বিশ্ববাসী বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন তুলছে, প্রতিবাদ করছে, আবার অন্যদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রোমোশন হচ্ছে এসব বিউটি প্রোডাক্টের। কারণও খুব সহজ, মানুষ মাত্রই সুন্দরের পূজারী, কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো ‘সুন্দর মানেই ফর্সা’ এমন একটা ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে ঘুরছে আমাদের সমাজ৷ বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজতে গিয়ে সবার আগে গায়ের রং দেখেন পাত্রপক্ষ। তাইতো মেয়ের বাবা-মাও আজকাল সচেতন হয়ে মেয়ের ত্বক ফর্সা করার দায়িত্ব পালন করেন মেয়ে বিয়ে দেয়ার অনেকটা আগেই। তাতে মেয়ের ত্বকের ঝুঁকি বাড়লো, নাকি স্বাস্থ্যের ক্ষতি হলো তাতে কার কি যায় আসে?
এইযে সুন্দর হওয়ার প্রতিযোগিতায় প্রকৃতপক্ষে জয়লাভ করছেন একমাত্র ব্যবসায়ীরা। বেশ কিছুদিন আগে আলোচনায় আসে প্রসাধনী বিক্রয়কারী অনলাইন পেজ ‘সাবু শপ’ ও এর মালিক সাব্রিনা সাবু। তার পণ্য ব্যবহার করলে ও খেলে গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা হবে, সঙ্গে উজ্জ্বলতা বাড়বে, চুল পড়া কমবে, চুল গজাবে, দেহের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে ইত্যাদি আরও অনেক উপকারের কথা বলে তিনি তার পণ্যগুলো বিক্রি করতেন। অনেক ক্রেতা পণ্যগুলো ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত হন, এরপর অভিযোগ দায়ের করেন সাব্রিনা সাবুর বিরুদ্ধে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাকে গ্রেফতারও করা হয়।
সাব্রিনা সাবুর মত এমন অনেকেই প্রতারণা করছেন সৌন্দর্যবর্ধক প্রসাধনী বিক্রি করে। বিভিন্ন নামকরা ব্রান্ডও ত্বক ফর্সা করার ক্রিমের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে এবং তা বিক্রিও করছেন। সেসব প্রসাধনীর প্রোমোশন করছেন বিভিন্ন নামি-দামি তারকারা আর প্রোমোশন হচ্ছে গণমাধ্যম জুড়ে। গণমাধ্যম আর তারকা দুটোই যেখানে মানুষের বিশ্বাসের জায়গা। অথচ হারহামেশা এরাই বর্ণবাদের বিপক্ষে নিজেদের অবস্থানের জানান দিচ্ছেন আবার ফর্সা হওয়ার ক্রিমের বিজ্ঞাপনও দিচ্ছেন।
কয়েক মাস আগে অনেক প্রশ্নের মুখে, আলোচনা-সমালোচনায় পরে ‘ফেয়ার এন্ড লাভলী’র নাম পরিবর্তন করে ‘গ্লো এন্ড লাভলী’ রাখা হয়। কিন্তু ‘পন্ডস হোয়াইট বিউটি’ বহাল তবিয়তে এই নামেই চলছে। এমন আরও অনেক কোম্পানি বহাল তবিয়তে লোকের ত্বক সাদা করার কাজে ব্যস্ত। গণমাধ্যমগুলোও তার প্রমোশন করছে নির্দ্বিধায়। আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেক তারকারাই এসব পণ্যের গুণগান গেয়ে যান। তারা কি শুধু সেসব প্রসাধনীর প্রোমোশন করছেন, তারা কি বর্ণবাদের প্রমোশোন করছেন না?
অনন্যা/এসএএস