‘ভাইরাল’ আবার কোন ভাইরাস
বাংলাদেশে বর্তমান সময়ের বহুল জনপ্রিয় শব্দ হিসেবে পরিচিত ‘ভাইরাল’। ছোট-বড় অধিকাংশ মানুষ অদ্ভুত এ ভাইরাস রুপি নেশার পেছনে ছুটছে খেয়ে না খেয়ে। সবাই অদৃশ্য এক লালসার টানে ভাইরাল হতে চায়। আর সেজন্য তারা বেছে নেয় নানান উপায়। কিন্তু সমস্যা হলো, জেনে না জেনে ছোট থেকে বড়, সবাই ভাইরাল হওয়ার এ দৌড়ে ভালোর পাশাপাশি বেছে নেয়, অসুস্থ উপায় বা পদ্ধতি। বলা যায়, বর্তমানে দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে ভাইরাল একটি ভয়াবহ নেশায় রূপ নিয়েছে।

ভাইরাল হওয়ার নেশায় যারা আসক্ত হচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই মনে করেন ভাইরাল মানে জনপ্রিয়তা, এতে তারা খুঁজে পায় অপ্রতুল আনন্দ। আর সেজন্য দিন দিন যেন তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। বেছে নিচ্ছে অসুস্থ কিংবা অনৈতিক কর্মকাণ্ড, আবার কেউবা নিজেকে বা নিজের চিন্তাধারাকে উপস্থাপন করছে ভিন্নভাবে। একজন ব্যক্তি যখন ভাইরাল হওয়ার জন্য তার এমন কর্মকাণ্ড, আচরণ ইত্যাদি ইন্টারনেটে ছবি, অডিও কিংবা ভিডিওর মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব পড়ছে, যা জাতীয় জীবন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঠেলে দিচ্ছে মারাত্মক হুমকির পথে।
যদিও ভাইরাল হওয়া কিংবা করা দোষের কিছু নয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে ইন্টারনেটের অপব্যবহারে এটি নেশার মতো পেয়ে বসেছে মানুষের মস্তিষ্কে, এ নেশায় আসক্তদের একটাই উদ্দেশ্য থাকে, যেভাবেই হোক ভাইরাল হতে হবে। আর সে চিন্তা থেকে তারা ভাইরাল হওয়ার জন্য যেকোনো উপায়কে বেছে নেয়। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে ভালো বা মন্দ বিচার না করেই। প্রকৃতপক্ষে তাদের এ ব্যাপারটা শুধুই জনপ্রিয় হয়ে ওঠার এক অবৈধ পন্থা। আর এ পন্থাকে আশ্রয় করে হয়তো বিপুল পরিমানে জনপ্রিয় হয় কিন্তু তা একান্তই সাময়িক সময়ের জন্য, আবার সময়ের ঢেউয়ে তা হারিয়ে যায়। পক্ষান্তরে গঠনমূলক কিছু সময়সাপেক্ষ হয়ে থাকে।
একটা সময় ছিল বিনোদন মানেই পরিবারের সাথে বসে একসঙ্গে টেলিভিশনে নাটক কীংবা সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা। সেসময় বাবা-মায়েরাও সন্তান ও অন্যান্যদের সঙ্গে টেলিভিশন দেখতেন। অর্থাৎ বলা যায় সেসময়ের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিল টেলিভিশন। আর সেসব মধুর স্মৃতি যেন জড়িয়ে আছে আজও। সপ্তাহে একদিন শুক্রবার বিটিভে (পরবর্তীতে সবগুলো চ্যানেলে) বাংলা সিনেমা দেখার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে সবাই সিনেমা দেখত। তখন টেলিভিশনগুলোতে ধারাবাহিক নাটক চলতো। শিশুদের জন্য সপ্তাহে একদিন সিসিমপুর অনুষ্ঠান হতো। সবকিছুতেই একটা বাঙ্গালীত্ব ভাব ছিল। বাঙালির হাজার বছরের চলন-বলন, আচার-আচরণ, সংস্কৃতি ফুটে উঠত নাটক-সিনেমা ও অনুষ্ঠানগুলোতে।
অথচ সময়ের সঙ্গ সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে। দেশ এগিয়েছে ডিজিটালের দিকে। হয়েছে আধুনিকায়ন। বর্তমানে বিনোদনের টেলিভিশনের জায়গা দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন স্যোশাল মিডিয়া (ইউটিউব, ফেসবুক, এক্স ইত্যাদি)।
এটি অবশ্যই গালো যে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। কিন্তু স্যোশাল মিডিয়ার এ যুগ যে গ্রস করছে বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি। সে কথাও অস্বীকর করার উপায় নেই।
এ যুগে মানুষ আর মুখ গুজে পড়ে থাকে না বইয়ের পাতায় সে জায়গা দখল করে নিয়েছে ফেসবুকের পাতা। ইউটিউব ও ফেসবুকের ব্লগ বা কনটেন্ট, রিলস এর জোয়াড়ে ভলসে যাচ্ছে পারিবারিক আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা সুস্থ বিনোদন। অসুস্থ ব্লগ বা কনটেন্ট ভিডিও বানিয়ে ভাইরাল হওয়ার ধান্ধায় ছুটছে বোকা মানুষ গুলো। এসবে নেই কোনো শিক্ষামূলক প্রচারণা কিংবা আদব কায়দার বালাই। অপসংস্কৃতি ও অসামাজিক কার্যকলাপ চর্চার উন্মুক্ত প্লাটফর্মে পরিনত হচ্ছে স্যোশাল মিডিয়া। সমাজে বেপরোয়া ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে রুচির দুর্ভিক্ষ নামের মহামারী।
তাই বলে সবই খারাপ সেটি বলা যায়না। অনেকেই ভালো মানের ও শিক্ষণীয় কনটেন্ট তৈরি করেও ভাইরাল হচ্ছেন। তারা দেশীয়-আন্তর্জাতিক মানের ও তথ্যনির্ভর কনটেন্ট তৈরি করছেন। কিন্তু, স্মার্ট চিন্তা কিংবা সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে খুব কম মানুষই কন্টেন্ট বানাচ্ছেন। আর খারাপ এবং অসুস্থতার জোয়ারে ভালোর পরিমান খুবই নগন্য।
ভাইরাল হওয়ার চিন্তায় মগ্ন এ সমাজ। সবার মধ্যে লাইক, কমেন্ট, সাবস্ক্রাইভ আর ভিউয়ার্স বাড়ানোর এক নেশা। এ নেশায় যে যেভাবে পারছে সেভাবে মানুষকে বিনোদনের নাম করে যা ইচ্ছে তাই ভিডিও বানিয়ে আপলোড করছে। ভিনদেশের অসুস্থ সংস্কৃতিকে টেনে এনে বিকৃত অঙ্গভঙ্গি দেখিয়ে অপবিনোদন এ সমাজের মস্তিষ্ক নষ্ট করছে।
ভিউয়ার্স বাড়ানোর চিন্তায় ব্লগের নামে যেখানে সেখানে ভিডিও করে মানুষকে ভিডিওর ফ্রেমে এনে, প্রশ্ন করে কিংবা প্রাঙ্ক করে বিব্রত অবস্থায় ফেলে দিচ্ছে অনেকে। বিশেষ করে উড়তি (বাড়ন্ত) বয়সের ছেলেমেয়েরা এসব কাজ বেশি করছে। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন গানের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ব্যবহার করে ইমোশনকে কাজে লাগিয়ে বিচ্ছিরি মানের কনটেন্ট তৈরি করছে তারা।
এসব কনটেন্ট একজন রুচিবোধ সম্পন্ন মানুষ কখনো স্বাভাবিক অবস্থায় দেখতে পারেন না। সামাজিক মূল্যবোধ হারানোর ফলে ছেলেমেয়েরা এ ধরনের ভিডিও কনটেন্ট বানাতে সময় অপচয় করছে।
বর্তমানে ভাইরাল ইন্টারনেটের একটি প্রভাব। ভাইরালকে শুধু ভাইরাল বা নিছক বিষয় বলে অবহেলা করলে ভুল হবে। কেননা, আমাদের জাতীয় জীবনে ভাইরালের প্রভাব লক্ষ্যনীয়। ভাইরাল আন্তর্জাতিকভাবেও প্রভাব ফেলে। ভাইরালের মাধ্যমে একটি সমাজের বা দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি অন্য সমাজ বা দেশকে প্রভাবিত করে। আবার অনেকে ভাইরাল হওয়ার জন্য এমন সব কর্মকাণ্ড করে থাকে, যার ফলে অসুস্থ সংস্কৃতি বৃদ্ধি পায়।
যার ফলে চরমভাবে নৈতিক অবক্ষয়ের শঙ্কা থাকে। যা জাতীয় জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে। মানুষের মধ্যে ভাইরাল হওয়ার প্রবণতা যেভাবে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা একটা সময় ভয়ংকর রূপ নিতে পারে। আর ভাইরালের এমন অসুস্থ প্রতিযোগিতার ফলে সমাজে সুস্থ সংস্কৃতির ঘাটতি দেখা দিচ্ছে, সেদিকে খেয়াল রেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
কনটেন্ট তৈরির জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি নিয়ম করা দরকার এবং যারা ভাইরাল হওয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে আছে, তাদের ব্যাপারে ভাবতে হবে। অন্যথায় এর প্রভাবে দেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট হতে পারে। তাই সরকারের আইন প্রণয়নের পাশাপাশি দেশের নাগরিদেরও এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। একটি সচেতন বিবেক সদাজাগ্রত। আর সদাজাগ্রত জাতিই গড়ে তুলতে পারে একটি সুন্দর সমাজ।