ভাষার নির্বাসনে থাকা মানবী
ঝুম্পা লাহিড়ি মূলত পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন তার ছোটগল্পের বইয়ের জন্যে। অথচ উপন্যাসেই তার সাবলীলতা সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য তার ছোটগল্পের বইয়ের বিষয়বস্তু এবং গল্পের আঙ্গিকই তাকে এনে দিয়েছিলো অমন খেতাব। ঝুম্পা লাহিড়ি সেই সামান্য কিছু বাঙালী লেখকদের একজন যারা ইংরেজিতে উপন্যাস লিখে সফল হতে পেরেছেন। তবে অন্য ইংরেজি ভাষায় লেখা ভারতীয় ঔপন্যাসিকদের থেকে তিনি কিছুটা আলাদা। প্রচণ্ড মমতায় তিনি ফুঁটিয়ে তুলেছেন ভাসমান বাঙালীদের।
উপন্যাস লেখার যাত্রাটা এত সহজ না। ভাষার জটিল চক্রবুহ্য ভেদ করে নতুন জগত নির্মাণ করাটা কষ্টসাধ্য। আর সেই বুহ্যে মানুষকে সাজিয়ে গুছিয়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা আরো কঠিন। সেখানে ঝুম্পা লাহিড়ি বেছে নিয়েছেন অনেকটা স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা মানুষদের। নিজ মাতৃভূমি থেকে অনেক দূরে কখনো বিবর্ণ তুষারে একাকীত্ব অনুভব করা অথবা শহরের ভিড়েও নিজেকে একদম আলাদাভাবেই চিহ্নিত করা সেই ভাসমান বাঙালীদেরকেই তিনি তার লেখায় তুলে এনেছেন বারবার।
এই কাজটি সহজ ছিলো না। বহু পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি যখন নিজের লেখার বিষয়ে কথা বলেন, তখন বোঝা যায় কিভাবে পেরেছিলেন। কারণ, এই অনুভূতির সাথে ঝুম্পা লাহিড়ি নিজেই অনেক পরিচিত। ভাষার নির্বাসনে থাকার সাথে সাথে মাতৃভূমি থেকে দূরে থাকার বিষণ্ণতাই যেন দায়ী।
বাঙালী হওয়া স্বত্বেও ঝুম্পা বাংলায় ভালোভাবে লিখতে পারেন না। কলকাতার বাসিন্দা বাবা-মা পাড়ি জমিয়েছিলেন ব্রিটেনে। সেখানেই ১৯৬৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন ঝুম্পা। অবশ্য পরে বাবা-মা আমেরিকায় চলে যান। বাবা ছিলেন শিক্ষক এবং মা লাইব্রেরিয়ান। ব্রিটেনে পৌঁছেও বাঙালী পরিচয় পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারেননি। মেয়ের নাম রাখেন নীলাঞ্জনা সুদেষ্ণা লাহিড়ি।
ব্রিটেনে জন্ম নেয়ায় লেখাপড়া করতে হয়েছে ইংরেজিতেই। তাই ভালোভাবে বাংলা লেখার মতো ভাষাজ্ঞান রপ্ত করতে পারেননি। অবশ্য বিভিন্ন পূজা কিংবা পার্বণে বাবা-মায়ের সাথে ভারতে যাওয়া হতো। সেখানেও কেমন নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে হতো। যাহোক, বার্নার্ড কলেজে বিএ সম্পন্ন করে তিনি ইংরেজিতে এমএ করেন। এমএ করার সময় ক্রিয়েটিভ রাইটিং, আর কম্প্যারাটিভ লিটার নিয়েও অধ্যয়ন করেন। পরবর্তীতে রেনেসা স্টাডিজে পিএইচডি করেন।
ঝুম্পা লাহিড়ি অবশ্য আকস্মিকভাবে লেখা শুরু করেননি। নিজ দেশ থেকে দূরে থাকায় নিজ অস্তিত্বে এক চিড়ের সন্ধান পেয়েছিলেন বোধহয়। ১৯৯৯ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ “ইন্টারপ্রেটার অব মালাডিজ” প্রকাশিত হয়। প্রথম গল্প সমালোচকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়। এই বইয়ের বেশকিছু গল্প আগেও ‘নিউ ইয়র্কার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো। বইয়ের টাইটেল স্টোরির জন্যে তিনি ও’হেনরি পুরষ্কার পান।
কিন্তু সে তো সবে শুরু। একজন খাঁটি আমেরিকানের দৃষ্টিতে লেখা তার উপন্যাসের বিষয়বস্তু একদম অভিনব। শুধু কি তাই? কলকাতায় যতটুকু অভিজ্ঞতা তিনি লাভ করতেন তাও তিনি লেখায় দক্ষতার সাথে তুলে ধরতেন। তার গল্পের চরিত্রগুলো সচরাচর ভারত থেকে অভিবাসন করে আসা কেউ অথবা অভিবাসী বাবা-মায়ের সন্তান। তাদের প্রান্তিক অবস্থান, নিজের অস্তিত্বের সংকট- সবই যেন তিনি তুলে ধরার চেষ্টা করতেন প্রতিটি লেখায়।
গল্পে নিজের ভাষার দখল তাকে আত্মবিশ্বাস দিয়েছিলো। এমনকি শিকাগোর প্রকাশনা শিল্পের অনুপ্রেরণাও তাকে সাহায্য করেছিলো। একবার তিনি বলেছিলেন, ‘পুরো শহরে এত মমতার সাথে বই পড়া এবং সাহিত্যপাঠের গুরুত্ব তুলে ধরার পদক্ষেপগুলোকে আমি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করি যেখানে কাণ্ডজ্ঞানহীন কিংবা ধ্বংসযজ্ঞের অভাব নেই। সেখানে এমন একটি অনুপ্রেরণামূলক কাজ কিছুটা হলেও স্বস্তি দেয়।’
নিজের প্রথম উপন্যাস ‘দ্য নেমসেক’ এ তিনি তুলে ধরেন গোগোল নামে এক চরিত্র। ভালো নাম নিখিল হলেও সে নামে তার স্বচ্ছন্দ নেই। নিজের নাম গোগোলটিই তার পছন্দ। আত্মপরিচয়ের সংকট, একাকীত্ব এই চরিত্রে প্রকট। ভারতীয় পটভূমি থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলার দৃঢ় প্রচেষ্টা তাকে শান্তি দেয়না। এইযে অভিবাসী জীবনের ডিলেমা, তাই যেন ঝুম্পার প্রতিটি লেখায় প্রকট। বিষয়বস্তুটি বিশ্ববীক্ষার দিক থেকে ভীষণ প্রাসঙ্গিক। অতৃপ্তিই যেন ভাসমান অভিবাসীদের নিয়তি।
একবার এক আলাপচারিতায় ঝুম্পা জানান, ‘ইংরেজি ভাষাটা আমি ভাল জানি কারণ আমার পড়াশোনাটা ইংরেজিতে। তবুও আমার মনে হয়, ইংরেজি আমার ভাষা নয়। কারণ ইংরেজি আমার মা-বাবার ভাষা নয়। বাংলা আমার মা-বাবার ভাষা। আমার আছে দু’টো অর্ধ ভাষা। তাই আমি যখন এখন ইতালিয়ান ভাষায় বই লিখছি, আমার খুব মনে হচ্ছে যেভাবে আমার কোনও নির্দিষ্ট একটা দেশ নেই, ঠিক সেভাবেই আমার কোনও নির্দিষ্ট একটা ভাষাও নেই। যে লেখে তার জন্য ভাষাই দেশ। ভাষা আর দেশ কি আলাদা কিছু? একই জিনিস।’’
এভাবেই ভাষা এবং ভাসার মাঝে থাকা ঝুম্পা লাহিড়ী সেই অনুভূতি প্রকাশ করে গেছেন তার লেখায়। দেশের পরিচয়ে তিনি বাঁচতে রাজি হননি। বরং ভাষাতেই তিনি যেন নিজের পটচিত্র গড়ে নিতে চেয়েছেন। সেখানেও নির্বাসন। ভাষাকে বিশাল এক চিত্রের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ ধরে নিলে যে কেউ এখানকার বিশ্বনাগরিক। কিন্তু কোনো ভাষাতেই তো থিতু হতে পারেননি। মাঝে ইতালির রোমেও গিয়ে থেকেছেন। ইতালীয় ভাষা শেখার চেষ্টা করেছেন। এভাবে নতুন এক শেকড় গেড়ে নিলেন। ইতালীয় ভাষায় একটি উপন্যাসও লিখেছেন যাকে ইংরেজিতে পরে নতুন করে আবার লেখার চেষ্টা করেন। বইটির নাম শুনলেও একটু অবাক হতে হবে – ‘হোয়ার এম আই?’। উপন্যাসটিতে যেন নিজের প্রতিচ্ছবিই তুলে ধরতে চেয়েছেন।
সবখানেই নির্বাসনে থাকা ঝুম্পা সাংস্কৃতিক অধ্যয়নের প্রান্তিক এক মানুষ। স্টুয়ার্ট হল কিংবা কালচারাল স্টাডিজের বিশেষজ্ঞরা বিশ্বায়নের যে সংকটগুলো নিয়ে ভাবেন তার একটিই ঝুম্পা লাহিড়ি তুলে এনেছেন। এমনকি তার স্বামী আলবের্তো ভুরভুলিয়াসও প্রথম দেখায় বুঝতে পারেননি ঝুম্পা কোন দেশের। বরং শব্দ আর ভাষাকেই নিজের অস্তিত্ব ঠিক করে রেখেছেন ঝুম্পা।
ঝুম্পা লাহিড়ি শক্তিমান নারী লেখকদের একজন। যেকোনো আন্তর্জাতিক পাঠক তার লেখায় স্বকীয় মূলস্রোত খুঁজে পান। যেন নদীর পানিতে একাই ভেসে ভেসে হুট করে এক ডাঙায় ঠাঁই পাওয়া। আবার সেই ঠাঁই থেকে ভেসে নতুন স্রোতের খোঁজ করা।
অনন্যা/এআই