সাইবার সহিংসতায় নারীদের ভোগান্তি
সাইবার অপরাধ আজ বিশ্বের এক জটিল সমস্যায় পরিণত হয়েছে। দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদন অনুসারে, প্রতি বছর প্রায় ৯ কোটি সাইবার আক্রমণে ৫৭৫ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়। বাংলাদেশেও সাইবার অপরাধের প্রকোপ বাড়ছে বিশেষ করে নারীরা এর প্রধান শিকার। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নারীদের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই কোনো না কোনোভাবে অনলাইনে হয়রানির শিকার।
বাংলাদেশে ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বর্তমানে দেশে ১৩ কোটির বেশি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী এবং ৫ কোটির বেশি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। তবে এ প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে সাইবার অপরাধের ঝুঁকিও বাড়ছে। ভয়েস ফর ইন্টারঅ্যাকটিভ চয়েস অ্যান্ড এমপাওয়ারমেন্টের একটি সেমিনারের তথ্য অনুযায়ী, গত সাড়ে তিন বছরে সাইবার অপরাধের শিকার হয়ে ৬০ হাজার ৮০৮ জন নারী প্রতিকার চেয়েছেন। এর মধ্যে ৪১ শতাংশ ডক্সিং, ১৮ শতাংশ ফেসবুক আইডি হ্যাক, ১৭ শতাংশ ব্ল্যাকমেইলিং, ৯ শতাংশ ইমপারসোনেশন এবং ৮ শতাংশ সাইবার বুলিংয়ের শিকার।

ভুক্তভোগীদের অনেকেই জানেন না কীভাবে প্রতিকার চাইতে হবে। এমনকি অনেক সময় মামলা করলেও সামাজিক চাপ বা ভয়-ভীতির কারণে তারা অভিযোগ তুলে নিতে বাধ্য হন।
নারীদের প্রতি সহিংসতা সাইবার জগতে একটি বাস্তব সমস্যা। গবেষণায় দেখা গেছে, ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সি মেয়েরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। বিশেষত সুপার ইম্পোজ করা ছবি এবং পর্নোগ্রাফি প্রকাশের মতো ভয়াবহ অপরাধ নারীদের মানসিক ও সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।
প্রতিরোধে করণীয়
সচেতনতা বৃদ্ধি
সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে প্রথম ধাপ হলো সচেতনতা। কীভাবে অভিযোগ দায়ের করতে হয় এবং কোথায় গেলে প্রতিকার পাওয়া যায় এই বিষয়ে পত্রপত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণা চালানো জরুরি।
প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার
মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হলে সাইবার সিকিউরিটির মৌলিক নিয়মগুলো জানা প্রয়োজন। যেমন ব্যক্তিগত তথ্য গোপন রাখা, অজানা লিঙ্কে ক্লিক না করা, এবং শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা।
অভিভাবকদের ভূমিকা
পিতামাতা ও অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের ইন্টারনেট ব্যবহারে সচেতন করা। প্রযুক্তির সুবিধা ও ঝুঁকি সম্পর্কে তাদের শিক্ষা দেওয়া অপরিহার্য।
আইনের প্রয়োগ
বাংলাদেশে আইসিটি অ্যাক্ট অনুযায়ী, কারো অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও ধারণ ও তা প্রকাশ করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ক্ষেত্রে ১০ বছর কারাদণ্ড এবং ১০ লক্ষ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এই আইন কার্যকর করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতা বাড়াতে হবে।
প্রতিকারের পদ্ধতি
ডিজিটাল ডকুমেন্টেশন
ফোনালাপের রেকর্ড, স্ক্রিনশট, অডিও বা ভিডিও ফাইল সংগ্রহ করে রাখতে হবে।
সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ
আইসিটি বিভাগের সাইবার হেল্প ডেস্ক, পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন (০১৭৬৬৬৭৮৮৮৮), হটলাইন (৯৯৯) এবং সিআইডি ও র্যাবের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।

সামাজিক উদ্যোগ
নারীদের সাইবার সহিংসতা থেকে সুরক্ষিত রাখতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আট দফা সুপারিশের মধ্যে গবেষণা, গাইডলাইন প্রণয়ন, ডিজিটাল লিটারেসি বৃদ্ধি এবং মোবাইল অ্যাপস তৈরির মতো পদক্ষেপগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার।
সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে সরকার, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, অভিভাবক এবং সমাজের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো এবং সাইবার স্পেসকে নিরাপদ করার মধ্য দিয়েই এ সমস্যার প্রতিকার করা সম্ভব।