ঠান্ডায় কি স্নায়ুর ব্যথা বাড়ে
স্নায়ুর ব্যথা বা নিউরোপ্যাথিক পেইন এমন এক ধরণের ব্যথা যা স্নায়ুতন্ত্রের কোনো ক্ষতি বা ত্রুটির কারণে দেখা দেয়। এটি সাধারণত তীক্ষ্ণ, ঝলসানো, বা বিদ্যুৎ চমকের মতো ব্যথার অনুভূতি তৈরি করে। অনেকেই লক্ষ্য করেন শীতকালে বা ঠান্ডা আবহাওয়ায় এই ধরণের ব্যথা বৃদ্ধি পায়। তবে এটি শুধুমাত্র কাকতালীয় নয় ঠান্ডা আসলে স্নায়ুর ব্যথা বৃদ্ধি পেতে পারে। জেনে নেয়া যাক ঠান্ডায় স্নায়ুর ব্যথা কেন বাড়ে, কীভাবে এটি শরীরের ওপর প্রভাব ফেলে এবং এর প্রতিকার করা যায়।
ঠান্ডা এবং স্নায়ুতন্ত্রের সংযোগ
ঠান্ডা আবহাওয়া বা পরিবেশ স্নায়ুতন্ত্রের কাজকর্মকে সরাসরি প্রভাবিত করতে পারে। নিম্ন তাপমাত্রা আমাদের স্নায়ু ও রক্তনালী সংকুচিত করে। এতে শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্ত সঞ্চালন কমে যায়৷ এর ফলে স্নায়ুর সংবেদনশীলতা বেড়ে যায়। স্নায়ুর ক্ষতিগ্রস্ত অংশে রক্ত সঞ্চালনের অভাব স্নায়ুর ব্যথাকে আরও তীব্র করে তোলে।
শরীরের যেসব অংশ ঠান্ডার সংস্পর্শে বেশি আসে (যেমন হাত, পা, বা কান) সেখানে স্নায়ুর সংকোচন বা স্নায়ু-প্রদাহের ঝুঁকি থাকে বেশি। ফলে ঠান্ডায় যাদের নিউরোপ্যাথিক ব্যথার সমস্যা রয়েছে তাদের এই সময় ব্যথা বৃদ্ধি পাওয়াটা স্বাভাবিক।
ঠান্ডায় স্নায়ুর ব্যথা কেন বাড়ে?
ঠান্ডা আবহাওয়ায় রক্তনালী সংকুচিত হয়। ফলে স্নায়ুর চারপাশের টিস্যুগুলো পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি পায় না। রক্ত সঞ্চালন কমে গেলে স্নায়ুর সংবেদনশীলতা বেড়ে যায় এবং ব্যথা আরও তীব্র হয়।ঠান্ডা ত্বকের এবং স্নায়ুর সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে দেয়। স্নায়ু যদি ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত বা প্রদাহগ্রস্ত থাকে, তবে ঠান্ডা সেই ব্যথার মাত্রা বাড়িয়ে তোলে।মাসল স্টিফনেস (পেশির শক্ত হয়ে যাওয়া)।
ঠান্ডায় আমাদের পেশি এবং জোড়াগুলো শক্ত হয়ে যায়, যা স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এই চাপ থেকে ব্যথা বেড়ে যেতে পারে।ঠান্ডা আবহাওয়া আমাদের মানসিক অবস্থার ওপরও প্রভাব ফেলে। শীতকালে বিষণ্নতা বা মানসিক ক্লান্তি বেশি দেখা যায়, যা স্নায়ুর ব্যথা আরও তীব্র করে তোলে।শীতকালে যেসব ব্যক্তির আর্থ্রাইটিস, সায়াটিকা, বা অন্য কোনো প্রদাহজনিত রোগ রয়েছে, তাদের প্রদাহ আরও বাড়ে। এই প্রদাহ স্নায়ুর ব্যথার একটি বড় কারণ হতে পারে।
যাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা বেশি হয়
ঠান্ডায় স্নায়ুর ব্যথা বৃদ্ধির ঝুঁকি থাকে। যাদের ডায়াবেটিসজনিত নিউরোপ্যাথি রয়েছে, সায়াটিকা বা স্পাইনের সমস্যার কারণে ব্যথা হয়, আঘাতজনিত স্নায়ুর ক্ষতি হয়েছে, আর্থ্রাইটিস বা প্রদাহজনিত রোগ রয়েছে, বয়স্ক মানুষ, যাদের স্নায়ু স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল।
ঠান্ডায় স্নায়ুর ব্যথা কমানোর উপায়
উষ্ণতা বজায় রাখা
শীতকালে উষ্ণতা বজায় রাখার জন্য সঠিক পোশাক পরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্নায়ুর ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে শরীরকে গরম রাখা দরকার। গরম কাপড়, মাফলার, টুপি এবং মোজা ব্যবহার করতে হবে।
গরম পানির সেঁক
গরম পানির সেঁক স্নায়ুর ব্যথা কমাতে খুব কার্যকর। এটি স্নায়ু ও পেশি শিথিল করে এবং রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়।
শরীরচর্চা
শীতকালে নিয়মিত শরীরচর্চা করলে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায় এবং পেশি ও স্নায়ু শক্তিশালী হয়। হালকা যোগব্যায়াম বা স্ট্রেচিং ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
ব্যথানাশক ওষুধ
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পেইনকিলার বা টপিকাল ক্রিম ব্যবহার করা যেতে পারে। মেন্থল বা ক্যাপসাইসিনযুক্ত ক্রিম স্নায়ুর ব্যথা প্রশমিত করতে পারে।
পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ
সঠিক পুষ্টি স্নায়ুর কার্যকারিতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। ভিটামিন বি-১২, ম্যাগনেসিয়াম, এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড স্নায়ুর কার্যকারিতা উন্নত করে।
পর্যাপ্ত পানি পান করা
শীতকালে পানি কম পান করার প্রবণতা থাকে যা শরীর ডিহাইড্রেটেড করে তোলে। ডিহাইড্রেশন স্নায়ুর ব্যথা বাড়াতে পারে। তাই পর্যাপ্ত পানি পান করা জরুরি।
স্ট্রেস কমানো
মনস্তাত্ত্বিক চাপ স্নায়ুর ব্যথা বাড়াতে পারে। মেডিটেশন বা রিলাক্সেশন থেরাপি এই চাপ কমাতে সাহায্য করে।
ডাক্তারের পরামর্শ
যদি ব্যথা খুব বেশি তীব্র হয় তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। তারা প্রয়োজন অনুযায়ী ওষুধ বা থেরাপি দিয়ে থাকেন।
ঠান্ডায় স্নায়ুর ব্যথার কিছু ভুল ধারণা
ঠান্ডা ব্যথা বাড়ায় না এটি সঠিক নয়। গবেষণা বলছে ঠান্ডা আবহাওয়া সত্যিই স্নায়ুর ব্যথা বাড়াতে পারে।উষ্ণতা সবসময় সাহায্য করে। গরম সেঁক বা হিট প্যাড অনেক ক্ষেত্রে উপকারী হলেও অতিরিক্ত তাপ স্নায়ুকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
স্নায়ুর ব্যথা নিয়ে গবেষণার সাম্প্রতিক তথ্য
বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, ঠান্ডা পরিবেশে ত্বক এবং স্নায়ুর সংবেদনশীলতা বেড়ে যায়। শীতকালীন বিষণ্নতা বা সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিজঅর্ডার (SAD) মানসিক চাপ বাড়ায় যা স্নায়ুর ব্যথার প্রভাবকে আরও তীব্র করতে পারে।
ঠান্ডা আবহাওয়া স্নায়ুর ব্যথাকে বাড়াতে পারে, তবে সচেতন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এই ব্যথা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। উষ্ণতা বজায় রাখা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, শরীরচর্চা এবং ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চললে ঠান্ডায় স্নায়ুর ব্যথার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। শীতকালীন এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সচেতনতার বিকল্প নেই।
স্নায়ুর স্বাস্থ্য রক্ষা করতে হলে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সামঞ্জস্য বজায় রাখা, স্ট্রেস কমানো এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঠান্ডা আবহাওয়াকে জয় করে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ বজায় রাখাই হলো মূল লক্ষ্য।