রিলস এক সম্মোহনী নাগিন
বর্তমানে স্মার্টফোন প্রায় সব ঘরেই আছে। বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ সবার হাতেই দিনের কোনো কোনো সময় স্মার্টফোন যাচ্ছে। আর স্মার্টফোনের বদৌলতে নিজের অজান্তেই ডুবে যাচ্ছে রিলস কিংবা শর্টসের নেশায়। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এই কনটেন্টগুলো আকর্ষণীয় ও সংক্ষিপ্ত হওয়া সবার আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
অজগর যেমন সম্মোহনী দৃষ্টিতে তার শিকারদের বিহ্বল করে তাদের গ্রাস করে ফেলে, ঠিক তেমনই স্কুল-কলেজের পড়ুয়া থেকে শুরু করু ছেলে-বুড়ো অর্থ্যাৎ সমাজের একটা বড় অংশকে সম্মোহিত করে ফেলেছে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট হতে থাকা ১০-২০ সেকেন্ডের ভিডিওর সারি।
এমন এক একটা ভিডিওই পরিচিত ‘রিল’ নামে। হালের হিট গান ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কোনও গানের ব্যান্ডের নাচা-গানার দৃশ্য থেকে শুরু করে পাশের বাড়ির তরুণীর নিজের ঘরে নাচ, গানের পাশাপাশি মা খালাদের হেঁশেলের সামান্য বেগুন ভর্তা থেকে খাসির রেজালা কিছুই বাদ যায়না। অর্থ্যাৎ বলা যায় রিলের বিষয়বস্তু হতে পারে জীবনের প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় যে কোনও বিষয়ই।
বলা যায় অধিকাংশ মানুষই বিনোদনের জন্য রিলস দেখতে শুরু করলে কয়েক ঘন্টা সময় যে অকারণে কীভাবে হাওয়ায় উড়ে যায় সে খেয়াল থাকেনা। ধরুন, রাত ১২টায় ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে বিছানায় গেলেন। সকালে আবার ক্লাস বা অফিস আছে। ভালো ঘুম দরকার। হঠাৎ মনে হলো, একটু সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ঘুরে আসি।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুঁ মারার পর রিলস দেখা শুরু করলেন এবং একটার পর একটা দেখতেই থাকলেন। তারপর যখন ঘুমানোর কথা আবার মনে পড়ল, তখন দেখলেন এক-দুই ঘণ্টা সময় এরই মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে।
এতে কাজের ক্ষেত্রে যেমন সময় নষ্ট করে তেমনি নষ্ট করে দেয় মনোযোগও। এর প্রভাবে সৃজনশীল চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা ও ধৈর্য কমে যায়।
যখন আমরা খাবার খাই, যখন কেউ প্রশংসা করে কিংবা কোনো ব্যক্তিগত অর্জন হয়; তখন আমাদের মস্তিষ্ক ডোপামিন হরমোন নিঃসরণ করে। ডোপামিন হরমোন মানুষের মধ্যে শান্তি ও তৃপ্তির অনুভূতি সৃষ্টি করে।
পাশাপাশি ব্রেন, মানসিক অবস্থা, মনোযোগ ও ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে। কেউ যখন রিলস দেখেন, তখন তার মধ্যেও ডোপামিন হরমোন নিঃসরণ হয়। তাই রিলস দেখাটা নেশার মতো হয়ে যায়।
বর্তমানে রিলস দেখার প্রবনতা এতটাই বেড়েছে যে একে অনেকটা ড্রাগের সঙ্গে তুলনা করেছেন লেখিকা তসলিমা নাসরিন। ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে তিনি লিখেছিলেন, ‘
‘রিল জিনিসটা খুব খারাপ।
একটা রিলে ক্লিক পড়লো তো ব্যাস, কয়েক ঘণ্টা কেটে যাবে একের পর এক রিল দেখতে দেখতে। এ অনেকটা ড্রাগের মতো, একবার নিলে বারবার নিতে হয়। রক্ত যেমন ড্রাগকে ডাকে, রক্ত রিলকেও ডাকে।’
রিলের নেশা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে না পারলে ক্রিয়েটিভিটি গোল্লায় যাবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘রিল ক্রিয়েটিভ মানুষের জন্য নয়। যাদের কাজকর্ম নেই, সময়ের কোনো দাম নেই, টাইম পাস করার জন্য উদগ্রীব, তাদের জন্য রিল ঠিক আছে।’
কেবল যে বড়রাই রিল নিয়ে ব্যস্ত থাকছে তা নয়। রিল দেখা ও বানানোর নেশায় ডুবে থাকতে দেখা নতুন প্রজন্মকেও। পড়ালেখা ফাঁকি দিয়ে অভিভাবকদের নজর এড়িয়ে ছেলেমেয়েরা স্মার্টফোন নিয়ে পড়ে থাকে। আর তাদের সময়ের গুরুত্বপুর্ন অংশই নষ্ট করে রিলের পেছনে।
ছোটদের এমন রিল দেখার নেশার মূল কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রখ্যাত মনোবিদ শাহনীলা তৈয়ব তাদের মা-বাবাকেই দায়ী করছেন। তিনি বলেন, ‘আজকের পড়ুয়ারা যখন একেবারে ছোট সেই সময়েই ওদের মনে মোবাইল ফোনের নেশা ধরতে শুরু করে।
ছোটরা দুষ্টুমি করলেই মা-বাবা ওদের শান্ত রাখতে হাতে ফোন তুলে দিয়ে কিছু একটা চালিয়ে দিতেন। ক্রমশ কয়েক বছর পর সেটাই আজকের ভয়াবহ অ্যাডিকশনের চেহারা নিয়েছে।’
ফেসবুকের ভিডিও ফিচার রিলসের ভিডিওগুলোর সময়সীমা হয়ে থাকে ৩ থেকে ৬০ সেকেন্ড পর্যন্ত। আপাতদৃষ্টে এতে সময় নষ্ট হয় না মনে হলেও দিন শেষে দেখা যায় ৩ সেকেন্ড করতে করতে দিনের বেশির ভাগ সময় রিলের পেছনেই চলে যায়।
সোশ্যাল মিডিয়ার মারপ্যাঁচে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বইপড়া, মুভি দেখা বা খবরের কাগজে থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
মনোবিজ্ঞানের ভাষায় যে মানসিক প্রক্রিয়া অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে থেকে কোনো একটি বিষয়ের দিকে আমাদের চেতনাকে কেন্দ্রীভূত করে, তাকে মনোযোগ বলে। মনোযোগের বিস্তার পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রটি হল ট্যাকিস্টোস্কোপ।
বিজ্ঞানঅনু্যায়ী, একজন মানুষের গড় মনোযোগ স্প্যান ৮ দশমিক ২৫ সেকেন্ড। তবে এটি ব্যক্তিভেদে ২ সেকেন্ড থেকে ২০ মিনিটের বেশি সময় হতে পারে। মানুষের বয়স, পরিবেশ এবং নিত্যদিনের কার্যকলাপের প্রকারের মতো বিভিন্ন কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মনোযোগের স্প্যানের পরিবর্তন হয়ে থাকে।
একটি পরিসংখ্যানে এসেছে, ২০০০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মানুষের গড় মনোযোগের স্প্যান প্রায় ২৫ শতাংশ কমেছে এবং তা আশঙ্কাজনকভাবে আরও কমছেই, এটি সব সময়ের জন্য উদ্বেগের কারণ না হলেও অল্প মনোযোগ একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছালে তা একটি অন্তর্নিহিত রোগের লক্ষণ প্রকাশ করে, যাকে বলা হয় মনোযোগ ঘাটতি বা হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার (এডিএইচডি)।
এডিএইচডি আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রায়ই মনোযোগ দিতে এবং তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে সমস্যা হয়।
প্রতি ৩ সেকেন্ড পরপর ভিডিও পরিবর্তন হচ্ছে, কোনো ভিডিও হাস্যরসাত্মক যা দেখে দর্শকদের চোখ আনন্দে চকচক করছে, পরের ভিডিওটি আবার বিয়োগাত্মক, যা দেখে চকচকে চোখে জমাট বাঁধা পানি টলমল করছে, এত দ্রুত পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানুষের আবেগ কি আদৌ খাপ খাইয়ে নিতে পারে!
পরিশেষে বলতে হয়, ফেসবুক রিল আস্তে আস্তে মানুষকে আবেগশূন্য করে দিচ্ছে। এতে মানুষের মন মজ্জায় রিলস এতটাই প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে যে কারও মৃত্যুর খবরে এখন তেমন কষ্ট পেতে দেখা যায়না।
অর্থাৎ মাত্র ৩ সেকেন্ড, কোনো দুর্ঘটনার খবর মনে কষ্ট দিলেও তা আঙুলের ইশারায় ফোনস্ক্রিন স্ক্রল করে নিচে নেমে কোনো কৌতুকপূর্ণ রিলে পরমুহূর্তেই ঠোঁটের কোনে হাসির প্রলেপ নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। মুলত রিলসের সম্মোহনে ৩সেকেন্ডই তুড়ি মেরে উড়ে যায় মানুষের মৃত্যু ঘটনার মতো দুঃখ।