কলেরার টিকার জন্য আন্তর্জাতিক সম্মান পেলেন বাংলাদেশের ফেরদৌসী কাদরী
বাংলাদেশের খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী সম্প্রতি ভিয়েতনামের প্রখ্যাত “ভিনফিউচার স্পেশাল প্রাইজ” লাভ করেছেন। এটি বাংলাদেশের জন্য এক অসামান্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। কলেরা, টাইফয়েড এবং হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) এর সুলভমূল্যের টিকা উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। তাঁর এই গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন উন্নয়নশীল দেশের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য জীবন রক্ষাকারী ভুমিকা রেখেছে।
ড. ফেরদৌসী কাদরী চার দশকেরও বেশি সময় ধরে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছেন। সারা বিশ্বে কলেরা, টাইফয়েড এবং এইচপিভির কারণে প্রতিনিয়ত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব দেশের জনগণের জন্য সহজলভ্য এবং কার্যকর টিকা আবিষ্কারই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। তিনি তাঁর নিরলস পরিশ্রম এবং গভীর গবেষণার মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জন করেন, যা তাঁকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষভাবে পরিচিত করেছে।
ভিনফিউচার স্পেশাল প্রাইজটি বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের মাধ্যমে মানবতার সেবা করার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রদান করা হয়। ২০২৪ সালে এই পুরস্কারের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘রিজিলিয়েন্ট রিবাউন্ড’ যার অর্থ সংকট মোকাবিলা করে নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ানো। এবারের অনুষ্ঠানে ৮০টিরও বেশি দেশ এবং অঞ্চল থেকে প্রায় দেড় হাজার বিজ্ঞানী মনোনীত হন। এর মধ্য থেকে ড. ফেরদৌসী কাদরী তাঁর গবেষণার জন্য এই সম্মানজনক পুরস্কার অর্জন করেন। এই অর্জন শুধুমাত্র তাঁর ব্যক্তিগত সফলতার প্রতীক নয়, পাশাপাশি বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও গবেষণার ক্ষেত্রে এক বিশেষ মুহূর্ত ।
ড. ফেরদৌসী কাদরী ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও আণবিক জীববিদ্যা বিভাগ থেকে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৭৭ সালে এমএস সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি জৈব রসায়ন বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। ১৯৮০ সালে তিনি লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণরসায়ন ও প্রতিষেধক বিদ্যায় পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের পর ড. ফেরদৌসী কাদরী আইসিডিডিআরবির প্রতিষেধক বিদ্যা বিভাগে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠানটির সহযোগী বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেন। তিনি ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেন এবং জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও মিউকোসাল ইমিউনলজি এবং ভ্যাকসিনোলজি বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বে জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে নতুন পথ উন্মোচন করেছে।
কলেরা ও টাইফয়েডের মতো রোগ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে শিশু এবং নারীরা এই রোগগুলোর ঝুঁকিতে থাকে। এইচপিভি ভাইরাস নারীদের জরায়ুর ক্যান্সারের প্রধান কারণ হিসেবে পরিচিত। ড. ফেরদৌসী কাদরীর উদ্ভাবিত সুলভমূল্যের টিকা এই সমস্যাগুলোর সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এ টিকাগুলো কেবল কার্যকরই নয়, বরং আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী হওয়ায় তা সহজেই ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে।
ড. ফেরদৌসী কাদরীর গবেষণা সারা বিশ্বে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তাঁর উদ্ভাবিত টিকাগুলো জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার অনুমোদন পেয়েছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাঁর এই সাফল্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।
ড. ফেরদৌসী কাদরীর গবেষণা ও উদ্ভাবনের সাফল্য নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে দাড়িয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বিজ্ঞান চর্চা এবং গবেষণার জন্য যে সুযোগ সৃষ্টি করেছেন তা অসাধারণ। তিনি নিজেই প্রমাণ করেছেন যে সংকল্প, পরিশ্রম, এবং সঠিক লক্ষ্য থাকলে যে কেউ অসাধ্যকে সাধন করতে পারে।
ড. ফেরদৌসী কাদরীর অর্জন কেবল বাংলাদেশের জন্য গর্বের নয়, এটি সারা বিশ্বের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। তাঁর উদ্ভাবিত টিকাগুলো মানুষের জীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ভিনফিউচার স্পেশাল প্রাইজের মাধ্যমে তাঁর অবদানের যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলেছে, সেটা প্রমাণ করে যে মানবতার কল্যাণে কাজ করার মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে পরিবর্তন আনা সম্ভব।