করলা কেন তিতা হয়
করলা আমাদের খাদ্যতালিকার এমন একটি সবজি যা পুষ্টিগুণের জন্য পরিচিত হলেও এর তিতকুটে স্বাদ অনেকের কাছে অপছন্দনীয়। করলার তিতাভাব সম্পর্কে জানার জন্য আমাদের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন হবে।
করলার তিতাভাবের কারণ
করলার তিতাভাব মূলত এর মধ্যে থাকা একটি বিশেষ রাসায়নিক যৌগের কারণে হয়। এই যৌগটি হলো মোমোর্ডিসিন। করলার বৈজ্ঞানিক নাম Momordica charantia এবং নামের মধ্যেই এই তিক্ততার মূল সূত্রটি লুকিয়ে আছে। মোমোর্ডিসিন করলার পাতা, ফল এবং বীজে পাওয়া যায়। এটি একটি প্রাকৃতিক গুরুত্বপূর্ণ পদার্থ, যা করলাকে বিভিন্ন কীটপতঙ্গ এবং প্রাণীদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে।
তিতকুটে স্বাদের জন্য দায়ী আরও কিছু রাসায়নিক যৌগ হলো টেট্রাসাইক্লিক ট্রাইটারপেনয়েড। এগুলো করলাকে শুধুমাত্র তিতকুটে স্বাদের করে তোলে না একইসাথে এর স্বাস্থ্যগুণ বাড়াতেও ভূমিকা রাখে। বিশেষত এই যৌগগুলো শরীরের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
করলার তিতাভাবের উপকারিতা
তিতা স্বাদের কারণে করলা আমাদের স্বাদগ্রহণের ইন্দ্রিয়কে উত্তেজিত করে এবং হজম প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। তবে শুধু হজমশক্তি বাড়ানো নয়, করলার তিতকুটে স্বাদ তার ভেষজগুণগুলোকেও প্রতিফলিত করে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে করলা
করলার তিতকুটে যৌগ রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এর মধ্যে থাকা পলিপেপটাইড-পি নামক এক ধরনের ইনসুলিন-সদৃশ যৌগ টাইপ-২ ডায়াবেটিসের জন্য উপকারী।
লিভারের জন্য উপকারী
করলা লিভারের কার্যক্ষমতা বাড়ায় এবং লিভার থেকে ক্ষতিকারক টক্সিন দূর করতে সাহায্য করে। তিক্ত যৌগগুলো লিভারের এনজাইমের কার্যক্রম উন্নত করে।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য
মোমোর্ডিসিন এবং অন্যান্য ফাইটোকেমিক্যাল অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। এগুলো শরীরের কোষগুলোর ক্ষয়ক্ষতি রোধ করে এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল গুণাবলি
করলার তিতা স্বাদ কীটপতঙ্গ এবং ক্ষতিকর মাইক্রোব থেকে করলাকে সুরক্ষা দেয়। এই গুণ মানুষের শরীরেও কাজে লাগে। বিশেষত পরিপাকতন্ত্রের ইনফেকশন দূর করতে।
করলার তিতাভাবের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলাদেশ, ভারত এবং চীনের মতো দেশে করলাকে খুবই পুষ্টিকর এবং ভেষজগুণসম্পন্ন খাদ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। এসব দেশে করলার তিতকুটে স্বাদ গ্রহণের বিষয়ে এক ধরনের ইতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠেছে। তিতা খাবারের স্বাদ গ্রহণ করার অভ্যাস শুধুমাত্র খাদ্যসংস্কৃতির একটি অংশ নয় বরং এটি শরীর ও মনের স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী বলে বিবেচিত হয়।
ভারতীয় আয়ুর্বেদে করলাকে ‘তিতা টনিক’ বলা হয় যা শরীর থেকে অতিরিক্ত তাপ বের করে দেয় এবং রক্ত পরিশোধন করে। চীনা ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাবিদ্যায় করলাকে বিভিন্ন জ্বর এবং সংক্রমণের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়।
বাংলাদেশেও করলা জনপ্রিয়। ভাজি, ভর্তা কিংবা ডালসহ বিভিন্ন পদ্ধতিতে করলা রান্না করা হয়। করলার তিতাভাবকে কাটানোর জন্য অনেকে লবণ মেখে রাখেন বা সিদ্ধ করে নেন। তবে এই প্রক্রিয়াগুলোতে কিছু পুষ্টিগুণ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
করলার তিতা কমানোর পদ্ধতি
অনেকেই করলার তিতা স্বাদ কমিয়ে খেতে চান। এখানে কয়েকটি সহজ পদ্ধতি তুলে ধরা হলো:
লবণ ব্যবহার: করলা কেটে লবণ দিয়ে ১৫-২০ মিনিট রেখে দিলে তিতাভাব কিছুটা কমে।
সিদ্ধ করা: রান্নার আগে করলাকে সামান্য সময়ের জন্য সিদ্ধ করলে তিতা কমে যায়।
টক বা মিষ্টি উপাদান যোগ করা: রান্নার সময় টক দই, টমেটো বা গুঁড় ব্যবহার করলে করলার তিতা স্বাদ ভারসাম্যপূর্ণ হয়।
করলা নিয়ে আধুনিক গবেষণা
করলার তিতকুটে স্বাদ নিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানেও অনেক গবেষণা হয়েছে। কিছু গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, করলার তিতা যৌগ ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি রোধে ভূমিকা রাখতে পারে। করলার তিক্ততা নিয়ে আরও গবেষণা চলছে, যা ভবিষ্যতে নতুন ওষুধ তৈরিতে সাহায্য করতে পারে।
করলার তিতাভাব একটি প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য যা তার পুষ্টিগুণ ও ভেষজগুণের প্রতীক। যদিও এই তিতা স্বাদ অনেকের কাছে অপছন্দনীয়, তবে এটি স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। করলার তিতা নিয়ে মনোভাব পরিবর্তন করে যদি আমরা এর গুণাগুণকে গুরুত্ব দিই, তাহলে এটি আমাদের খাদ্যতালিকায় আরও উপকারী ভূমিকা পালন করতে পারে।
তাই করলা তিতা কেন হয় তা বোঝা যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনই এই তিতাভাব আমাদের শরীর এবং জীবনের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা উপলব্ধি করাও সমান জরুরি। তাই অপছন্দনীয় হলেও শরীরের সুস্থতার জন্য করোলাকে রাখতে পারেন আপনার খাদ্য তালিকায়।