মেয়েটি লড়াই করতে শিখুক নারী হয়ে উঠুক
সমাজে নারীকে পূর্ণ মানুষ হিসেবে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতে শেখাবার শিক্ষা যেমন এদেশের পুরুষদের জন্য বাধ্যতামূলক, তেমনি নিজেকে পূর্ণ মানুষ য হিসেবে জেনে নিজের অধিকার আর মর্যাদার প্রতি সচেতন থেকে সাহসী, শক্তিশালী আর দ্বিধাহীন থাকবার শিক্ষা প্রয়োজন নারীদেরও।
এই শিক্ষার মাধ্যমে নারী সচেতন হতে পারবে তার অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। আর সমাজের সব ধরনের অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে নারীকে অসম সাহসে ঘুরে দাঁড়াতে, তাকে পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে লড়াই করার শক্তি অর্জনের শিক্ষা দিতে হবে পরিবার থেকেই। অভিভাবকদের সাপোর্টে বাড়ির মেয়েটি সমাজের সমস্ত বাঁধার সঙ্গে লড়াই করে একজন পরিপূর্ণ সফল নারী হয়ে উঠতে। মানুষ কিব্যে প্রাণী, বিপর্যয়ে সবচেয়ে নির্মম আক্রমণগুলির সম্মুখীন হয় নারী ও শিশুরা। কিছু গবেষকের মতে, প্রায় সকল দলবদ্ধ জীবের জগতে একই নিয়ম খাটে, এবং বেবুন থেকে নেউল পর্যন্ত সকল বন্যপ্রাণীই পরাভূত দলের শিশুদের মেরে স্ত্রী প্রাণীদের নিয়ে পালায়। মানুষ এককালে এই নিয়ম মোতাবেক সামরিক বিজয়গাথা রচনা করেছে, এবং কর্তৃত্ব কায়েমের অভ্যাসে বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে তার বিশেষ প্রভেদ নেই।
পশ্চিম এশিয়ায় একটানা সামরিক অভু্যুত্থানে ছিন্ন ভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার নকশাগুল্যে ভেঙে পড়লে নারীদের লুঠ করা হয়েছে সৈনিকদের ভোগে চড়াতে। ইন্টারনেটে মেয়েদের গায়ে দামের চিরকুট সেঁটে খোলা বাজারে বিক্রির ছবিও দেখেছে বিশ্ববাসী। আর এই প্রথাটির সবচেয়ে বড় শত্রু হতে পারে শিক্ষিত মেয়েরা, যারা নিজেদের শিক্ষার আলোতে অপরকেও শিক্ষিত করে তুলতে পারে, এবং এমন নির্মমতার সঙ্গে লড়াই করে একদিন শিকড়গুলো উৎপাটন করতে সক্ষম হবে।
নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত স্বপ্ন দেখেছিলেন- নারীরা সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, রাষ্ট্রের এর্ণধার নারী হবে, বিচারকের আসনে নারী বসবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষা ও যোগ্যতায় নারী সে ক্ষমতার অধিকারী হলেও- সামগ্রিকভাবে এবং সামাজিক অবস্থানগত দিক থেকে নারী কী আদৌ সে মর্যাদা পেয়েছে? এ প্রশ্নটির কাছে আমরা সত্যি নিশ্চুপ।
যদিও আজকের দিনে এ আধুনিকতার বুলি আওড়ানো সমাজের উঠানে দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি ক্ষুধা নিবৃত্তির উপায়স্বরূপ ঘরের বাইরে কর্মক্ষেত্রে নারীকে কাজ দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়েনি। এখনো কন্যার বিবাহ, জমি ক্রয়, ব্যবসায় মূলধন নিয়োগ এসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রয়োগের ক্ষেত্রে নারীর মতামত মূল্যায়ন করা হয় না।
প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও তা প্রকাশে নারী আজও দ্বিধাগ্রস্ত, নিজেকে জাহির করার সুবাদে তাকে তিরস্কার পেতে হতে পারে- সর্বদা এই আশঙ্কায় নারী আজও তার স্বপ্নের কথা প্রকাশ করতে ভয় পায়।
আজও দুঃখ নিয়ে বলতে হচ্ছে ছেলে এবং মেয়ে সন্তানের পৃথক পৃথক ক্ষেত্রে একজন মায়ের মনোভাবেও তার নিজের অজান্তেই সূক্ষ্ম, স্বার্থপূর্ণ বৈষম্যে বিরাজ করে। অথচ মায়ের মনে এ বীজটির বপন কিন্তু আমাদের দুর্ভাগা সমাজেরই সৃষ্টি। শেষ জীবনে ভরণপোষণ এবং অবলম্বনের তাগিদে ছেলে সন্তানকে সুস্থ ও কর্মঠ পুরুষরূপে গড়ে তোলার জন্য তার খাদ্য ব্যবস্থা, পুষ্টি মেয়ে সন্তানের চাইতে সেরাটা হওয়া চাই। অন্যদিকে, মেয়ে সন্তানের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির বিষয়ে গুরুত্ব না দিয়ে বরং তাকে অন্যের সংসারের দায়িত্ব গ্রহণে সক্ষম, নির্যাতন সইবার ধৈর্য অর্জন কিংবা নীরবে সব কষ্ট যন্ত্রণা মেনে নেওয়ার এবং আত্মবিসর্জনের শিক্ষা দেওয়া হয়। অথচ মেয়ে সন্তানটির মানসিক শক্তির বিকাশ করে তাকে সংসারের সমস্ত কষাঘাতের বিরুদ্ধে লড়াই করতে শেখালে হয়তো মেয়ে হয়ে জন্মানোকে অপমানের মনে হতো না ঘরে ঘরে প্রতিনিয়ত বিষয়াভাবে। নির্যাতিত হওয়া লাখো নারীর।
নানা সভা-সমাবেশে শোনা যায় নারীরা এগিয়ে যচ্ছে- নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে উচ্চমহলে বেশ আলোড়ন চলে। নারীর কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর অগ্রাধিকার বাস্তবায়নে সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু সামাজিক মর্যাদায় নারী অনেক পিছিয়ে। বাস্তবিক পক্ষে নারীর স্বকীয়তা ও ধীরশক্তির মূল্যায়ন না করে, বরং তার বিকাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। নারীর কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন তজেও হয়নি।
আন্তর্জাতিক ও জাতীয় বাজারে নারীকে পণ্যের মডেল হিসেবে তুলে ধরছে মিডিয়া। এটাকে নারী স্বাধীনতা বলা যায়? বরং সেলিব্রেটি হওয়ার সুযোগ দেখিয়ে স্বাধীন হওয়ার প্ররোচনা দিয়ে তার অঙ্গসৌষ্ঠব বাড়ানোর জন্য নখ, ঠোঁট ইত্যাদি রঞ্জিত করে, স্বল্পমাপের পোশাক পরিধান করার শর্ত ছুড়ে দেয় একটি ব্যবসায়ী পুরুষমহল এবং রূপের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে অবশেষে নারী হয়ে ওঠে পণ্যের সমতুল্য দর্শনীয় বস্তুতে।
মালিক যেমন শ্রমিকের উৎপাদিত পণ্য নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি নারীর কাজের ফল বা শ্রমের বিনিময়ে উপার্জনের অর্থ, এমনকি নারীর শরীরটাও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নিয়ন্ত্রণ করে। নারী অধিকার নিয়ে সমাজপতিরা যতই বুলি আগুড়াক না কেন:- ভাবতে কষ্ট হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীর গর্ভপাত বা বন্ধ্যাকরণের সিদ্ধান্ত নারীর হাতে থাকে না।
সমাজ এটাও ঠিক করে দেয় নারীর যাতায়াত ব্যবস্থা কেমন হবে। প্রয়োজনের তাগিদে কিংবা সময় স্বল্পতার কারণে কর্মস্থল পৌঁছনোর পথে একজন কর্মজীবী নারী তার পরিচিতজন বা সহকর্মীর বাইকের পেছনে চড়ে বসলে সমাজ কটাক্ষ করে দেখে, অথচ যানবাহনের ভিড়ে যখন কোনো মেয়ে বাস বা টেম্পোতে অধিক যাত্রীর চাপাচাপি সহ্য করে এবা অপরিচিতের শরীরের ঘেঁষাঘেঁষিতে পিষ্ট হয় সমাজ তা মেনে নেয়। অচেনা ব্যক্তির অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ সমাজ মুখ বুজে গ্রহণ করে। সে ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করা মেয়েকে নানা বিব্রতকর প্রশ্নে বাঁখরা হতে হয়। বাক্কাটা ঠিক কোথায় লেগেছে, কেমন করে লেগেছে, ব্যথা পেয়েছে কিনা… এসব তাম্যসাপূর্ণ প্রশ্নের মাধ্যমে সব পুরুষ যাত্রীর উৎসুক দৃষ্টি পড়ে ওই মেয়েটির ওপর। এটা নারীর প্রতি অহরোজ সমাজ প্রদত্ত মানসিক নির্যাতন, যার প্রতিকার হয়নি, হচ্ছে না।
নারী ভিন্ন গ্রহের কোনো প্রাণী নয়, নারী এই সমাজের মা, বোন, কন্যা। নারী মানুষ। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র গঠনে সভ্যতা নির্মাণে ঐতিহ্য সৃষ্টিতে নারীরও আছে সমান সংগ্রাম, শ্রম এবং মেখ। অনেকে ভ্রান্ত ধারণার বশে নারীবাদকে পশ্চিমা এজেন্ডা বা পুরুষের বিরুদ্ধে নারীর প্রাধান্য স্থাপন বলে মনে করে। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক সমাজে নারীর হাতেই ছিল নেতৃত্বের দন্ড।
অর্থনৈতিকভাবে নারীর উন্নয়ন সাধিত হলেও আজ নারীরা দাঁড়িয়ে আছে অপমান, অসম্মানের পিলারে ঠেস দিয়ে।
অথচ সুষ্ঠু সমাজ, জাতি নির্মাণে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ নারীর ভূমিকা অপরিহার্য। সমাজের বোধের জায়গায় নারী সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে হলে পরিবার থেকেই শিক্ষা দিতে হবে অধিকার আদায় করে নারী-পুরুষ বৈষম্য ঘুচাতে লড়াই। করার মানষিকতা অর্জনের। ভাহলে সুদূর ভবিষ্যতে নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণের মতো সামাজিক ক্ষতচিহ্ন নির্মূল সম্ভব হবে। নারীর প্রতি অহিংসা মনোভাব তৈরির মাধ্যমে সমাজের নতুন প্রজন্মকে শিক্ষা দিতে এই সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে। যৌতুক প্রথার চর্চা বন্ধ করতে জনমনে সচেতনতা আনা জরুরি হয়ে পড়েছে।