গৃহশিক্ষিকার ক্ষোভ থেকে শিশুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড
সিলেটের কানাইঘাটের পাঁচ বছর বয়সী শিশু মুনতাহা আক্তারের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে যে তথ্য উঠে এসেছে, তা সমাজে বিরাজমান সম্পর্কের সংকট ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের একটি ভয়াবহ উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবেশী শামীমা বেগমকে চুরির অপবাদ দেওয়ায় যে ক্ষোভ থেকে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে পুলিশ ধারণা করছে, তা আসলে একটি বৃহত্তর সামাজিক সমস্যার দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে পারিবারিক মূল্যবোধের দুর্বলতা, সন্দেহের বিষাক্ত প্রভাব, ও ক্ষমাহীন মনোভাব।
মুনতাহার পরিবার ও শামীমা বেগমের মধ্যে সম্পর্ক ছিল একসময় বন্ধুত্বপূর্ণ, এমনকি মুনতাহার গৃহশিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতেন শামীমা। কিন্তু পারিবারিক সহমর্মিতা ও আন্তরিকতার সেই বন্ধন শীঘ্রই ভেঙে যায় কিছু তুচ্ছ ঘটনা থেকে—যেমন, মুনতাহার পরিবারের কিছু পোশাক হারানো, যা শামীমাদের বাড়িতে পাওয়া যায় এবং এর জেরে শামীমার প্রতি সন্দেহ দানা বাঁধে। এই ধরনের সম্পর্ক ভঙ্গের ক্ষেত্রে ক্ষোভ বা অপমানের প্রতিশোধমূলক প্রতিক্রিয়া যে কতটা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, তা এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে। সামান্য অপবাদ থেকে ক্ষোভ ও বিদ্বেষ জন্মাতে পারে; যার ফলস্বরূপ একটি নিষ্পাপ শিশু প্রাণ হারায়।
শামীমা বেগমের ক্ষেত্রে দেখা যায়, চুরির অপবাদের পর থেকে তিনি ক্রমাগত ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং মুনতাহার পরিবারের ওপর নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকেন। সামান্য অপবাদের জন্য প্রতিশোধের এ মানসিকতা শুধু শামীমা নয়; বরং সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিরাজমান অসহিষ্ণুতার একটি চিত্র তুলে ধরে। ছোটখাটো বিষয়গুলোকে যখন ক্ষমার চোখে দেখা হয় না এবং প্রতিশোধ নিতে চাওয়া হয়, তখন তা মারাত্মক অপরাধের দিকে ধাবিত করতে পারে মানুষকে।
প্রতিবেশী বা সমাজের সদস্যদের মধ্যে সৌহার্দ্য ও বন্ধন সমাজকে সুরক্ষা দেয়, যা এই ঘটনাটি ভেঙে দিয়েছে। এক সময় মুনতাহার পরিবার ও শামীমার মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল এবং এমনকি শামীমার পরিবারকে ঘর তৈরিতে সাহায্য করেছিলেন মুনতাহার বাবা শামীম আহমদ। কিন্তু যে সম্পর্ক একসময় দান ও সহমর্মিতার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল, তা যখন অবিশ্বাস ও সন্দেহের বিষে বিষাক্ত হয়ে যায়, তখন তার ফলাফল হয় ভয়াবহ।
সামান্য আক্রোশ থেকে এমন একটি নিষ্পাপ শিশু, যে কারো ক্ষতি করতে অক্ষম, তাকে হত্যা করা সমাজের মানবিক মূল্যবোধের দুর্বলতাকে তুলে ধরে। একটি শিশু শাস্তির লক্ষ্য হয়ে উঠতে পারে—এটা আমাদের সমাজে শিশুদের নিরাপত্তা এবং তাদের প্রতি মানসিকতার সমস্যাকে প্রতিফলিত করে। এমন সহিংসতা শুধু পরিবারকে নয়, বরং পুরো সমাজকে প্রভাবিত করে এবং একটি তীব্র প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে যে, আমরা কোথায় আছি?
মুনতাহার বাবা শামীম আহমদের বেদনা এই ঘটনা থেকে আরও গভীর। একসময় শামীমাকে ঘর তৈরিতে সহায়তা করেছিলেন তিনি, যা তখন তাদের সম্পর্ককে আরও মজবুত করেছিল। কিন্তু এই সাহায্য ও বিশ্বাসের প্রতিদান হিসেবে এমন নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড যে ঘটবে, তা তিনি কল্পনাও করেননি। তিনি এখন তার সন্তানের হত্যার সুবিচার চান এবং ঘাতকের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবী করেন।
মুনতাহার হত্যাকাণ্ড আমাদের সমাজে বেশ কিছু জরুরি প্রশ্ন সামনে আনে। সামান্য কারণে ক্ষোভ থেকে বড় অপরাধে ধাবিত হওয়া এক ধরণের মানসিক সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্ষমাশীলতা, সহমর্মিতা ও পারস্পরিক আস্থা রক্ষা করা উচিত। নতুবা এ ধরণের ক্ষুদ্র সমস্যাগুলো সহিংস রূপে আবির্ভূত হয়ে উঠতে পারে, যার ফলস্বরূপ সমাজ আরও ভাঙনের দিকে এগিয়ে যায়।
মুনতাহার করুণ মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের ক্ষতি নয়; বরং আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের অভাবের প্রতিফলন, যা আমাদের সবাইকে নতুন করে চিন্তা করতে বাধ্য করে যে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সংহতির দিকে নজর দেয়া এখন কতটা জরুরি।