নারীর সাম্প্রতিক শত্রুগণ
দেশে নারী-পুরুষের অনুপাত প্রায় সমান বললেও অত্যুক্তি হবে না। এরপরও নারী-পুরুষের ভেদাভেদ বা বৈষম্যের কারণে প্রতিনিয়ত সহিংসতা বাড়ছে। নারীর অতি জননীসুলভ আচরণ তাকে নিত্য পারিবারিক, সামাজিক তথা রাষ্ট্রিকভাবে হেনস্তার সম্মুখীন করে তুলছে। নারী যদিও সমাজ গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে কিন্তু নারীর পায়ে পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে শৃঙ্খল! তাকে বিভিন্নভাবে দমিয়ে রাখার অপকৌশলে ব্যস্ত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধিরা! কিন্তু নারীর প্রতি কেন এমন অসিহষ্ণুতা? কেন এ হিংস্র আচরণ! সংক্ষেপে বললে বলতে হয়, এসব আচরণের পেছনে রয়েছে নারীর চিরকালীন কিছু শত্রু। যাদের কৌশলে পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু স্বভাব রয়ে গেছে সেই চিরকেলে।
নারীর প্রতি অসিহিষ্ণু আচরণকে বিশেষভাবে উসকে দেয় ধর্মীয় মোড়লরা! যারা নারীর স্বাধীন জীবনযাপনকে কখনোই সাধুবাদ জানায় না, বরং শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখার সব তদবির করে। এই ধর্মীয় মোড়লদের ফতোয়া অনুযায়ী, নারী উচ্চশব্দে কথা বলতে পারবে না, তার নিজের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না, নারী একা পথে চলতে পারবে না! কিন্তু কেন এ বিভাজন! নারীর বুদ্ধিবৃত্তিক দিকের প্রতি লক্ষ করলে, এর প্রমাণ মিলবে। বরং পুরুষের তুলনায় নারীরা সবদিক থেকে এগিয়ে। শিক্ষা, দেশগঠনে কোথায় নারীর অংশগ্রহণ নেই! তবু নারীর প্রতি একুশ শতক এসেও চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে শেকল। যাকে ধর্ম নাম দিয়ে অনুভূতিতে আঘাত করা হচ্ছে। না মানতে পারলে তার কপালে রাজটিকা স্বরূপ নাস্তিক, বেয়াদব, উশৃংখল আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। নারীর জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা হচ্ছে গোপন লালসার মেটানোর হীন উদ্দেশ্যে। মাঝে মাঝে ধর্মীয় গুরুদের এ সব ভণ্ডামি চোখে পড়ে কবিরাজি প্রথার মধ্যমে! যেখানে ভূত-প্রেত নারীর ওপর ভর করেছে এমনও শোনা যায়। অনেকে ঝাড়-ফুক দেওয়ার পাশাপাশি নারীর দুর্বলতাকে জিম্মি করে শারীরিক সম্পর্কও গড়ে তোলে! এগুলো সবই নারীর প্রতি অশ্রদ্ধা। নারীর জীবনকে বিষিয়ে তোলার ধান্দা।
ধর্মীয় গুরুর পর নারীদের প্রধান শত্রু হলো সমাজপতিরা। তারা নারীদের দমিয়ে রাখতে সদা উদগ্রীব থাকে। নারীর সাফল্যে তারা উচ্ছ্বসিত হয় না। বরং নারীর উন্নতি দেখে কটাক্ষ করে। নারী যখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনের পথে এগিয়ে যায়, সমাজপতিরা তখন সেখানে নানা রকমের বাধা তৈরি করে। বিধিনিষেধ আরোপ করে নারীর চলারপথকে কণ্টকাকীর্ণ করে তোলে।
আজকের দিনে সম্ভবত নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। নারীকে তারা প্রতিনিয়ত ভোগের উপকরণ করে তুলছে। নারী তার আপন সৌন্দর্যে সমুজ্জ্বল। তবু সেই নারীকে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো গায়ের রঙের গুণে বিচার করার প্ররোচনা দিয়ে আসছে। যদিও সম্প্রতি এই প্রবণতার ওপর কিছুটা লাগাম টানা সম্ভব হয়েছে। তবু, নানা রকম প্রতিযোগিতা ছলে, স্মার্টনেস দেখানোর ছলে তারা নারীর মেধা-যোগ্যতা-দক্ষতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কেবল ফর্সা রঙ এবং ত্বকের ঔজ্জ্বল্যকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এভাবে তারা নারীর মেধাকে তুচ্ছ করে তাকে ভোগ্যপণ্যে পর্যবসিত করে তুলছে। এমনকি নারী নিজেও হয়ে উঠছে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি! পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ফাঁদে নারীর জীবনকে এমনভাবে শৃঙ্খল পরানো হয়, যা নারীরা বুঝতেই চায় না অনেক ক্ষেত্রে।
পরিবার থেকে সমাজ—সর্বত্রই নারীকে হয় গৃহবন্দি করে রাখার চেষ্টা চলে, না হয় ভোগ্যপণ্য করে তুলে পৈশাচিক আনন্দ লাভ করে পুরুষতন্ত্র। প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধিরা তাদের লালসা চরিতার্থ করতে নারীকে বশে আনতে চায়। কিন্তু যখন পারে না, তখন নারীর চরিত্রে কালিমা লেপনের চেষ্টা করে।
বর্তমান যুগে নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু মনে হয় একশ্রেণীর মিডিয়া। নারীর রূপ-যৌবনকে পুঁজি করে একটি চক্র নারীকে টাকা কামানোর হাতিয়ার করেছে। নারীও তার পরিচিতি, যোগ্যতাকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে গিয়ে সেই চক্রের হাতে নিজেকে সমর্পণ করছে। ফলে শৃঙ্খল ভাঙতে গিয়ে নারী পতিত হচ্ছে নতুন জটিলতায়!
নারীর শত্রু একশ্রেণীর নারীও বটে। পরিবারের ক্ষেত্রে শাশুড়ি, ননদী এমনকি ছেলের বউও উল্টো তাদের প্রতি রুঢ় হয়ে ওঠে।
সাদাচোখে দেখলে সবই এক শৃঙ্খল যে অপশক্তিকে কাটাতে হলে প্রকৃত শিক্ষার প্রয়োজন। নারীকে শিক্ষা-জ্ঞান ও রুচির চর্চা করার পাশাপাশি নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। এর আগে নারীকেই চিনতে হবে, তার সাম্প্রতিক শত্রু কারা। নারী যেদিন নিজের শত্রু চিনতে পারবে, সেদিন তার পথের বাধা অর্ধেকেই শেষ হয়ে যাবে। বাকি বাধা কাটিয়ে ওঠার জন্য তাকে পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সেই অনুযায়ী কাজ করে যেতে হবে। সেই শত্রু চেনার কাজটা শুরু হোক আজ থেকেই।
অনন্যা/এসএএস