নিষিদ্ধপল্লীর মাটিতেই দুর্গার মৃন্ময়ী রূপ
উমা ঘরে আসছেন। তাই সনাতনী ধর্মাবলম্বীরা ঘর সাজিয়ে তুলেছেন অসংখ্য রঙে। দেওয়ালে নতুন রঙের প্রলেপ পড়তে শুরু করেছে। ঠাকুরবাড়ির উঠোনে দেখা যাবে আলপনা। এখন ঠাকুরদালান নেই। তাই আলপনা থাকে অনেক বারান্দায়। নানা রঙ দিয়ে নকশা কাটছেন নারীরা। নারীর হাতে পূজার আয়োজন গাচ্ছে রূপ। বাড়ির পুরুষরাও অনেক ব্যাস্ত।
যেমনটি ব্যস্ত আছেন মূর্তি বানানোর কারিগররা। উমার মৃন্ময়ী মূর্তি বানানোর জন্যও শিল্পী ব্যস্ত। তার হাতে আস্তে আস্তে প্রাণ গচ্ছেন মহিলাসুরমর্দিনী। তবে দেবীর এই মৃন্ময়ী ঐ মা মূর্তি বানানোর জন্য নিয়ম আছে। মূর্তি বানাতে তো মাটিই লাগে তাইনা? আর দেবির মূর্তি বানাতে হলে তো আবার অনেক বিশুদ্ধ মাটি লাগার কথা। কিন্তু শুনলে চমকে যাবেন, দেবিমূর্তি বানাতে সব মাটি মাটিই যে বিশুদ্ধ এমন নয়। সেখানে মেশানো আছে ‘অশুদ্ধ’ পতিতালয়ের মৃত্তিকা। চমকানোর কিছু নেই। শাস্ত্র মেনেই এই কাজ করছেন শিল্পী।
সমাজের হিসেবে অশুদ্ধ শব্দটা বললে পতিতাপল্লির কথাকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এখানেই তো বাবুরা করেন বেলেল্লাপনা। এখানকার নারীদের চরিত্রও ভালো নয় এমন ধারণাও কি কম? অথচ কতটা নির্যাতিত এই নারীরা তা যেন অনেকেই বোঝেন না। বাবুরা যায় তাদের এক রাতের রক্ষিতা খুঁজতে। তারপর কোনও একটা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ। আর তারপর যা হয়, তা তো বলার নেই। বাবুরা পুরুষমানুষ। তাদের সম্পূর্ণ ‘অধিকার আছে। কিন্তু সেখানকার মেয়েগুলো? লজ্জা নেই! কাপড় খুলে এক এক রাত এক এক জনের সঙ্গে কাটাতে তাদের মানে বাবে না। এমন মেয়েরা তো ‘অশুচি’। এই অশুচি নারীদেরই আবাসস্থলের মাটি লাগে উমার মূর্তি গড়তে।
সমাজ যাদের এভাবে দূরে ঠেলে রেখেছে, আদিশক্তি কিন্তু তাদেরই কাছে টেনে নিয়েছে। তাঁর ত্রিনয়নে সবাই সমান। বলা ভাল, এই ‘অশুচি’ পতিতাপল্লির বেশ্যারা বরং তাঁর নজরে উঁচু স্থানে আছেন। তাই তো দেবীমূর্তি গড়তে অবশ্যম্ভাবী এখানকার মাটি। শাস্ত্রে তেমন বিধানই দেওয়া আছে। বলা আছে, অকালবোধনের সময় মহিষাসুরমর্দিনীকে গড়তে হবে পতিতাপল্লীর মৃত্তিকাতেই। সম্পূর্ণ না হলেও আংশিকভাবে এই মাটি লেগতেই হবে চিন্ময়ীর কাঠামোয়। কিন্তু কেন?
পুরুষ পতিতার বাড়ি গিয়ে যৌনখেলায় মাতে। আর ঠিক সেই কারণেই ই সে তার জীবনের সমস্ত সঞ্চিত পুণ্য সেখানে ফেলে আসে। বদলে পুরুষ সেখান থেকে মুঠো ভরতি করে নিয়ে আসে পাপ। বহু পুরুষের পুণ্যে সেখানকার মাটি পরিপূর্ণ। এক কথায় সমাজকে বিশুদ্ধ রাখতে সাহায্য করে এই ‘অশুদ্ধ’ বণিতারাই। ভাই পুজোর মূর্তি তৈরিতে অনস্বীকার্য পতিতালয়ের মাটি।
তবে এর পিছনে একটি পৌরাণিক কাহিনিও আছে। পুরাণে বলা আছে, ঋষি বিশ্বামিত্র যখন ইন্দ্রত্ব লাভের জন্য কঠোর তপস্যা করছিলেন, তখন তাঁর ধ্যান ভাঙাতে উঠেপড়ে লাগেন দেবরাজ ইন্দ্র। স্বর্গের অব্দরা মেনকাকে তিনি ঋষির ধ্যানভঙ্গের জন্য পাঠান। অব্দরার নাচে বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভেঙে যায়। রাজর্ষির মতো একজনের ধ্যান ভাঙানো খুব একটা সহজ কাজ নয়। দেবরাজ নিজে তা পারেননি। অথচ এক অন্দরা অবলীলায় সেই কঠিন কাজ সম্পন্ন করেন। হোক না স্বর্গের, তবু মেনকা তো আর সতী রমণীর শর্যায়ে পড়েন না।
অকালে মহামায়া মোট ন’টি রূপে পূজিত হন। এই নবম কন্যাই হলেন পতিতালয়ের প্রতিনিধি। অষ্টকন্যার পর শেষ পুজোটি। তাই পায় তারাই। সমাজ যাদের কোণঠাসা করে রাখে সারাবছর, দেবীবন্দনায় তারাই পূজিত হন মানুষের মনে। তবে কারণ যাই হোক, ‘অশুদ্ধ’ নারীদের মাটি দিয়ে যে মূর্তি গড়া, তার সামনেই নতজানু হয় হাজার হাজার হাজার ‘বিশুদ্ধ’ পুরুষ। এ কি কম পাওয়া? প্রতিবছর এভাবেই প্রতিটি বাড়ির বাড়ির ঠাকুরদালানে বা পাড়ার মণ্ডপে হয়ে যায় এক নিঃশব্দ বিপ্লব। সকলকে হারিয়ে, মহিষাসুরমর্দিনীর আশীর্বাদ নিয়ে যুদ্ধজয়ের হাসি হাসেন শুভকাজে ব্রাত্য পতিতারাই। প্রতিবছর।