রোজা পার্কসের একদিন
কখনো শুনেছেন কোনো ব্যক্তির নামে দুটো ভিন্ন দিবস পালন করা হয়? হ্যাঁ, বছরে দুবার রোজা পার্কস দিবস পালন করা হয়। একটি তার জন্মদিন ৪ ফেব্রুয়ারি আরেকটি পুলিশের কাছে গ্রেফতার হওয়ার দিন, ১ ডিসেম্বর। রোজা লুইস ম্যাকলি পার্কস – যিনি কিনা আন্দোলনের বারুদে আগুন জ্বালিয়েছেন। হয়েছেন অবিস্মরণীয়।
যুক্তরাষ্ট্রের এই মানবাধিকারকর্মীকে ইউনাইটেড স্টেট কংগ্রেস ‘দ্য ফার্স্ট লেডি অব সিভিল রাইটস’ এবং ‘মাদার অব দ্য ফ্রিডম মুভমেন্ট’ হিসেবে আখ্যা করেছেন। কিন্তু কি এমন করেছিলেন যে তাকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হতে হলো? আর গ্রেফতার হলেই বা ইতিহাসের অংশ হিসেবে তার নাম লেখা হবে কেন? আত্নমর্যাদাবোধে বলীয়ান এই নারীর ইতিহাস জানলে অন্তত বুঝতে সুবিধা হবে।
অ্যালাবামা স্টেটেরই একটি শহর মন্টেগোমারি। ১৯০০ সালে এই শান্তশিষ্ট শহরে এক বিশেষ আইনের প্রনয়ন করে স্থানীয় সরকার। অন্তত আধুনিক সময়ে আইনটি অনেকের হাসির খোরাকও হতে পারে। মূলত বাসের আসন বিন্যাস নির্ধারণ করা নিয়ে একটি আইন প্রণয়ন করা হলো।
![](https://a.kha.icu/wp-content/uploads/2022/05/14-1024x576.jpg)
আইনটিতে বলা হলো শহরের সকল গণপরিবহনে যাত্রীদের আসনবিন্যাস এখন থেকে জাতিগত পার্থক্য অনুযায়ী নির্ধারিত হবে। বড় হর্তাকর্তাদের মাথায় কি ছিলো কে বলতে পারে!
এই অদ্ভুত আইনের ফলে বাস কন্ডাকটরদের হাতে ব্যাপক ক্ষমতা। তারা সুবিধামতো বাসের সিটগুলোকে শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গদের জন্যে আলাদা করে দিতে পারবে। এতে বর্ণবিদ্বেষ কিছুটা হলেও কমার কথা তাইনা? অন্তত এভাবে সকলেই যাতায়াতের সুযোগ সুবিধা সমানভাবে পেতে পারে। আদপে ব্যাপারটি এমন না।
তখন প্রায় সকল গাড়িচালকই ছিলো সাদা চামড়ার। যেহেতু আইন অনুযায়ী ক্ষমতা তাদের হাতে তাই তারা একে কঠোরভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করলো। তারা দুটো বর্ণের মানুষদের আলাদাভাবে বসানোর চেষ্টা করলো। আর শ্বেতাঙ্গদের বরাদ্দকৃত আসন ভরাট হয়ে গেলে তারা কৃষ্ণাঙ্গদের আসন থেকে উঠে যেতে বাধ্য করতো।
আইন অনুযায়ী প্রত্যেক বাসের প্রথম চার সারির প্রথম দশ সিটে সাদা চামড়ার মানুষ বসবে। আর একেবারে পেছনের থেকে শুরু করে চার সারির দশ সিটে বসবে কৃষ্ণাঙ্গরা। এদিকে মাঝের ষোলটি সিটেই শুরু হলো বর্ণবাদ। তারা নিয়ম করে মাঝখানের সামনের অংশ সাদা চামড়ার মানুষদের আর পিছনের অংশ কৃষ্ণাঙ্গদের।
![](https://a.kha.icu/wp-content/uploads/2022/05/11-1-1024x576.jpg)
তারা এই কাজের সুবিধার্থে একটা বোর্ড বানিয়ে নিয়েছিলো। তারা সুবিধামতো জায়গায় বসিয়ে সাদাদের আসন চিহ্নিত করে দিতো। যাত্রীদের আসন পূর্ণ হয়ে গেলে সুবিধামতো এই চিহ্ন পিছিয়ে আনা হতো। তাতে সাদাদের সারি আবার চিহ্নিত করে দেয়া হতো।
কখনো বাস সম্পূর্ণ শ্বেতাঙ্গ দিয়ে ভরাট হলে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে সবার প্রথম সারির চারজনকেই আসন ছেড়ে দিতে হতো। সাদা আর কালো কি আর পাশাপাশি বসতে পারে!
যদি তাতেই শেষ হতো তাহলে তো হতোই। একেবারে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকার কষ্ট তো আছেই। আবার শ্বেতাঙ্গদের জন্যে বরাদ্দ মাঝখানের জায়গা ভরাট হলে সেই রাস্তা দিয়ে কালোদের হেটে যাওয়াও নিষেধ। তাই বাসে উঠতে হলে প্রথমে সামনের দরজা দিয়ে ভাড়া চুকিয়ে আবার পেছনের দরজা দিয়ে উঠতে হতো। এমনও হয়েছে ভাড়া দিয়ে পেছনে উঠবার আগেই ড্রাইভার বাস ছেড়ে দিতো। এ নিয়ে আন্দোলন চলছিলো। তবে দাবী পূরণ হচ্ছিলো না।
পটভূমি জানা গেলো। তবে ইতিহাসের পটভূমিকা বদলাবে আরো পরে। ১৯৪৩ সালের ঘটনা। বৃষ্টি পড়ছিলো তাই বাসে উঠে তিনি ভাড়া চুকিয়ে ভেতর দিয়েই হেটে যেতে চাইলেন। বাসের ড্রাইভার জেমস এফ ব্লেইক সাফ জানালেন অমনটা করা সম্ভব না। তাকে এই বাসে চড়তে হলে পেছন দরজা দিয়েই উঠতে হবে। তিনি যেই পেছনের দরজা দিয়ে উঠতে যেতেই ব্লেইক বাস ছেড়ে দেয়। এবার বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই তিনি অপেক্ষা করছেন। তখন থেকেই সম্ভবত ভেতরে জমে উঠেছিলো এক আগুন। যেটা ফুটবে আরো পরে।
![](https://a.kha.icu/wp-content/uploads/2022/05/15-1024x576.jpg)
ঠিক এক যুগ পর, অর্থাৎ ১৯৫৫ সালে বর্ণবিদ্বেষের শিকার হয়ে অনেক কালো মারা গিয়েছিলেন। মে মাসে কালোদের অধিকার আদায়ের নেতা জর্জ ওয়াশিংটন লি’কে হত্যা করা হয়। আগস্টে মারা যান আরেক কর্মী ল্যামার স্মিথ। ওই মাসেই ১৪ বছরের এক কিশোর এমেট টিলকে বাজেভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
নভেম্বরের ২৭ তারিখেই রোজা পার্কস মন্টেগোমারিতে কৃষ্ণাঙ্গদের এক সমাবেশে অংশ নেন। সেখানেই তিনি তাদের প্রতি হওয়া অন্যায়ের গল্পগুলো শুনতে পান। তার ঠিক চারদিন পর সন্ধ্যায় তিনি কাজ শেষে বাসের অপেক্ষা করছেন। তখন মন্টেগোমারি সিটি লাইন কোম্পানির এক পুরো বাস হেলতেদুলতে এগিয়ে এলো। বাসে উঠে ভারা মিটিয়ে তিনি বসলেন পেছনের পঞ্চম সারির এক সিটে।
হিসেব অনুযায়ী তিনি সেখানে বসতেই পারেন। তবে এই বাস চালাচ্ছিলেন সেই জেমস ব্লেইক। যাহোক, বাস এগিয়ে চলে। এক সময় শ্বেতাঙ্গদের সব সিট পূরণ হয়ে যায়। ব্লেইক লক্ষ্য করলো শ্বেতাঙ্গদের বসার জায়গা নেই। সে দ্রুত সিট চিহ্নকারী বোর্ডটি এগিয়ে দিলেন। হাত নাড়িয়ে জানালেন সবাইকে উঠে পড়তে হবে।
![](https://a.kha.icu/wp-content/uploads/2022/05/16-1-1024x576.jpg)
পাশের তিনজন উঠে গেলেও রোজা ঠায় বসে রইলেন। ব্লেইক ভীষণ রেগে গেছে। সে হুমকি দিলো সে উঠে না বসলে পুলিশ ডাকবে। কিন্তু রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তার কি অধিকার আছে তা নিয়ে প্রশ্ন করছিলেন তিনি।
ব্লেইক পুলিশ ডাকে এবং পুলিশ এসে রোজাকে গ্রেফতার করে। তিনি আইন ভাঙেননি। তাও এই অমানবিক আসনবিন্যাসের আইন ভাঙার অপরাধে তার নামে মামলা করা হয়। তবে পার্কসের বন্ধু ক্লিফোর্ড ডার এবং এডগার নিক্সন তাকে ছুটিয়ে আনেন। ক্লিফোর্ড ডার এক সাদা চামড়ার আইনজীবী। তবে তিনি পার্কসের আইনজীবী হিসেবে একদিন লড়াই করবেন।
পার্কসের এই গ্রেপ্তারের ঘটনা যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিলো। কৃষ্ণাঙ্গ নেতারা সিদ্ধান্ত নিলেন বাস বয়কট করবেন। এরইমাঝে উইম্যান পলিটিক্যাল কাউন্সিল ৩৫০০০ হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে নিয়েছে। ডিসেম্বরের ৪ তারিখ কালোদের চার্চে সমাবেশ করে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।
তার পরদিন আইন ভঙ্গের দায়ে রোজাকে ১৪ ডলার জরিমানা করা হয়। তবে রোজা পালটা মামলা করে এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করেন। সোমবার বয়কটের আন্দোলন শুরু। যাতায়াতের জন্যে কালোদের চালানো ক্যাবে করেই সবাই যাতায়াত করে। অনেকেই হেটে যাতায়াত করেন।
![](https://a.kha.icu/wp-content/uploads/2022/05/12-1024x576.jpg)
প্রথমদিন বয়কট কর্মসূচী সফল। তবে দীর্ঘমেয়াদ নিয়ে সকলেই চিন্তায় পড়লেন। বয়কট চলছে। ক্যাবগুলো ১০ পয়সা করে ভাড়া নেয়। এজন্যেই আইন করা হলো ক্যাব চালক ৪৫ পয়সার কম নিতে পারবে না। স্থানীয় প্রশাসন এই আন্দোলন থামাতে অনেক চেষ্টা চালায়। তবে আন্দোলন চলতে থাকে।
একটানা বয়কটের ফলে বাসগুলো একদম অচল হয়ে যায়। টানা ৩৮১ দিনের এই আন্দোলন অবশেষে সফল হয়। নতুন আইন অনুযায়ী যে কেউ যে কোনো সিটে বসতে পারবে। পার্কসের এই গ্রেপ্তারের ঘটনাকে মূল কারণ না বললেও মূল প্রভাবক বলতেই হবে।
পার্কস ওইদিন এমন আচরণ না করলে কি আন্দোলন এমন বেগবান হতে পারতো? ছাড় দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে রোজা পার্কস হয়ে উঠেছিলেন সাহসী। আর তাতেই ইতিহাস মোড় নিলো অন্যদিকে। নতুন রূপে।