জদ্দানবাই বাইজি থেকে চলচ্চিত্র জগতের মহীরুহ
কিন্নরীকণ্ঠ বাইজি জদ্দানবাই। জদ্দানবাইয়ের জন্ম ১৮৯২ সালে ইলাহাবাদের চিলবিলায়। তার মা দিলীপাবাই সে কালের নামকরা এক বাইজি। প্রথমে মায়ের কাছেই তালিম শুরু হয়া জন্মনের। শোনা যায়, প্রথম প্রথম আসরে গজল গাইলেও তার গায়কি ছিল অপরিণত পরবর্তীতে তিনিই হয়ে ওঠেন মহীরুহ।
তার সময়ের প্রেক্ষিতে জম্মান ছিলেন অনেকটাই প্রগতিশীল এবং সাহসী প্রকৃতির। তিনি ছিলেন সাহসী, অথচ সহানুভূতিশীল এক শিল্পী। পরবর্তীকালে গওহর ছাড়াও বহু বাইজির দুঃসময়ে তিনি পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বিভিন্ন সময়ে অভাবী, গরিব মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
গওহরজান তখনো বাইজি সমাজে মুকুটহীন সম্রাজ্ঞী। তবে আগ্রার মালকাজান, ইলাহাবাদের জানকিবাই ছঞ্জনচুরি, বারাণসীর হুসনাজান, ওয়াজিরজান কিংবা লখনউর লাডনিজান তখনো মাহফিল মাতাচ্ছেন। তাদের চাহিদা ছিল আকাশছোঁয়া। বাইজিদের দাবি মিটিয়ে মেহফিলে হাজির করানোটাও মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। তাই সঙ্গীতরসিক শ্রোতাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হত তাদের আসরে আনতে। এমনই প্রেক্ষাপটে কলকাতার সংগীতের আসরে আত্মপ্রকাশ এক নবাগতা বাইজির। যেমন রূপসি, তেমনই তার দাপুটে গলা। তার ঠুমরি, দাদরা, গজলে মেতেছিল সে কালের বাবুসমাজ।
দমদমে মল্লিকবাড়ির এক শরিকের একটি বাগানবাড়ি ছিল। সেখানে মাঝে মধ্যেই বসত সঙ্গীতের আসর। তেমনই এক আসরের আয়োজন করছেন মল্লিকবাবু। কিন্তু সে বার বহু চেষ্টা করেও গওহরজানকে মাহফিলে আনতে পারবেন না। অন্য একটি আসরের জন্য গওহর গিয়েছেন কলকাতার বাইরে। ইতিমধ্যেই কলকাতার সঙ্গীতমহলে বেশ নাম করেছেন জন্দান। গওহর কিংবা মালকার মতো মোহময়তা না থাকলেও জন্দান আসর মাতাতেন তার কন্ঠের জাদুতে। বন্ধু আশুবাবুর মুখে জন্দানের ভুরিভুরি প্রশংসা শুনে মল্লিকবাবু তাকে মাহফিলে আমন্ত্রণ করলেন বটে, কিন্তু তার মনের মধ্যে একটা সংশয় ছিলই। আদৌ অতিথিদের গান শুনিয়ে মন ভরাতে পারবে তো জন্দান?
আসরের রাতে একে একে উপস্থিত হলেন সঙ্গীতরসিকেরা। নাচঘরের মেঝেতে পাতা পারস্যের দামি কার্পেট। ঘরের ঠিক মাঝখানে বসে গান গাইবেন জদ্দান। চার পাশে অতিথিদের বসার আয়োজন। ভিক্টোরিয়ান আসবাবে সুসজ্জিত নাচঘরের ঠিক মাঝখানে দেওয়ালে সুবৃহৎ বেলজিয়াম কাচের আয়না। ততদিনে শহরে পৌঁছে গিয়েছে বৈদ্যুতিক আলো। কড়িকাঠ থেকে ঝুলছে বেলজিয়াম কাচের রঙিন ঝাড়। দেওয়ালগিরির জোরাল্যে আলোর ঝলমল করছে মল্লিকবাবুর শখের নাচঘরটি। ফুলদানিতে রাখা গোছা গোছা রজনিগন্ধা আর আতরের সুগন্ধ এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি করেছে। হঠাৎ এক মোসাহেব খবর দিলেন জন্দান এসেছেন। একটু পরেই অতিথিদের নাকে এল দামি রুহি-গুলাবের সুবাস । সেই সঙ্গে আসরে প্রবেশ করলেন জন্দানবাই। ফর্সা গায়ের রং, কিছুটা লম্বা অথচ সুশ্রী মুখে স্মিত হাসি। পরেছিলেন হিরে, পান্নার গয়না। তাকে দেখেই হইহই করে উঠলেন আশুবাবু। মল্লিকবাবু অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইলেন।
রাত দশটা নাগাদ আসরে সকলকে ‘আদাব’ জানিয়ে সারেঙ্গীবাদক ও তবলচিকে ইশারা করে জদান ধরলেন একটি খেয়াল। রূপ যৌবন গুণ ধরো রাহত হাম.. এমন দাপুটে গলা সে কালের বাইজিদের মধ্যে বড় একটা শোনা যায়নি। অথচ কী অনায়াসে সুর বিস্তার করতেন তিনি। গান শুনতে শুনতে কেমন আনমনা হয়ে পড়লেন মল্লিকবাবু। এর পরে জন্মান ধরলেন একটি ঠুমরি। একে একে দাদরা, গজল গেয়ে ভোররাতে ভৈরবীতে তিনি ধরলেন সন্ত কলজেয়া মে চোট’ গানটি। শ্রোতারা সুরের মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। অনেকেরই মনে হল, আসরটি যেন বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। অথচ তার রেশ ছিল দীর্ঘস্থায়ী। আর মল্লিকবাবু? নিজের সংশয়ের কথা ভেবে তিনি বেশ লজ্জিত বোধ করেন। জীবনে বহু বাইজির গান শুনলেও এমন তুপ্তি তিনি আগে কখনো পাননি। তার চোখের কোণে তখন জলা এমনই একের পর এক আসরে গান গেয়ে শ্রোতাদের মন জয় করেছিলেন জদ্দান। গত শতকের বিশ এবং তিরিশের দশকে গজল, ঠুমরি, দাদরার এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী ছিলেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, পরবর্তী জীবনে তিনিই হয়ে ওঠেন চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী, কাহিনিকার, প্রযোজক এবং সঙ্গীত পরিচালক।
তার সমসাময়িক ছিলেন
বারাণসীর বিদ্যাধরীবাই, বড়ি মতিবাই, কৃষানাই, কমলেশ্বরীবাই, রাগরানি দুর্গাবাই, রসুলনবাই, কাশীবাই, সিদ্ধেশ্বরী দেবী এবং কেশরবাই কেরকর। তবে সেই সময়ে আরও দুইজন জন্দানের খোঁজ পাওয়া যায়। তারা হলেন লখনৌয়ের ছোটি জদ্দান এবং জন্ম্মানজান।
দিলীপানাই সে কথা বুঝতে পেরে মেয়ের তালিমের ব্যবস্থা করেন স্থালিয়রের ভাইয়া গনপত রান্ড সাহেবের কাছে। তার মৃত্যুর পরে বোলবানাও ঠুমরির প্রবাদপ্রতিম মওজুদ্দিন খানের কাছে। এ ছাড়াও জন্দান তালিম নেন হচ্চু খান এবং লাভ খান সাহেবের কাছে।
এরপরে খুব অল্প সময়ের মধ্যে জন্মানের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল দেশ জুড়ে। রাজশাসিত স্টেটগুলির মাহফিলে মাঝেমধ্যেই তার ডাক পড়ত। এর মধ্যে বিকানের, রামপুর, গ্বালিয়র, কাশ্মীর, ইনদওর এবং জোধপুরে তার আসরের স্মৃতি আজও ইতিহাসের পাতা থেকে উঁকি দেয়। পরবর্তী সময়ে বেতারেও নিয়মিত গান
গাইতেন জন্দান।
তার জীবনের বড় একটা অংশ কলকাতায় কাটিয়েছেন জন্মদান। সে কালের শোভাবাজার রাজবাড়ি, চোরবাগান শীলবাড়ি, গোস্তা রাজবাড়ির পাশাপাশি বহু সঙ্গীতরসিকের বাড়িতে বসেছে তার গানের আসর। জদ্দান প্রথমে থাকতেন বৌবাজারে, পরে বেলেঘাটায়। এ শহরের আনাচে-কানাচে মিশে আছে তার কত স্মৃতি। গওহরজানের সঙ্গে জন্দানের সুসম্পর্ক ছিল। যদিও গওহর ছিলেন তার চেয়ে প্রায় কুড়ি বছরের বড়। অবসরে। একে অপরের বাড়ি যেতেন, গান, রাগ-রাগিণী, কবিতা, সাহিত্য নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনাও হত। সে সময়ে জদ্দান থাকতেন বৌবাজারে। প্রবাদপ্রতিম শিল্পী লালচাঁদ বড়ালের ছোট ছেলে রাইচাঁদ মাঝেমধ্যেই সেখানে আসতেন জন্মদানের সঙ্গে সঙ্গত করতে। আসলে ঠুমরির সঙ্গে তবলা বাজানোর কিছু নিয়ম। আছে। একবার বারাণসীতে এক শিল্পীর ঠুমরিতে সঙ্গত করতে গিয়ে মাত্রাগত পদ্ধতি নিয়ে রকমফের দেখা দেওয়ায় রাইচাঁদ প্রায় ঠিকই করেছিলেন, ঠুমরির সঙ্গে তবলা বাজাবেন না। এই নিয়ে জদ্দানের সঙ্গে তার মতান্তর হয়েছিল। তাই জন্মদানের সঙ্গে সঙ্গত করে রাইচাঁদ সে বিষয়ে একটা স্পষ্ট ধারণ্য গড়ে তুলতে চাইছিলেন।
তেমনই একদিন রেওয়াজ চলছে, হঠাৎ দারোয়ান এসে খবর দিল গওহরজান এসেছেন। শুনেই চমকে উঠলেন রাইচাঁদ। তার মনে পড়ে গেল পুরোনো একটি ঘটনা। যা ভেবে তিনি অত্যন্ত লজ্জিতবোধ করলেন। হঠাৎই তবলা ছেড়ে তিনি পাশের ঘরে গিয়ে বসলেন। সে ঘরেই ছিলেন জন্মদানের স্বামী মোহনবাবু। দইজনে কথাবার্তা চললেও রাইচাঁদের কান দুটি সজাগ ছিল পাশের ঘরে গণ্ডহরের সঙ্গে জন্মদানের কী কথাবার্তা হচ্ছে, তা শোনার জন্য। মনে মনে রাইচাঁদ ভাবছিলেন, গওহরজান বিদায় নিলে আবার ঘরে গিয়ে তবলা নিয়ে বসে শুরু করবেন। রেওয়াজ। এমন সময়ে হঠাৎ পাশের ঘর থেকে গওহরজানের গনা ভেসে এল। তিনি জদ্দানকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘গান- বাজনা হচ্ছিল বুঝি? অসময়ে এসে বিরক্ত করলাম না তো? জদ্দান বললেন, ‘না না, একটু রেওয়াজ করছিলাম।’ তখন গওহর বললেন, ‘তা থামল কেন? আমিও তা হলে একটু গান করি।’ এতে জন্দান উৎসাহিত হয়ে বললেন, ‘সে তো খুব ভাল কথা। তবে একজন মেহমান আছেন, আমি তার সঙ্গে সঙ্গত করছিলাম। তিনি বলছিলেন, দীপচন্দী সাতমাত্রা আর গত আটমাত্রা। ঠুমরির সঙ্গে মাত্রার ব্যবহার যতক্ষণ বুঝতে পারছেন না, বাজাবেন কী করে? এ কথা শুনে গওহর বললেন, ‘উনি তো। ভুল বলেননি।’ এর পরে জন্মান বললেন, ‘তাকে ডাকলে তোমার আপত্তি নেই তো?’ গওহরের উত্তর, ‘না না, তাকে ডাকো।
এবার রাইচাঁদকে সেই ঘরে আসতে অনুরোধ করলেন জন্দান। শুনে রাইচাঁদ কী করবেন ভেবে পেলেন না। একবার ভাবলেন। পিছনের দরজা দিয়ে পালাবেন। ইতোমধ্যেই জদ্দান ঘরে ঢুকে বললেন, কই রাইসাহেব, আপনার সঙ্গে আমার সহেলির পরিচয় করিয়ে দিই। ‘কথা শেষ করতে না করতেই জদ্দান প্রায় হাত ধরে টেনে রাইচাঁদকে সে ঘরে নিয়ে এলেন।
তাকে দেখেই গওহরজান চেচিয়ে উঠলেন, আরে খোকাবাবু, তুমি এখানে? আমাকে দেখে তুমি পালিয়ে গেলে কেনা’ রাইচাঁদ কেমন একটু আড়ষ্ট হয়ে ছিলেন। বললেন, শিখছিলাম, তাই। জন্দান বেশ অবাক হয়েই গওহরকে বললেন, ‘রাইসাহেবকে তুমি চেনো নাকি?’ গওহর সম্মতি জানিয়ে বললেন, ‘উনি তো লালবাবুর ছেলে।
এর পরেই রাইচাঁদ গওহরকে বললেন, ‘সে দিনের ঘটনার জন্য লজ্জায় পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। ‘গওহর কিছুটা অবাক হয়েই জানতে চাইলেন, কোন ঘটনা। রাইচাঁদ মনে করিয়ে দিলেন, তার মামার বাড়ি অর্থাৎ জোড়াসাঁকোর মল্লিকবাড়িতে বিয়ে উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানে অন্দরমহলে গওহর গান গাওায়ার সময়ে তার মা এমন একটি কাজ বাধিয়েছিলেন… আসলে ঘটনাটিতে গওহর অপমানিত হয়েছিলেন। সে কথা গুনে গওহর হো হো করে হেসে উঠে বললেন, ‘এই দ্যাখো, তুমি আবার সে দিনের কথা মনে রেখেছ?’ রাইচাঁদ মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলেন। গওহর একটু উদাস হয়েই বললেন,’ও সব কথা আমরা মনে রাখি না। মনে রাখলে বাইজিদের চলে না। ‘এরপরেই জন্মান সেই অস্বস্তিকর পরিবেশকে স্বাভাবিক করতে গানের আসর শুরু করলেন। আর তবলায় সঙ্গত করলেন রাইচাঁদ। কঠিন পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তার।
তবে তার সমকালীন শিল্পীদের চেয়ে জন্দানবাইয়ের রেকর্ডের সংখ্যা ছিল অনেক কম। কলম্বিয়া, টুইন, মেগাফোন এবং ব্রডকাস্ট রেকর্ড কোম্পানি থেকে তার কিছু রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল। সেগুলির বহুসংখ্যক কপিও বিক্রি হয়েছিল। ভার গাওয়া গানগুলির মধ্যে ‘তোড় লাই রাজা, যমুনয়াকে’, ‘সপ্ত করেজবা মে’, ‘মুক্তাচি হ্যায় ঘামে’, ‘কানহা তেরা’, ‘গ্যয়া বালম পরদেশী’, ‘রূপ যৌবন গুণ ধরো রাহত হাম’, ‘দেব দেব সৎসঙ্গ, জেরা নয়নো সে নয়না মিলাবিশেষভাবে উল্লেল্লখযোগ্য।
জন্দানের ব্যক্তিগত জীবন ছিল নানা ঘাত-প্রতিঘাতে ভরা। তিন বার বিয়ে করেছিলেন জন্দান। তার প্রথম স্বামীর নাম ছিল নরোত্তম দাস ক্ষেত্রী। ধর্মান্তরিত হয়ে তার নাম হয়েছিল নাজির মহম্মদ। তাদের একটি ছেলে হয়, যার নাম আখতার হুসেন। এর পরে জন্দান বিয়ে করেন ইরশাদ মীর খানকে। তাদেরও একটি ছেলে হয়, যার নাম আনোয়ার হুসেন। তার তৃতীয় স্বামী মোহনচন্দ উত্তমচন্দ ত্যাগী। তিনি ‘মোহনবাবু’ নামে বেশি পরিচিত। মোহনচন্দ এক ধনী পরিবারের সন্তান। ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছে ছিল ভার। সেই মতোই ইংল্যান্ড যাওয়ার কথা ছিল মোহনবাবুর। সেখানে গিয়ে মেডিসিন নিয়ে পড়বেন বনে ঠিক করেছিলেন। সেই সময়ে দেখা হয় জন্দান বাইয়ের সঙ্গে। মেলামেশা এবং ঘনিষ্ঠতা খানিক বাড়তেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেছিলেন জদ্দান বাই নিজেই। সঙ্গে সঙ্গে রাজিও হয়ে যান মোহনবাবু। জদ্দানের আগের দুইটি বিয়ের কারণে মোহনবাবুর পরিবার জন্দানের সঙ্গে তার বিয়েতে মত দেয়নি।
জন্দানবাইকে বিয়ে করার জন্য মোহনবাবু নিজের ধর্ম পরিবর্তন করেছিলেন। তবে শুধু ধর্মই নয়, পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়েও বিয়ে করেছিলেন জন্মদানবাইকে। মোহনের এই সিদ্ধান্ত মেনে নেননি তার পরিবারের সদস্যরা। তবে কোনো কিছুকে তোয়াক্কা না করেই তিনি জন্দানকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার পরে তার নাম হয় আবদুল রাশিদ। তাদের দাম্পত্য জীবন ছিল সুখের। তাদের মেয়ে এসিদা ফাতিমা। তিনি পরবর্তী কালে হয়ে ওঠেন চলচ্চিত্রের প্রবাদপ্রতিম অভিনেত্রী নার্গিস।
৩৮ নম্বর বদন রায় লেনের বাড়িটায় এক সময়ে থাকতেন সপরিবার জদ্দান। সাজিয়েছিলেন তার সুখের সংসার। সেখানেই ছিল তার শখের সুসজ্জিত নাচঘরটি। শোনা যায়, তার বাড়িতে ছিল একটি পোষ্য বাথ। তাই সচরাচর তার বাড়িতে কেউ প্রবেশ করত না। রাতে বাঘের ডাকে আশপাশের অনেকেরই ঘুম হত না। তাই সে অঞ্চলে লোকে তাকে ‘গর্জনবাই’ বলে ডাকত। এ বাড়িতেই ১ জুন ১৯২৯ জন্ম হয় রসিদা ফাতিমার। ভার ছোটবেলা কেটেছিল এই কলকাতায়। তিনি ভাল সাঁতারু ছিলেন। ১৯৩৩-৩৪ নাগাদ জদ্দান কলকাতা ছেড়ে মুম্বই পাড়ি দেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই একটু একটু করে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বদলাতে থাকে। তিরিশের দশক থেকেই নাচঘরের রোশনাই ক্রমশ নিভু নিভু। কমতে থাকল সমঝদার পৃষ্ঠপোষকের সংখ্যাও। এর পাশাপাশি যৌথ প্রচেষ্টায় শুরু হয়েছে সঙ্গীত সম্মেলনের এক নতুন অধ্যায়। তাই রাজশাসিত কিছু স্টেটে এবং নাচঘরে সীমিতসংখ্যক শ্রোতার সামনে গান গেয়ে অর্থ রোজগারের পথ ক্রমশই কঠিন হয়ে পড়ছিল। তাছাড়া দ্রুত বদলে যাচ্ছিল শ্রোতাদের রুচিও।
ইতিমধ্যেই সবাক হয়েছে চলচ্চিত্র। কলকাতায় জন্দানের সঙ্গে পরিচয় হয় লাহৌরের চলচ্চিত্র প্রযোজক হাকিম রামপ্রসাদের। তিনি জন্দানকে তার নতুন ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। ফলে ১৯৩২ সালে জন্মদান লাহৌরের প্লে আর্ট ফটোটোন কোম্পানিতে যোগ দেন। পরের বছর মুক্তি পায় ‘রাজা গোপীচন্দ’ ছবিটি। এক নতুন অধ্যায়। সে সময়ে জন্দানের বয়স চল্লিশ। পরে জন্দান করাচির এক চিত্রসংস্থার ‘ইনসান ইয়া শয়তান’ ছবিতেও অভিনয় করেন। এ ছাড়া ‘প্রেম পরীক্ষা’, ‘সেবাসদন’ ছবিতেও অভিনয় করেন। ভারতের প্রথম নারী সঙ্গীত পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম জদ্দান। ১৯৩৪ সালে তিনি শুরু করেন ভার নিজের চলচ্চিত্র সংস্থা সঙ্গীত মুভিটোন। ‘তলাশ-এ-হক’ ছবির কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন স্বয়ং জন্দান। এর পরে একে একে ‘হৃদয় মন্থন’, ‘মরডাম ফ্যাশন’, ‘জীবনস্বল্লা’, ‘মোতি কা হার’, ‘অম্লমান’, দারোগাজি’ ছবিগুলি মুক্তি পায়, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে জন্মদানের নাম। এতে জন্দান মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন। শুক্ত হয় জীবনের নিজের জীবদ্দশাতেই জন্মদান মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্র জগতের এক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত রুচিশীল। তার আদবকায়দা, কথাবার্তা এবং ব্যক্তিত্ব তাকে স্মরণীয় করে রেখেছে। উর্দু, ফারসি, আরবি ছাড়াও হিন্দি ও বাংলা ভাষায় তিনি ছিলেন সাবলীল। অবসরে সাঁতার কাটতেন, লং ড্রাইভে যেতেন এবং টেনিস খেলতেন। কর্মক্ষেত্রে এবং ব্যক্তিগত জীবনের জটিল পরিস্থিতিতে ইতিবাচক মীমাংসায় জন্দান ছিলেন এফ।
কলকাতা ছাড়ার পরে গান গাওয়া আর অনুষ্ঠান করাও কমিয়ে দিয়েছিলেন জন্মান। মুম্বাইয়ে স্বামী ও মেয়েকে নিয়ে নতুন সংসার শুরু করেন। অনেকেই মনে করেন, নিজের মেয়ের জীবন সুরক্ষিত করতেই জদ্দান কলকাতা ছেড়েছিলেন। মা হিসেবে জদ্দান ছিলেন অত্যন্ত যত্নশীল। তিনি কখনো চাননি যে, মেয়ে বাইজি হোক। মুম্বইয়ে মেয়েকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। সব সময়ে তাকে চোখে চোখে রাখতেন। এমনকি তার অনুমতি ছাড়া কেউ নার্গিসের সঙ্গে দেখাও করতে পারত না। এই নিয়ে একটি ঘটনা শোনা যায়।
একবার সেলিম নামে নবাবের পরিবারের এক সদস্য মুম্বাইয়ে জন্দানবাইয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন নার্গিসের সঙ্গে দেখা করার জন্য। গিয়ে দেখেন জন্দানবাই সুপুরি কাটছেন। জন্মদান তাকে দেখে অম্লর্থনা করণেও অত্যন্ত ভদ্র ভাবে জানালেন, নার্গিস অসুস্থ। ডাক্তার তাকে বিশ্রাম নিতে বলেছেন। তবে সেলিমও কথা বলতে বলতে সেলিমকে বলেন, দেশের সব রাজা নবাবদের তিনি আপাদমস্তক নাছোড়বান্দা এর পরে জন্দান এ কথা সে।
চেনেন।
অতএব, সে যাত্রা দেখা না হলেও পরে সেলিম নার্গিসের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। জন্মদানের চোখের আড়ালে, তবে বাড়িতে নয় স্টুডিওতে। নানা কারণে ১৯৪৮ সালটা জন্মদানের জীবনে ছিল বড়ই বিয়োগান্তক। হঠাৎই মোহনবাবু মারা গেলেন। তার কয়েক মাস পরেই চলে গেলেন জদ্দান। সুরের আকাশে যেন এক নক্ষত্র পতন ঘাটলা আর বেলেঘাটার বদন রায় লেনের সেই বাড়িটি? অমিত ধরের একটি লেখা থেকে জানা যায়, জন্দানের সেই শখের বাড়িটিতে এখন প্রতিবন্ধী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। জন্ম্মানের মেয়ে নার্গিস বাড়িটি পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়কে দান করেছিলেন। তবে সেই দানে একটি শর্ত ছিল। বাড়িটি প্রতিবন্ধী কল্যাণে ব্যবহৃত হবে। পরবর্তীতে সেই বাড়িতেই প্রাথমিক ভাবে গড়ে ওঠে বি সি রায় পোলিয়ো হাসপাতাল। পরে রোগীর চাপ বাড়ায় বাড়িটির উল্টো দিকে হাসপাতালের নতুন ভবন তৈরি হয়। আর পুরনো বাড়িটি হয় পোলিও। হাসপাতাল কর্মীদের থাকার জায়গা। ১৯৭৬ সালে ভারতীয় কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রক কলকাতায় প্রতিবন্ধীদের একটি বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করার জায়গা চাইলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই বাড়িটি তাদের দেয় বিনা ভাড়ায়।