ধর্ষণ যখন একটি রাজনৈতিক অস্ত্র
দীর্ঘদিন ধর্ষণকে বলা হতো সামাজিক ব্যাধি। বাস্তবে এটি একটি অপরাধ। এই অপরাধ কারো ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনেই ক্ষয়ক্ষতি আনে না। বরং এটি সমাজেও গভীর প্রভাব ফেলে। ইতিহাসের একদম প্রাচীন থেকেই ধর্ষণ পুরুষের শক্তির প্রদর্শনের একটি রাজনৈতিক কৌশল। এমনকি যুদ্ধাবস্থায় সামরিক অভিযানের ক্ষেত্রেও ধর্ষণ একটি বড় যুদ্ধকৌশল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং একাত্তরেও আমরা তা দেখেছি। কলকাতার আর জি কর হাসপাতালে এক নারী ডিউটি ডাক্তারের ওপর হওয়া নির্মম ধর্ষণের ঘটনা আমাদের সমাজের একটি গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি। এই ঘটনা শুধুমাত্র একটি জঘন্য অপরাধ হিসেবে নয়, বরং আমাদের সমাজের নৈতিকতা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং নারীর অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলে। হাসপাতালের মতো জায়গায়, যেখানে মানুষ সুস্থতার জন্য আসে, সেখানেও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রভাব থাকতে পারে। হাসপাতালের কর্মীদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই, হিংসা বা প্রতিহিংসার মানসিকতা নারীদের বিপদের মুখে ফেলতে পারে। আরজিকর হাসপাতালের এই ঘটনাটি অভ্যন্তরীণ রাজনীতির একটি প্রতিফলন হতে পারে, যেখানে নারী কর্মীরা শিকার হন।
ধর্ষণ প্রাচীন যুগের অস্ত্র
প্রাচীন গ্রিস ও রোমে, যুদ্ধজয়ী সেনারা পরাজিত জাতির নারীদের ধর্ষণ করে তাদের শৃঙ্খল ভাঙার চেষ্টা করতো। ধর্ষণ তাদের বিজয়ের প্রতীক এবং শত্রুর মনোবল ভেঙে দেওয়ার একটি কৌশল ছিল। মধ্যযুগে বিশেষ করে ইউরোপে ধর্ষণ ছিল রাজনৈতিক প্রতিশোধের একটি মাধ্যম। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে, শাসকরা প্রায়শই শত্রুদের পরিবারের নারীদের ধর্ষণ করত। ক্ষমতা ও প্রভাব এভাবেই প্রকাশিত হতো। ব্যক্তিগত শত্রুতা বাদে রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশও ছিল ধর্ষণ। প্রাচীন ভারতে মহাভারতের কাহিনীতে দ্রৌপদীর চিরায়ত লাঞ্ছনার কাহিনীও কিন্তু তারই সাক্ষ্য দেয়। দ্রৌপদীর চুল ধরে টেনে সভায় আনা এবং তার ওপর যে নির্যাতন চালানো হয়, তা প্রমাণ করে যে নারীদের উপর অত্যাচার কেবল ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নয়, বরং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শক্তি প্রদর্শনের একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
আধুনিক সময়ে ধর্ষণ এক কৌশল
বর্তমান কালে ধর্ষণ সামরিক কৌশল হিসেবে ব্যবহার হওয়ার পাশাপাশি, সামাজিক নিয়ন্ত্রণের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। বালকান যুদ্ধের সময় (১৯৯২-১৯৯৫) সার্বিয়ান বাহিনী কৌশলগতভাবে মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করে। এই ঘটনার মাধ্যমে সামাজিক ভীতির পাশাপাশি মুসলিম জনগণের মনোবল ভেঙে দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল। বর্ষণকে একটি যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে এটি কেবল ব্যাক্তিগতভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা নয়, বরং একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার।
বহুমাত্রিক অস্ত্র এই ধর্ষণ
ধর্ষণ কেবলমাত্র শারীরিক সহিংসতা নয়। বরং ধর্ষণ মানসিক, সামাজিক, এবং রাজনৈতিক একটি চরম অস্ত্র। ধর্ষণের মাধ্যমে একজন নারীকে শুধুমাত্র শারীরিকভাবে আঘাত করা হয় না, বরং তার মানসিক অবস্থা, আত্মসম্মান, এবং সামাজিক অবস্থানকেও ভেঙে ফেলা হয়। ধর্ষণকে সামাজিক স্তরে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এটি একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অস্ত্র যা নারীর উপর আধিপত্য বজায় রাখতে ব্যবহৃত হয়। নারীদের ওপর এই ধরনের নির্যাতন তাদের কেবল শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং তাদের আত্মসম্মান এবং সামাজিক অবস্থানকেও বিনষ্ট করে।
ধর্ষিতাই অপরাধী
ধর্ষণের পর ভুক্তভোগী নারীকে সমাজের একটি বড় অংশই দোষারোপ করে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে ধর্ষণকে প্রায়শই নারীর পোশাক, আচার-আচরণ, বা স্বাধীনতা দ্বারা বিচার করা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি ভূক্তভোগী নারী এবং তার পরিবারের ওপর দোষারোপের মাধ্যমে অপরাধীকে আড়াল করে এবং এই নির্মম অপরাধকে ন্যায্যতা দেয়। ভাকে আইনের বিচারও নিশ্চিত করা হয় না। এজন্য তাকে যে হেনস্তার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তা বর্ণনাতীত।
পিতৃতান্ত্রিক গঠনে ধর্ষণ পায় বৈধতা
পিতৃতান্ত্রিক গঠন ধর্ষণকে বৈধতা দেয়, এবং এর ফলে সমাজ ধর্ষণকে শুধুমাত্র একটি অপরাধ হিসেবে দেখার পরিবর্তে, নারীর ওপর একটি নির্ভরযোগ্য শান্তি বা প্রতিশোধ হিসেবে গণ্য করে। ধর্ষণের পর নারীর শরীর এবং মানসিক অবস্থার ওপর প্রভাবিত করার পাশাপাশি, তার পরিবারের ওপর সামাজিক লজ্জা এবং অপমানের একটি ভার চাপিয়ে দেওয়া হয়।
রাতে কাজ করা নারীর জন্য ভয়
রাতে নারী কাজ করণে ক্ষতি? অনেক নারী তো ভোরে বের হন। অনেক নারীর ভোরের আলোর আগে বের হন। অনেক নারী গার্মেন্টসের ওভার টাইম শেষে বের হন। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতা ধামাচাপা দেয়ার জন্য অনেকে বলেন রাতে কেন নারী শিফটে কাজ করবেন। এটি একটি অপযুক্তি।
রাতের শিফটে কাজ করা কি নারীদের জন্য সবসময়ই বিপদজনক। বিশেষ করে ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, সাংবাদিক এবং অন্যান্য পেশায়, যেখানে রাতের কাজ অপরিহার্য, সেখানে নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি নতুন করে ভাবার দরকার আছে। রাতের বেলা কাজ করার সময় নারীরা অনেক সময় আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, কারণ এই সময়ে কর্মস্থলের চারপাশে সুরক্ষা ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে দুর্বল থাকে। তবে, ধর্ষণ বা নির্যাতনের ঘটনা দিন বা রাতের নির্দিষ্ট সময়ের উপর নির্ভর করে না। এটি নির্ভর করে কর্মস্থলের পরিবেশ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির উপর। তাই নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শুধুমাত্র রাতের শিফট নয়, প্রতিটি সময়ের জন্যই পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকা জরুরি।