বৈষম্যে নয়, বিচার হোক যোগ্যতায়
ইতিহাসের কোনো এক উযালয়ে নারীরা যখন বুঝতে পারল তারা শৃঙ্খলিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত, তখন থেকেই শুরু হয়েছিল নারীমুক্তির আন্দোলন। ফরাসি কিশোরী জোয়ান অব আর্ক সেই পঞ্চদশ শতকে পুরোনো ধ্যান ধারণা মূল্যবোধকে ভেঙে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন। সামাজিক বিধিনিষেধ উপেক্ষা করেই তাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। জোয়ান অব আর্ককে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। পৃথিবীর মানবীবিদ্যার ইতিহাসে প্রথম আত্মাবিসর্জনকারী নারী হিসেবে তার নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে। সেই যে নারী অধিকারের স্বীকৃতির জন্য আন্দোলন, তা আজ অবধি বহমান। কারণ যে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোয় নারীর অবস্থান সেখানে তার ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের জায়গাটি বিকশিত হওয়ার সুযোগ কম। তাই তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক সক্ষমতা প্রস্তুতের ক্ষেত্রটি অসম্পূর্ণই থেকে যায়। নারী প্রথম বৈষম্যের শিকার হয় নিজের পরিবারে। পুত্র সন্তানটি সব অধিকার ভোগ করলেও কন্যাটির অধিকার থাকে সংরক্ষিত; সেটিই হলো নারীর প্রতি বৈষম্যের প্রথম পাঠ।
তারপর কালক্রমে সে বুঝতে পারে যে, নারী হয়ে জন্ম নিয়ে সে নারীই থাকবে, মানুষ হওয়া হবে না। মানুষ হতে চাইলে যত বিপদসংকুল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়, তাতে অধিকাংশ নারীর মানুষ হওয়ার দীক্ষা নেওয়ার মানসিক শক্তি বা জোর থাকে না।
স্বামীর অনুমতি না নিয়ে বাইরে যাওয়া, বাচ্চাদের প্রতি যত্নশীল না হওয়া, স্বামীর সঙ্গে তর্ক করা, যৌন সম্পর্ক করতে অস্বীকৃতি জানানো, খাবার পুড়িয়ে ফেলার মতো অতি তুচ্ছ যেকোনো অন্তত একটি কারণে নারীর মার খাওয়াকে যৌক্তিক মনে করে। এ দেশের ২৫.৪ শতাংশ নারী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) রিপোর্টে পনেরো থেকে উনচল্লিশ বছর বয়সের বিবাহিত নারীদের মানসিকতার যে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে, তাতে ধারণা করা যায়, নারীরা নিজেরাই তাদের অধিকার এবং মর্যাদার বিষয়ে সচেতন নয়।
নারীর প্রতি নির্যাতনের বিষয়ে আমাদের সমাজ অত্যন্ত সহিদুং, নমনীয়। খুব বড় ধরনের সহিংসতা যেমন: তীব্র শারীরিক আক্রমণ, হত্যা, খুন বা রেপ এমন ঘটনাগুলো না ঘটা পর্যন্ত আমাদের সমাজ নারীর প্রতি সহিংসতা হয়েছে, তা বিবেচনায় নেয় না। নারীর প্রতি সহিংসতার প্রধান কারণও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাই নারী নির্যাতনের উর্বর ক্ষেত্র। সমাজের প্রচলিত ধারা অনুযায়ী নারী যতই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠুক না কেন, পুরুষের আধিপত্য তার ওপর প্রভাব বিস্তার করে করবেই। পরিবারগুলোতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একক কর্তৃত্ব শুধুই পুরুষের, সেই পরিবারে যতই যোগ্যতাসম্পন্ন নারী থাকুক না কেন।
নারীর প্রতি সহিংসতা রাতারাতি দূর হবে এমন ভাষারও কারণ নেই। আনার শুধু কয়েকজন নারীর সাফল্য দিয়ে গোটা সমাজকে বিচার করাও সঙ্গত হবে না। সমাজ ও সভ্যতা যত এগিয়ে যাচ্ছে নারী নির্যাতনের প্রবণতাও বেড়ে চলেছে। নারীরা শিক্ষিত এবং সচেতন হওয়ার হার বাড়ার কারণে পরিবর্তিত হচ্ছে নারী নির্যাতনের ধরন ও প্রকৃতি।
যৌতুক, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, তালাকের মতো বিষয়গুলোতে নারীর ন্যূনতম অধিকার ও মর্যাদা রক্ষিত হচ্ছে না। এসব কারণে সহিংসতার শিকার হয়ে প্রতিবছর অসংখ্য নারী মৃত্যুবরণ করে। নারী নিজ পরিবারে নির্যাতিত, পরিবারের বাইরেও নির্যাতিত এবং এই নির্যাতনের কথা বলতেও পারে না। কিংবা বললেও আমলে না নিয়ে সেই নারীকেই অবমাননা করা হয়। সমাজের এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেক নারী চাইলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারে না। নিরবেই সহ্য করে যায় অত্যাচার নির্যাতন।
আবার মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে কত নারী যে খুঁফে ধুঁকে মরছে তার পরিসংখ্যানগত হিসেব হয়ত নাই। কিন্তু নারী মাত্রই জানে প্রতিনিয়ত কতটা অবহেলা, অসম্মান আর আত্মসম্মানহীনতায় ভেতর দিয়ে যেতে হয়। নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটা চরম অবহেলিত, উপেক্ষিত। তাত নারী বুক সমান হতাশা, দীর্ঘশ্বাস, অবহেলা, আক্ষেপ নিয়ে নির্ঘুম রাত পার করে, সে হিসেবটা শুধু নারীরাই জানে। যে দেশে, সমাজে, পরিবারে আজও মেয়েদের মানুষ ভাবতেই শেখেনি, তার ইচ্ছা- অনিচ্ছার মূলয়য়ন করতে জানে না, সেখানে মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাববার সময় কই। মানুষের ভিড়ে একাকিত্ব আর তীব্র দহনে নারীদের দীর্ঘশ্বাস শুধু চার দেয়ালের ভেতরেই ঘুরপাক খায়।
উপযুক্ত শিক্ষার দ্বারা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে
মানব জীবনে মর্যাদাবোধ প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে নারীমুক্তি আসবে। জ্ঞান অর্জন, আত্মসংযম, শ্রমনিষ্ঠা, সেনা, মৃঢ়তা, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মাধ্যমে মানসিক দাসত্বের কঠিন শৃঙ্খল ভাঙতে হবে। প্রতিবাদ হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসত্যের বিরুদ্ধে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। একুশ শতকের পৃথিবী মেয়েদের আজও নিরাপত্তা দিতে পারেনি। মুক্ত মুনিয়া মুক্ত বাণিজ্যের জগাতে মেয়েরা হয়ে যায় পণ্য। এর থেকে মুক্তি বড় জরুরি। এ মুক্তির জন্য প্রয়োজন আমাদের মানসিক পরিবর্তন। রাষ্ট্রীয় সামাজিক পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন আর বহুযুগ লালিত সংস্কার আর অভ্যাসের দাসত্ব থেকে মুক্তি। তবেই হয়তো আসবে আমাদের কাঙ্ক্ষিত মুক্তি।
আমাদের সমাজে ক্ষেত্রবিশেষে পুরুষও নির্যাতিত হয়। এটাও কাম্য নয় মোটেও। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নির্যাতিত সকলের আত্মসম্মানবোধের চেতনা জাগ্রত হোক, মানুষ হিসেবে সবাই সম্মানিত হোক, সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক। নারী- পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাক মানব সমাজ।
একমাত্র যোগ্যতা আর মানসিক দৃঢ়তাই পারে নারীকে মুক্তি এনে দিতে। ভারও করুণা বা দয়ায় নয় বরং নারীকে এগিয়ে যেতে হবে তার নিজের যোগ্যতা দিয়ে, প্রমাণ করতে হবে নিজেকে, যে নারী পারে। নারীর আজকের অবস্থানও কেউ তৈরি করে দেয়নি, তাই আগামীর অবস্থানও কেউ তৈরি করে দিবে না। তাই নারীকে নিজের পথ নিজেই তৈরি করতে হবে।
নারীকে প্রমাণ করতে হবে, নারী পারে, নারী পেরেছে এবং আগামীতেও নারী পারবে। এই মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই নারীকে সামনে চলার সিঁড়ি রচনা করতে হবে। আর এর জন্য নারীর দরকার, কেবল দৃঢ়তা আর যোগ্যতা। পাশাপাশি সমাজ ও পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন-ই নারীকে তার যোগ্য সম্মান দিতে পারে।