পরিবারও নারী শিশুর জন্য অনিরাপদ
এখন রাস্তায় অনেক শিশুকে নানা পণ্য বিক্রি করতে দেখা যায়। অনিরাপদ এই শহরে জীবিকার তাগিদেই শিশুদের নামতে হচ্ছে। তাদের বাড়ি কোথায়? অনেক দূর তারা গণপরিবহনে করে চলে যাচ্ছে। বিশেষত নারী শিশুদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি আরও অনেক। শৈশবে শিশুদের আসলে খেলার সময়। জীবনকে উপভোগ করা ও জীবনের কিছু স্মৃতি সঞ্চয়ের সময়। বাইরের বিপজ্জনক জগতটাকে নিয়ে তাদের লড়াই করার কথা নয়। সন্ধ্যার পর সবসময়ই শিশুকে বাড়ির নিরাপদ ঘেরে রাখার কথা বলেন অভিভাবকরা। কিন্তু নিম্নবিত্ত পরিবার কিংবা বেওয়ারিশ নারী শিশুদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কেমন? মোটেও ভালো হয়। তাদের আগলে রাখার সুযোগ অনেক কম। পরিবারকেও কি আসলে নিরাপদ বলা যায়? আসলে না। সম্প্রতি এক জরিপে এই ভাবনাতেও কিছুটা শঙ্কা বেড়ে গেলো। পরিবার এখন হয়ে উঠেছে শিশুর নির্যাতনের কেন্দ্র।
শিশুকে অসহায় পেয়ে, হাতের কাছে পেয়ে এবং শিশুর উপর কর্তৃত্ব করা সহজ বলে আমরা বড়রা সবসময়ই শাসন করার চেষ্টা করি। ভুলে যাই শাসনের নামে শোষণ করে ফেলছি। আমরা চাই শিশুকে নিজেদের ইচ্ছাধীন করে রাখতে। এক জরিপ বলছে, ঘরেই শতকরা ৯৫.৮ জন শিশু নির্যাতিত হচ্ছে নানাভাবে। শিশুরা পরিবারে সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয় বাবা-মা ও অভিভাবকদের দ্বারা। নিয়ম শেখাতে গিয়েই এমন নির্যাতন আসলে করা হয়। প্রতিবন্ধী শিশুরাও শুধুমাত্র প্রতিবন্ধিতার কারণে পরিবার ও সমাজে নিগৃহীত হচ্ছে।
জরিপে অংশগ্রহণকারী শতকরা ৯৫.৩ জন শিশু জানিয়েছে যে তারা জীবনের কোন না কোন সময় ঘরে, বাইরে, স্কুলে না কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার শিকার হয়েছে। এরমধ্যে শতকরা ৯৬.২ জন মেয়েশিশু এবং শতকরা ৯৪,৫ জন ছেলেশিশু। নারী শিশুকে শারীরিকভাবে অত্যাচার করার মধ্যে পড়ে হাত, জুতা, বেল্ট, বোতল দিয়ে মারা, লাথি দেয়া, ঝাঁকি দেয়া, ছুঁড়ে ফেলা, চিমটি কাটা, টানা হেঁচড়া করা, চুল টানা, দাঁড় করিয়ে রাখা, হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রাখা, শরীর পুড়িয়ে দেয়া, অতিরিক্ত শ্রম করানো এবং ভয় দেখানো। শতকরা ৮২ জন শারীরিক সহিংসতার শিকার হয় আর ২৪.১ শতাংশ শিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়। শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা সমাজে নয়, শিশু তার গৃহে ও কর্মক্ষেত্রেও শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। মানসিক হয়রানির মধ্যে পড়ে শিশুকে ছোট করা, আজেবাজে নামে ডাকা, ভয় দেখানো, গালাগালি করা, হুংকার দেয়া, ইয়ার্কি করা, বুলিং করা, শারীরিক ত্রুটি নিয়ে ঠাট্টা করা, সামাজিকভবে হেয় করা, সমালোচনা করা, অভিশাপ দেয়া, লজ্জা দেয়া, অবহেলা করা।
শিশুকে যদি মানসিকভাবে হয়রানি করা হয়, সেই শিশুও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে বড় হতে বাধ্য। ইদানিং বিভিন্ন জায়গা থেকে অভিযোগ আসছে যে শিশু তার সহপাঠী, বন্ধু, শিক্ষক বা বড়দের কাছ থেকে বুলিং এর শিকার হচ্ছে, যা শিশুকে অস্থির, বিমর্ষ ও নিঃসঙ্গ করে তুলছে। শিশু হয়ে উঠছে সুইসাইডাল বা অপরাধী মানসিকতার ও দুর্বল চিত্তের।
কাজ করতে গিয়ে দেখা গেছে স্বজনদের হাতেই বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয় নারী শিশুরা। ৭ থেকে ১৩ বছরের শিশুরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। সাধারণত যৌন নিপীড়নকারী ব্যক্তি এমন একটা ভাব নেয় যা দিয়ে শিশু ভিকটিমকে এবং তার পরিবারকে অরক্ষিত করে তোলে। তারা এমন মানুষের বেশ বা কাজ নিয়ে শিশুর কাছে আসে, যাকে শিশু বা শিশুর পরিবার বিশ্বাস করে, যেমন শিক্ষক, কেয়ারগিভার বা অভিভাবকের ভূমিকায়। এমনও হতে পারে যৌন হয়রানি করার আগে তারা শিশুটিকে স্পর্শ করে করে অভ্যস্ত করে তুলতে পারে অথবা শিশুকে এমনভাবে স্পর্শ করে, যেন শিশু কিছু বুঝতেই না পারে। এভাবেই তারা ক্রমশ পেছনে থেকে সীমা লংঘন করে বা অপরাধ চালিয়ে যায়। যৌন অপরাধ যারা করে, তারা স্নেহ ও ভালবাসার ছদ্মাবরণে এটা করে বলে জানিয়েছে ১৬.২ ভাগ শিশু। ১৫.৬ জন শিশু বলেছে তারা ঠিক জানে না পরিবারের বাইরে কোথায় গিয়ে এই বিষয়ে অভিযোগ জানাতে হয়।
সমাজে সবধরণের অপরাধ বাড়ছে। নারী ও শিশু নির্যাতন লাগামছাড়া। অপরাধীদের চরিত্র ও সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এদের একটা বড় অংশ শিশু-কিশোর বা তরুণ। যে ব্যবহার পেয়ে তারা বড় হচ্ছে, ঠিক সেই ব্যবহারই তারা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিচ্ছে ও দিবে। কাজেই শিশুর সাথে সে ব্যবহারই করা উচিৎ, যা আমরা তাদের কাছে ভবিষ্যতে প্রত্যাশা করি।