একটি অভিমানের গল্প
-এ মামা চিকলি যাবেন?
-যাব
-কত নিবেন?
-দুজনে ষাট টাকা
-৫০ টাকা দিব
-আচ্ছা ঠিক আছে ওঠেন
-এই ওঠ… এভাবেই একটা অতুলনীয়ও অকৃত্রিম গল্পের শুরু হয়েছিল। যে গল্পটা অভিমানের। যে গল্পটা প্রণয়ের। যে গল্পটা ভালোবাসার। যখন রিকশায় চেপে বসছিলাম তখন কেবল ঠাহর করতে পারলাম আমাদের গন্তব্যটা কোথায়। আমি খুব সারপ্রাইজডও হয়েছিলাম কেননা এর আগে কখনো চিকলি যাওয়া হয়নি। যদি কাউকে হুট করে এত বড়ো সারপ্রাইজ দেওয়া যায়, তাহলে তো তার তুলনাই হয় না। আমি তখনই বিষয়টার সিরিয়াসনেস বুঝতে পেরেছিলাম যখন মাথায় হাত রেখে কসম করতে হয়েছিল। আমাদের অটোরিকশা চলছে। সারাদিন গরমের মাঝে পার করে বৃষ্টির একটু আবহাওয়া সৃষ্টি হয়েছে। গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে অবশ্য। তবে খুব বেশি না, অল্প। সারাদিন প্রচন্ড গরম থাকার পর যখন রাত্রিবেলা এরকম একটু ঠান্ডা হাওয়া চলে আসে, তখন নিজের অজান্তেই কেমন জানি একটা ভালো লাগা কাজ করে। ঠিক রিকশায় খোলা চুলের কোনো সুন্দরীকে পাশে বসিয়ে, বঙ্গবন্ধুর মতো মোটা গলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করার মতো। সন্ধ্যার পরে নাইটের আলোতে রাস্তা যেন এক অতুলনীয় রূপ পেয়েছে। কেমন কোমল, শান্ত ও সজীব যে রূপ। লজ্জাবতী মেয়ের মতো সুন্দর। প্রেমে পড়লে হয়তো এই সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যায়। যেটা আমি যতটা না অনুভব করতেছি তার চাইতে বেশি অনুভব করছে মবিন। আসলে জীবনে এমন কিছু সময় থাকা দরকার যখন হুট করে আমরা বেরিয়ে পড়ব অজানা কোনা উদ্দেশে। হাজারো কাজের শত ব্যস্ততার মাঝে একান্ত নিজের করার জন্যই সময়টাকে বেছে নেব সকালের অজুহাতের পর্দা ভেদ করে। তাও আবার কোনো ভবিষ্যৎ না ভেবেই। কেননা সবসময় যদি আমরা ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা মাথায় আনি তাহলে আমরা বর্তমানকে উপভোগ করতে পারব না। হাজারো কাজের ব্যস্ততা ভেদ করে একদিন আপনি সাড়া দেবেন আপনার নিজের চাহিদায়। থাকুক না সেদিন গুরুত্বপূর্ণ কাজ, কিন্তু আপনি করবেন না। নোট, শিট, গ্রুপ, ক্লাস, ক্লাব, মিড টার্ম। খামুন।। অনেক হয়েছে অনেক। এবার ফোনটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে আরাম করে একটা ঘুম দেন। ঘুমানোর সময় আবার এটা ভাববেন না যে আপনাকে উঠতে হবে কিংবা কাছে যেতে হবে। একদম পরিপূর্ণ শান্ত মন নিয়ে আপনি ঘুমাবেন। যেন, আপনার কোনো কাজ নেই, কোনো চিন্তা নেই, কোনো কর্তব্য নেই। আপনি আরামের জন্য ঘুমাচ্ছন।
ঠিক এই মানসিকতা নিয়েই অনেকগুলো কাজের প্রেশারকে উপেক্ষা করে মবিন এগিয়ে চলল একান্তে নিজেকে একটু সময় দেওয়ার জন্য। বিভাগের এক বড়ো ভাইয়ের স্নাতক সম্মানের সার্টিফিকেটজনিত সমস্যা থাকার কারণে অনশন ধর্মঘটে প্রত্যেকটা ব্যাচের উপস্থিতি সেখানে বাধ্যতামূলক ছিল। একজন সিআর হিসেবে মবিনের উপস্থিতিতে একদমই বাধ্যতামূলক ছিল। এমনকি ব্যাচের অন্যরা যদি না আসে সে দায়ভার সম্পূর্ণই ওর ওপর। ঠিক ওই মুহূর্তে মাথা ব্যথার অজুহাতে আমাকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। অবশ্য অজুহাত নয়, ব্যথা সত্যিই ছিল। ভাইকে বলল আগামীকাল পরীক্ষা আছে স্যারের সাথে কথা বলার জন্য যাচ্ছি।
বেরিয়ে পড়লাম দুজন। আমি ওর পাশে থেকে ওর ব্যস্ততা লক্ষ করছিলাম। ওর ফোনে প্রতি মিনিটে একটা করে কল চলছিল। বাইরে থেকে আসছিল, না হয়ও-ই দিচ্ছিল। যেকোনো মুহূর্তে বিভাগের সিনিয়রদেরকে ম্যানেজ করা নিজের ব্যাচের দায়িত্ব। এর ওপরেও আরেকটা দায়িত্ব এসে পড়েছে যেটার জন্য তাকে সবচেয়ে বেশি সেক্রিফাইস করতে হচ্ছে। নিজের মাইগ্রেনের ব্যথা করছে তবুও সে সেদিকে লক্ষ করল না। আমরা রাতের রঙিন রাস্তায় প্রেমের বাহন রিকশায় চেপে যাচ্ছি। দুজনের কারো গায়েই ভাল্যে পোশাক নেই, পায়ে পরে আছি নরমাল জুতা। রাতের আবহাওয়াটা কিছুটা শীতল হলেও শীত লাগছে না মোটেও।
চিকলি যাব যেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু কেন যাচ্ছি-সেটা তখনও আমি জানি না। কু কচুড়া রোডে যখন জিজ্ঞাসা করেছিলাম কোথায় যাচ্ছি? ও তখন বলেছিল একটু প্রকৃ তি দেখে আসি। এখন পুনরায় জিজ্ঞাসা করলাম কোথায় যাচ্ছি আমরা, বলছিস না কেন? তখনও বলল আজকে আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে তোর পরিচয় করিয়ে দেব। আমি তো শুনে অবাক। কিন্তু কে সেটা নাম বলল না। আমাকে বলল আইডিয়া কর। আমি বললাম কীভাবে আইডিয়া করব?
-বলছে আমাদের ভার্সিটিতেই ১৪তম ব্যাচেই আছে।
-ভার্সিটিতে দুই-একজন পড়ে নাকি? অনেক অনেক শিক্ষার্থীর ভিড়ে কীভাবে টের পাব?
-আমাদের ডিপার্টমেন্টেই আছে।
তখন আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, আমাদের ডিপার্টমেন্টে কি কম সুন্দরী আছো সে বলল, আন্দাজ কর। আমি তখন রিকশায় চেপে রাতের সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে করতে রাস্তার রঙিন লাইটকে তুলনা করলাম এবং খেয়াল করে দেখলাম রাস্তায় লাইটের তিনটা রঙের আলো আছে। আমি ওকে বললাম যে আমি তিনটা নাম আইডিয়া করে আমার মেসেঞ্জারে ইনবকে সেভ করে রাখলাম। গন্তব্যস্থলে পৌছানোর পর যদি আমার আইডিয়ার সাথে মিলে যায় তাহলে এই নাম তিনটা তোকে দেখাব। আর যদি এই তিনটা নামের সাথে ওই ব্যক্তির মিল পাওয়া না যায় কিংবা এই তিন নামের বাইরে অন্য কেউ হয়, তাহলে কিন্তু দেখাব না। ও বলল ঠিক আছে। ততক্ষণে আমরা রাস্তার প্রায় বেশির ভাগ অংশ চলে এসেছি। মোড় ঘুরেই ফুলের দোকানে থামল, ফুল নিল। গোলাপীর সাথে তখন সাদা গোলাপও নেওয়া দেখে আমার আইডিয়াটা আরো শক্ত হলো। কারণ যে তিনটা নাম বলেছি, তার ভিতরে একজনের সাদা গোলাপ ফুল পছন্দ। আমরা আরো এগিয়ে গেলাম। গেটে গিয়ে আমি তো অবাক। সেফি সৌন্দর্য মাইরি। আমি চর এলাকার মানুষ। প্রকৃতি এবং নদী, স্রোত, পানির ঢেউ, নির্মল বাতাস কোনো কিছুই আমার অজানা নাই। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দুষ্প্রাপ্যতা ছিল না কখনোই। সবসময় এগুলোর সহজলভ্যতার মাঝখান দিয়েই বড়ো হয়েছি। কিন্তু মাঝখানেই রংপুরে একমাস অবস্থান করার পর বুঝতে পারলাম, কংক্রিটের এই শহরের মাঝখানে প্রেম ভালোবাসা জিনিসগুলো খুবই কম। চার দেয়ালের মাঝখানে ভালোবাসটা বন্দি হয়ে আছে। ঠিক এই মুহূর্তে যখন চিকলিতে ঢুকলাম নির্মল বাতাস আর পানির ঢেউ আমাকে মুগ্ধ করল। দুই নাম্বার গেট পার হওয়ার পর ও বলছে তুই একটু ধীরে আয় আমি একটু দ্রুত যাই। বললাম যা। ওকে এগিয়ে দিয়ে আমি ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করলাম এবং অনুভব করতে থাকলাম চূড়ান্ত মুহূর্তটার সৌন্দর্যটা কত বেশি হতে পারে। এখানে আগে কখনো আসিনি তাই ধীরে ধীরে ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে দৃশ্য এবং ওপরের লাইটগুলো দেখছিলাম। আমার গন্তব্য ছিল পশ্চিম দিকে যাওয়া। পাঁচ মিনিট হাঁটার পর গন্তব্যস্থলে পৌছালাম এবং আমি খুবই আশ্চর্য হলাম যে আমার আইডিয়া করা তিনটা ব্যক্তির মাঝখান থেকে দুইটা ব্যক্তিই মিলে গেছে। তার ভেতরে একজন ছিল মাসুক। আরেকজন ছিল মাসুকের বন্ধু। চমৎকার চমৎকার। আমি তখন কিছুকালের জন্য বোবা হয়েগিয়েছিলাম। কারণ আমি যখন ওকে ওয়াদা করেছিলাম যে, আমার এই তিনটা নাম যদি মেলে তাহলে দেখাব আর যদি না মিলে তাহলে দেখাব না। ঠিক এই মুহূর্ত থেকে আমার দিস্তা বেড়ে গেছে, কারণ বন্ধু হিসেবে যদি আরেকটা বন্ধুর ব্যাপারে আইডিয়া কিংবা চিন্তা- ভাবনা না মিলে, তাহলে বন্ধুত্বের গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে আমাদের মাকে গভীরতা কতটুকু সেটা আমি জানি না। তবে আমি এতটুকু অদ্ভুত খুব সারপ্রাইজড হয়েছি যে, আমার আইডিয়াটা মিলে গেছে। তারপর আশিক এবং মাসুককে একা ছেড়ে দিয়ে মাসুকের বন্ধুর সাথে আমি একটু হাঁটা শুরু করলাম। এর মাঝখানে কিছু গল্প করলাম। আমাদের গল্প এখানে নাইবা বলি। বের হয়ে আমরা দুজন একসাথে করে আগে চলে এলাম এবং আশিক এবং মাসুককে আলাদা রিকশায় একসাথে করে আসার সুযোগ করে দিলাম।
আমরা দিন দিন বড়ো। হচ্ছি। সভ্য হচ্ছি। উন্নাত হচ্ছি। ডিজিটালাইজড হচ্ছি। সব কিছুর সহজলভ্যতা বেড়ে যাচ্ছে। হাতের নাগালেই পাওয়া যাচ্ছে পৃথিবীর ওই প্রান্তের জিনিস। মাঝখান থেকে উঠে যাচ্ছে প্রেম, ভালোবাসা, মহব্বত এবং অভিমান। আমি খুবই আশ্চর্য হলাম সেদিন যে, গিয়েছিলাম এত দায়িত্ব এবং এত কংক্রিটের বাঁধন ছিন্ন করে। আজকালকার ভালোবাসার ভিতরেও এতটা অভিমান জমে আছে এবং সেই অভিমান ভাঙানোর মানুষও আছে। তাও আবার ওই রকম একটা আন্দোলন মুখর পরিবেশে সিম্বার হয়ে ও এতদূর আসছে। যাই হোক এটা আমার বিচার। আমার বিচার ও একজন সিআর। কিন্তু প্রেম-ভালোবাসার হিসেবে সে একজন প্রেমিক। আর প্রেমিকের কাছে কোনো বাধা থাকা উচিত না। ইট- পাথরের এই শহরে অভিমান নামক সবুজ ঘাস এখনো বেঁচে আছে এবং সেটা ফুল এবং সুলাস ছড়াচ্ছে। যেটা সত্যিই আনন্দের। আমি এই কংক্রিটের দেয়াল বেয়ে ওঠা সবুজ ঘাস এবং ফুল উভয়ের জন্যই শুভকামনা করি। তোরা একসাথে থাক বাকি জীবন। আমি এই অভিমানের সমাপ্তি দেখতে চাই না। পূর্ণতা দেখতে চাই সেই সবুজ ঘাসের মুখে কলি আকারে থাকা ফুলের।
শুভ কামনা সবুজ ঘাস মবিন,
এবং সবুজ ঘাসে অফুটন্ত কলি তিথি।
শুভকামনা তোদের দুইটার জন্য।