কলকাতার একমাত্র নারী বাসচালক প্রতিমার এক যুগ
শহরের বুকে বাস ছুটছে নিজের পথে। ভরা অফিস টাইমে, জ্যামজট পার করে, ভিড় রাস্তায় দিব্যি তার গতি। হেলপারের তারস্বর চিৎকার, মিনিবাসের দরজায়
মানুষের ভুলতে থাকা, এ সব চিত্র সবার কাছেই পরিচিত। এমনই অজস্র লাল-হলুদ মিনিবাসের মধ্যে একটি বাসের দৃশ্যপট একটু হলেও আলাদা। চালকের আসনে বসে আছেন এক নারী। দেখেই যেন থমকে যেতে হয়। সাধারণ মানুষের চোখ এ দৃশ্যের সঙ্গে অভ্যস্ত নয় যো উত্তর ২৪ পরগনা জেলার ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চনের নিমতা এলাকার বাসিন্দা প্রতিমা পোদ্দার কিন্তু দিব্যি অভ্যস্ত। তুখোড় হাতে কলকাতার বুকে বাস হাঁকিয়ে ছোটেন প্রতিদিন। এটাই তার পেশা। নেশা তো বটেই। সাধারণ মানুষ যতই চমকে উঠুন না কেন, প্রতিমার কাছে এ কোনও বড় ব্যাপার নয়। এক যুগ বছর ধরে বাস চালাচ্ছেন তিনি। পুরো জীবনে সর্বস্ব সঞ্চয় দিয়ে একটি প্রাইভেট মিনিবাস কিনেছিলেন প্রতিমা এবং তার স্বামী শিবেশ্বর পোদ্দার। প্রথম দিকে শিবেশ্বর বাস চালাতেন, কনডাকটরের ভূমিকায়। থাকতেন প্রতিমা। একসময়ে স্বামীর উৎসাহেই বাস চালাতে শেখেন প্রতিমা নিজে। তারপর থেকেই গৃহবধূর তকমা ঘুচিয়ে পুরোদস্তুর বাসচালক হয়ে ওঠেন প্রতিমা পোদ্দার। তবে এ জন্য এখনও রাস্তাঘাটে অনেক বিষ্ণুপ, টোন টিটকিরির সম্মুখীন হতে হয় তাকে। কিন্তু তাতে কুছ পরোয়া নেহি।
হাওড়া-নিমতা রুটে প্রতিমাদেবী মিনিবাস ছোটান নিজের ছন্দে। তবে বাস শেখা এবং লাইসেন্স পেতেও বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল তাকে। প্রতিমা বলেন, ‘২০১২ সালে আমি চার চাকার লাইসেন্স পাই। তবে এ ভাবে অন্য রকম কিছু করতে গিয়ে অপদস্থ হতে হয়েছে বারবার। প্রথমেই বেঁকে বসলেন নিমতা সরান্ডের বাসচালকেরা। ওখানকার সংগঠন খুব বামেলা শুরু করুন। ২০ দিন ডিপোয় পড়ে থাকল আমাদের বাস। পরেও আমাদের গাড়ি আটকে রাখা হয়েছে বহু বার। তবে আমি হার মানিনি। এমনও দেখেছি, মহিলা চালক বলে অনেকেই আমাদের গাড়িতে উঠতে চাইছেন না। পরে ঠিকঠাক গন্তব্যে পৌঁছে তাঁরাই মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেছেন।’
প্রতিমার বড় মেয়ে রাখী পোদ্দার ইলেকট্রনিক্স নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন। ২৪ বছরের রাখীও বাবা-মার উৎসাহে শিখেছেন বাস চালাতে। খেলাধুলোতেও দারুণ আগ্রহ তার। ছোট মেয়ে সাথী পোদ্দার এবারে উচ্চ মাধ্যমিক দেবে। দুই মেয়েরই অনুপ্রেরণা মা প্রতিমা পোদ্দার এবং বাবা শিবেশ্বর পোদ্দার।
সকাল থেকেই রোজ কর্মব্যস্ত জীবন শুরু হয় পোদ্দার বাড়িতে। রাত থাকতে থাকতেই সাড়ে তিনটের সময় ঘুম থেকে উঠে পড়েন পোদ্দার দম্পতি। নিমতা-হাওড়া রুটে দিনে তিন থেকে চারটি ট্রিপ চালান তারা। সারাদিনে যা আয় হয়, তেল খরচ এবং গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বাদ দিয়ে অভাবের সংসার চলে যায় তাদের।
প্রতিমার কথায়, ‘স্বামীর সাহায্য না পেলে এ কাজ হত না। তবে আমার শ্বশুরবাড়ির অনেকেই আমার বাস চালানো মেনে নেননি। কেউ বুঝতেই চান না যে, পুরুষদের অপমান করতে আমি মিনিবাস চালাই না। ওই মেয়েরাও পুরুষদের অপমান করতে অটো চালাতে চাইছেন না। আমরা বাস-অটো চালানোর কথা ভাবি, কারণ এটা আর পাঁচটা পেশার মতোই আর একটা পেশা।
স্টিয়ারিং’ প্রতিমা যখন পূজার মূল থিম
২০১৯ সালের এক এমন এক কাণ্ড ঘটলো, পুরো বিষয়টাকে তিনি অবিশ্বাস্যও বলছেনা তাকে ঘিরে কলকাতার একটি মণ্ডপের মূল থিম করা হয়েছিল। নব্বইয়ের দশক থেকেই দুর্গাপূজার একেকটা মণ্ডপ সাজানো হয় কোনো একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে। ২০/৩০ বছর আগেও সেগুলোকে বলা হতো ‘আর্টের ঠাকুর’ আর চিরাচরিত, পুরাণে আখ্যায়িত রূপে যেসব প্রতিমা তৈরি হত সেগুলো ‘সাবেকী ঠাকুর’।
এরপর বিষয়টা আর শুধু প্রতিমা তৈরিতে সীমাবদ্ধ থাকল না। প্রতিমা-মণ্ডপসজ্জা-আলোকসজ্জা, সব মিলে গড়ে উঠত একটা বিষয়কেন্দ্রিক ভাবনা। সেটারই চালু নাম ‘থিমের পূজা’।
সাধারণত কোনো চলতি সামাজিক বিষয় বা ক্রীড়া ক্ষেত্রের কোনো বিষয়, অথবা কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি বা কোনো সময়ে
আবার রাজনৈতিক-কূটনৈতিক এসব বিষয়ও উঠে আসে ‘থিমের পূজা’য়। কিন্তু কখনো প্রতিমা পোদ্দারের মতো একেবারে সাধারণ নারী পুজার ‘থিম’ হয়ে উঠেছেন, এমনটা আগে শোনা যায়নি। বিষয়টি নিয়ে প্রতিমা বলেন, ‘যখন এরা প্রথম জানালেন যে আমাকে পূজার থিম করতে চান তারা, খুব অবাক হয়েছিলাম। এর আগে কয়েকটা টিভি অনুষ্ঠানে গিয়েছি- তাই অনেক মানুষ হয়তো আমার কথা জানেন। কিন্তু পূজার থিম হব আমি- এটা খুব অবাক করেছিল।’
প্রতিমা পোদ্দার কলকাতা শহরে খুবই পরিচিত একজন। যে পূজাতে প্রতিমা পোদ্দারকে থিম করা হয়েছে, তা এক দেখাতেই চিনে ফেলবেন যে কেউ। পূজার ওই প্যান্ডেলে রয়েছে মিসেস পোদ্দার যে বাসটি চালান তার প্রতিকৃতি, রুট ম্যাপ আর আস্ত একটি মূর্তি। পুরো মণ্ডপেই ছড়িয়ে আছে নারীশক্তির এই জীবন্ত চিহ্ন। এর মাধ্যমে পুরুষকেন্দ্রিক দুর্গাপূজার চিরাচরিত প্রথা ভেঙেছে।
মাস কয়েক আগেই পেরিয়েছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীদের সাফল্যের বহু কাহিনি ছড়িয়ে পড়েছে এই বিশেষ দিন উপলক্ষে। কিন্তু সেই অর্থে আলাদা করে কোনো ‘সাফল্য’ অর্জন না করলেও, এ সমাজের পুরুষশাসিত একটি পেশায় যেভাবে দাপিয়ে রাজত্ব করছেন, তা পুরো এপার-ওপার বাংলায়ও উদাহরণ-স্বরূপ। পুরুষদের থেকে মেয়েরাও যে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই, তা যেন হাতেকলমে প্রতিনিয়ত দেখাচ্ছেন প্রতিমা। প্রতিমা নিজেও তাই চান, যে যেমন পেশাতেই যেন নিজের অধিকার ও দাপট প্রতিষ্ঠা করতে পারেন প্রতিটি নারী।