একটোপিক প্রেগনেন্সিতে হতে পারে নারীর অকস্মাৎ মৃত্যু
প্রত্যেক নারীর জীবনে মা হওয়া যেমন আনন্দময় তেমনি
আশীর্বাদসম। মা হওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটিতেই নারীকে অতিক্রম করতে হয় শারীরিকভাবে একটি বিরাট ঝুঁকির
মধ্য দিয়ে। প্রেগন্যান্সি বা গর্ভধারণ কোনো সহজ বিষয় নয়। যদিও গর্ভধারন প্রক্রিয়াটি একজন নারীর জীবনে পরিপূর্ণতা নিয়ে আসে, কিন্তু কখনও কখনও জটিলতার কারনে গর্ভধারণ প্রক্রিয়াটি একজন নারীর জন্য জীবন সংশয়ের কারন হয়েও দাঁড়াতে পারে। একটোপিক প্রেগনেন্সি বা টিউবাল প্রেগনেন্সি যা নারীর জীবনে গর্ভধারণে অত্যন্ত জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। মেডিকেল সাইন্সের পরিসংখ্যান অনুসারে একটোপিক প্রেগনেন্সির শিকার হতে পারে প্রতি ১০০০ জনের মধ্যে ১১ জন নারী।
এই অস্বাভাবিক প্রেগনেন্সি একদিকে যেমন বিরল আবার ঠিক একই সাথে অত্যন্ত বিপদজনক। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব না হলে ঘটে যেতে পারে অকালে প্রানহানির মত ঘটনা। একটোপিক প্রেগন্যান্স কাকে বলে এমন প্রশ্নের উত্তরে গাইনেকোলজিস্ট ডাক্তার মমতাজ উদ্দিন বলেন, গর্ভধারণের সঠিক অংশে গর্ভধারণ না করে জরায়ুনালি এবং ওভারিতে গর্ভধারণ করাকে একটোপিক প্রেগন্যান্সি বলা হয়।অর্থাৎ যদি কোনো জটিলতার কারনে ভ্রূণটি জরায়ুতে প্রতিস্থাপিত না হয়ে অন্য কোথাও প্রতিস্থাপিত হয়ে বেড়ে উঠতে থাকে তাকে বলা হয় একটোপিক প্রেগনেন্সি। সাধারনত একটোপিক প্রেগনেন্সির ৯০ ভাগ ক্ষেত্রেই ভ্রূণ ফ্যালোপিয়ান টিউবেই প্রতিস্থাপিত হয়ে থাকে। তবে এটি ফ্যালোপিয়ান টিউব ছাড়াও ডিম্বাশয়, সারভিক্স বা পেটের ভিতরস্থ যেকোনো স্থানে বেড়ে উঠতে পারে। ভ্রূণ যখন ফেলোপিয়ান টিউবে প্রতিস্থাপিত হয়ে যায় তখন থেকেই জটিলতার ঠিক শুরু। কারণ বাড়ন্ত ভ্রূণকে ধারন করার পর্যাপ্ত জায়গা এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবারহ করার মতো ব্যাবস্থা ফেলোপিয়ান টিউবে নাই যা আছে শুধুমাত্র জরায়ুতে। ফলে ভ্রূণকে ধারণ করতে না পেরে ফেলোপিয়ান টিউব ফেটে তীব্র ব্যাথাসহ প্রচুর রক্তক্ষরণে মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। অনেকে অসচেতনতাবশত প্রেগনেন্সি স্ট্রিপে পজিটিভ আসার পরও ডাক্তারের কাছে যান না। ফলে ভ্রূণ কোথায় আছে জানার জন্যে কোন ধরণের পরীক্ষা প্রয়োজন কিনা সেটি জানাও হয়না সেক্ষত্রে একটোপিক প্রেগন্যান্সির ঝুঁকি দেখা দেয়ার সম্ভাব্য সম্ভাবনা থাকে।
একটোপিক প্রেগনেন্সির কারণ
- যাদের একবার একটোপিক প্রেগনেন্সি হয়েছে তাদের বাবারও আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা ১০ গুন বেড়ে যায়।
•কোনো সংক্রমণ, প্রদাহ অথবা যে কোন কারনে ফ্যালোপিয়ান টিউব যদি আংশিক অথবা পুরোপুরিভাবে বন্ধ হয়ে গেলে এই ধরনের প্রেগন্যান্সির ঝুঁকি থাকে।
- ফ্যালোপিয়ান টিউব অথবা পেলভিক এরিয়াতে যদি আগে কোনো অপারেশান করা হয়ে থাকে তবে একটোপিক প্রেগনেন্সি হবার সম্ভাবনা থেকে যায়।
- ফ্যালোপিয়ান টিউব এর আকার জন্মগতভাবে স্বাভাবিক এর চেয়ে ছোট হয়ে থাকলে টিউবাল প্রেগন্যান্সি হবার আশংকা থাকে।
- টেস্ট টিউব বেবি নেবার ক্ষেত্রে অথবা ফার্টিলিটি বৃদ্ধির ঔষধ খলে একটোপিক প্রেগনেন্সি হবার সম্ভাবনা থাকে।
- গর্ভধারণের সময় কপার-টি পরা অবস্থায় থাকলে একটোপিক প্রেগনেন্সি হতে পরে।
- পেলভিক ইনফ্লামেটরি ডিজিজ থাকলে একটোপিক প্রেগনেন্সির সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে।
- যৌনবাহিত রোগ যেমন, গনোরিয়ায় আক্রান্ত হলে একটোপিক প্রেগনেন্সি হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
- ইমারজেন্সি কন্ট্রাসেপটিভ ব্যবহারের ফলে একটোপিক প্রেগনেন্সির সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
একটোপিক প্রেগনেন্সির লক্ষণ
একটোপিক প্রেগনেন্সিতে প্রাথমিক অবস্থায় বোঝার তেমন উপায় নেই। রাপচার বা ডিম্বনালী ফেটে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এর তেমন উল্লেখযোগ্য কোন লক্ষণ প্রাকাশ পায় না, যার কারনে এই গর্ভাবস্থা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটু বেশি বিপজ্জনক।
গর্ভধারণের লক্ষণ বোঝার আগেই অর্থাৎ ১ম পিরিয়ড মিস হবার কয়েকদিনের মধ্যে ব্যথা শুরু হলে অনেকে এপেন্ডিসাইটিস বা গ্যাস্ট্রিক সমস্যা মনে করে চিকিৎসা নিতে দেরি করে ফেলেন। তবে ডিম্বনালী রাপচার বা ডিম্বনালী ফেটে যাবার আগে এর কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন:
ক) রক্তক্ষরণ শুরু হতে পারে যা কিছুটা নিয়মিত পিরিয়ড এর মত তবে তা কম বা বেশি হতে পারে।
খ) তলপেট এবং পেলভিক এরিয়া তে প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হতে পারে।
গ) ঘাড় এবং কাঁধেও ব্যথা অনুভুত হতে পারে।
ঘ) শরীর খুব দুর্বল এবং মাথা ঝিমঝিম করতে পারে।
ঙ) পেটের ভিতর রক্তক্ষরণের ফলে ব্লাড প্রেশার কমে যাবে। ও পালসও বেড়ে যেতে পারে।
একটোপিক প্রেগনেন্সি চিকিৎসা
স্বাভাবিক প্রেগনেন্সি নির্ণয়ের জন্য ব্লাড ও ইউরিণ টেস্ট এবং আল্ট্রাসনোগ্রাম-ই যথেষ্ট। তবে একটোপিক প্রেগনেন্সির শনাক্তে রোগীর তলপেট, পেলভিক এরিয়া ভালভাবে পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয়। এর সাথে জরায়ু তে কোনো ভ্রূণ বেড়ে উঠছে কিনা বা ভ্রূণের উপস্থিতি আছে কিনা তা পরিক্ষা করে দেখার প্রয়োজন হয়। এসময় এইচসিজি হরমোন এর মাত্রা ও পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয় কারন, সাধারনত একটোপিক প্রেগনেন্সিতে এইচসিজি এর মাত্রা স্বাভাবিক এর থেকে কম হয়। এছাড়া রক্তে প্রজেস্টেরনের মাত্রা পরীক্ষা করেও একটোপিক প্রেগন্যান্সি চিহ্নত করা যেতে পারে।
একটোপিক প্রেগনেন্সিতে করণীয়
যাদের ইতোপূর্বে একটোপিক প্রেগনেন্সির ইতিহাস আছে, বিবাহিত নারী যাদের অনিয়মিত পিরিয়ড হয়, দীর্ঘদিন যাবত বনধ্যত্বের চিকিৎসা নিচ্ছেন তাদের হঠাৎ তলপেটে প্রচন্ড ব্যথা শুরু হওয়া মাত্রই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। আবার প্রেগনেন্ট হওয়ার পরে বাচ্চার অবস্থান জানতে প্রথম দুমাসের মধ্যে একটা প্রেগ্নেন্সি প্রফাইল করতে হবে। কেননা ডায়গনোসিসে নিশ্চিত প্রমান মিলনে এক্টোপিক প্রেগ্রেসি স্যাক রাপচার হওয়ার আগেই অপারেশন না করেও কেবল ঔষধ প্রয়োগের মাধ্যমে চিকিৎসা শুরু করে রোগীর মৃত্যু ঝুঁকি কমানো সম্ভব।