আসামের ব্রহ্মপুত্র নদে মোহময় সন্ধ্যা
বহুবছর আগের কোনো এক সন্ধ্যায় ব্রহ্মপুত্র নদের প্রেমে পড়েছিলাম। দূর। থেকে ভেসে আসা পাখিদের
কলকাকলি। নদীর মৃদু সুরধুনীধারা। মানুষের কলরোল। নদের মধ্যিখানে শম্বুকলতিতে বয়ে চলা নৌকা। কারো যেন কোথাও যাবার কোনো তাড়া নেই। এমন মোহনীয় স্মৃতি নিয়েই ব্রহ্মপুত্রকে এতদিন ভালোবেসেছিলাম। যাবো যাবো করেও দীর্ঘ ৮ বছর দেখা হয়নি মোহময় ব্রহ্মপুত্র তীর আর ময়মনসিংহের জয়নুল উদ্যান।
তবে এবার দেশের বাইরে, ভিন্নপ্রান্তে গিয়ে আরেকটি সন্ধ্যা কাটলো ব্রহ্মপুত্র নদে। এমন স্বর্গীয় সন্ধ্যা জীবনে খুব কমই আসো ভৌগোলিক গুরুত্বের পাশাপাশি নদীর নৈসর্গিক, আন্তাত্বিক ও শৈল্পিক আবেদনও যে উল্লেখযোগ্য। তা টের পাওয়ার জন্য বোনহয় এমন একটি সন্ধ্যাই যথেষ্ট। ভাড়া- গড়ার এই নদীই দেখায় জীবনের সবচেয়ে বড় দর্শন। অনুধাবন করায় মহাজাগতিক যত যাহাকার। নদীর অশান্ত ঢেউ, অবিরাম স্রোত কী এক কারিক আবহা ব্রহ্মপুত্রকে ময়মনসিংহ যতটুকু আপন করে রেখেছে, ভারতের আসামের মানুষও কম নয়। বরং একটু বেশিই। ওয়াহাটি শহরের আনন্দ-বিরহ কিংবা উৎসবযাপন, যার বেশিরভাগই ব্রহ্মপুত্র নদকে ঘিরে। ব্রহ্মপুত্র নদই আসামের মানুষের বেলা-অবেলার দুঃখ-সুখের নিত্যসঙ্গী। এই নদই প্রতিদিন শুষে নেয় অন্তরের যত কষ্ট-কালিমা, দেয় সতেজ হওয়ার মন্ত্র। প্রার্থনায়ও এখানকার মানুষ বেছে নেয় নদের স্বচ্ছ জনকেই। ব্রহ্মপুত্রের জলের বাজনা, নদের স্কুলে বাঁশরির বাঁশির সুর, নৈশব্দ-হাহাকার দিয়ে যায় জীবনের এক অর্বাচীন উপাখ্যান, স্বাপ্নিল কাব্যগাথা আর সিনেমাটিক আবহ।
একদিকে মুগ্ধতা, অন্যদিকে আফসোস
ব্রহ্মপুত্রের মুগ্ধতার বর্ণনা দিতে গিয়ে সেখানে যাওয়ার ঘটনাটাই তো। বলা হচ্ছে নং দীর্ঘ ৮ বছর পর ব্রহ্মপুত্র নদে আরেকটি সময় কাঠিনোর ব্যাপারটা কাকতালীয়। কারণ গুয়াহাটি যাওয়ার কোনো পরিকল্পনাই ছিল না চেরাপুঞ্জি ঘুরে দুই মিনিটের সিদ্ধান্তেই এক ভরদুপুরে গাড়ি নিয়ে চলে অসি গুয়াহাটি। পরদিন কামাখ্যা মন্দির দেখা, এবং গুয়াহাটির আশপাশ একটু ঘুরে দেখাই ছিল পরিকল্পনায়। কিন্তু, সেদিন সন্ধায় কোনোরকম পরিকল্পনার না থাকায় ভাবছিলাম নিরিবিলি কোথাও বলা যায়। ওগণের সাহায্য নিয়ে চলে যাই ‘স্টারবাকাস’।
গুয়াহাটির যেকোনের জায়গা থেকেই অটো নিয়ে স্টারবাকস যাওয়া যায়। স্টারবাকসে ঢুকতেই ২০ কপির টিকিট কাটতে হয়। তবে যে আবহে আপনি প্রবেশ করবেন, তাতে টিকিট কেটে কফি’র রেস্তোরাঁয় যাওয়ার ব্যাপারটা স্কুলেই যাবেন।
আমি যখন ঢুকছিলাম, তখন সূর্য সেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটু এগোতেই চোখে পড়লো ব্রহ্মপুত্র নদের দুর্দান্ত দৃশ্য। পাখিদের ওড়াওড়ি-কিচিরমিচিরা নদীর পানিতে নানান রঙের খেলা। একটু একটু করে নিভে আসছিল আলো। পরিবেশটা হয়ে ওঠে মায়াবী। আলো-আঁধারিতে হঠাৎ ভেসে আসে নারী কন্ঠে সুরেলা আওয়াজ। প্রশ্ন জনে মনে, মামীর এই নির্জনতায় নিজকে উজাড় করে দেয় কোন কোকিলকণ্ঠি?
মতে পছন্দের ব্যাটে কফি নিয়ে নদের তীবে রেস্তোরাঁর চেয়ারে বসলাম। দেখলাম ব্রহ্মপুত্রের বুকে সারি সারি স্টিমার। সবক’টিই টুরিস্ট স্টিমার। পৃথিবীর যেকোনো
প্রান্তে যা-ই না কেন; বেশিরভাগ সময়ই কেন জানি মনে হয় আমরা আমাদের ট্যুরিজম নিয়ে ভাবিই না। এই যেমন আসাম সরকার কত দারুণভাবে ব্রহ্মপুত্র ননকে ব্যবহার করে তাদের টুরিজমকে এগিয়ে নিচ্ছে। কেউই নদী দখলে বস্ত না, ইন্ডাস্ট্রিয়াল বর্জ্য ফেলছে না, যেখানে-সেখানে হকারি নেই। পর্যটকদের জন্য কতশত সুবিধা অথচ, কয়েকদিন আগে শুনলাম আমাদের ব্রহ্মপুত্র দখলে নেমেছে খোদ প্রশাসনও। এসব কথা ভাবতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে পোড়ামন ‘ও নদীরে আমার…’।
ব্রহ্মপুত্রের সুবিস্তৃত ইতিহাস
অথচ প্রহ্মপুত্র নিয়ে আমাদের অনেক বেশি সচেতন হওয়া উচিত। সারাবিশ্বে নদ-নদীর তালিকায় পানি নিষ্কাশনের দিক থেকে নবম এবং দৈর্ঘ্যের হিসাবে পৃথিবীর ১৫ তম বৃহত্তম এই ব্রহ্মপুত্র। এই নদকে ঘিরে রয়েছে সুবিস্তৃত ইতিহাস। পৌরাণিক শাস্ত্র থেকে গুক্ত করে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, ভৌগোলিক অবস্থান এবং কোটি মানুষের জীবনের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত এই নদ। হিমালয়ের কৈলাস শৃঙ্গ থেকে জন্ম নেয়া এই নদ তিব্বতের বুকে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম উপত্যকা পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। আসামের সমতল ভূমিতে ব্রহ্মপুত্র বেশ বিশাল এবং খরস্রোতা নদ। এমনকি শুষ্ক মৌসুমেও নদের প্রশস্ততা গড়ে ৮ কিলোমিটার পর্যন্ত দেখা যায়। আসামের বুকে নদের গতিপথ প্রায়শই পরিবর্তিত হয়। আসাম পেরিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল হয় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের বুকে ব্রহ্মপুত্র নদের প্রবাহ বেশ সংক্ষিপ্ত। এখানে একে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ হিসেবে ডাকা হয়। চিলমারী অতিক্রম করে এই নদ তিস্তা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়। এরপর দক্ষিণে এটি যমুনা নদী হিসেবে প্রবাহিত হচ্ছে। আর ব্রহ্মপুত্রের মূল ধারা জামালপুর এবং ময়মনসিংহ জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ২৪০ বছর আগে ১৭৮৫ সালে রেনেলের তৈরি মানচিত্রে ময়মনসিংহের উপর দিয়ে নদের গতিপথ চিহ্নিত হয়েছে। তখন এটিই ব্রহ্মপুত্রের মূল গতিপথ ছিল। ১৭৮২-৮৭ সময়কালের মধ্যে সঙ্ঘটিত ভূমিকম্প এবং ভয়াবহ বন্যার ফলে এর গতিধারা বদলে যায়। পুরোনো সেই ধারা বর্তমানে ভৈরব বাজারে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
যাহোক, কখনো গুয়াহাটি ভ্রমণে গেলে অন্তত একটি বিকেল রাখা উচিত ব্রহ্মপুত্রের জন্য। আমেরিকান বহুজাতিক কফিহাউস ‘স্টারবাকস’-এর একটি শাখা রয়েছে সেখানে। গুয়াহাটির যেকোনো জায়গা থেকে পান বাজার যাওয়া যায়। পান বাজারের ওল্ড ডিসি অফিসের পাশেই এই চমৎকার জায়গাটি। একই স্থানে একটি ‘হেরিটেজ সেন্টার’ রয়েছে; জাদুঘরটি ঘুরে দেখতে চাইলে ৫০ রুপির আলাদা টিকিট কাটতে হবে।