Skip to content

১৩ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৮শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিশ্বখ্যাত গিনেস বুকের জন্মের ইতিকথা

‘গিনেস বুক ‘ নামটি আমাদের সবারই খুবই পরিচিত। প্রায়ই আমরা কথায় এর ব্যাবহার করে থাকি। অসাধারণ কোন কাজ করতে দেখলে মজা করে আমরা বলে থাকি ” তোমার কাজটি গিনেস বুকে উঠানো উচিত”। তবে মূলত এটি হচ্ছে এমন একটি বই যেখানে আপনি এখন অব্দি সারা বিশ্বে যত বিশ্ব রেকর্ড হয়েছে তার সব এখানে খুঁজে পাবেন, যার নাম ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’।

এই বইটি হচ্ছে মূলত বিশ্বরেকর্ড হলে তা স্বীকৃতি দেওয়ার একটি মানদণ্ড। আপনি যদি কোন বিশেষ কাজে পারদর্শী দেখাতে পারেন যা পূর্বের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে নতুন একটা বিশ্বরেকর্ড করে ফেলে তবে আপনাকে ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’ এর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে স্বীকৃতি নিতে হবে। এই বইতে পৃথিবীর অসংখ্য এবং অদ্ভুত সব বিশ্বরেকর্ড আবদ্ধ করা আছে এবং এখানে নিয়মিত নতুন নতুন বিশ্ব রেকর্ড সংরক্ষণও করা হয়। ইন্টারনেটেও একটি আনুষ্ঠানিক ওয়েবসাইট রয়েছে জিনিস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস এর।

আসুন, জেনে নিন কিভাবে শুরু হয়েছিল এই বইয়ের যাত্রা।
বইয়ের আইডিয়াটা এসেছিল হিউ বিভার নামক এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে,তার বন্ধুদের সাথে একটি বিতর্কের মাধ্যমে।
স্যার হিউ বিভার ছিলেন, ১৯৫০ সালের আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনে এক বিয়ার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘গিনেস’, এর নির্বাহী পরিচালক। তিনি অবসর সময়ে একদিন বন্ধুদের সাথে গিয়েছিলেন ওয়েক্সল্যান্ড কাউন্টিতে। সেখানে তারা পাখি শিকারের আয়োজন করাছিল। বন্ধুদের সাথে স্যার বিভার বন্দুক নিয়ে পাখি শিকার করছিলেন। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হচ্ছিলেন বার বার। পাখিগুলো বন্দুকের গুলি বের হওয়ার সাথে সাথে উড়ে চলে যাচ্ছিল, স্যার বিভার গুলি লাগাতে পারছিলেন না একবারো। হঠাৎ তিনি মনে করলেন, তিনি যে পাখিগুলো শিকারের চেষ্টা করছেন, সেগুলো খুব দ্রুতগতিতে উড়ছে, হতে পারে সেগুলো ইউরোপের সবচেয়ে দ্রুতগামী পাখি। তিনি এর আগেও পাখি শিকার করেছেন, কিন্তু এবারের গুলোর গতি আগের কোনবারের মতো নয়। আগে শিকার করা পাখির চেয়ে অনেক বেশি।
বিষয়টি তিনি তার বন্ধুদেরকে জানালেন। কিন্তু বন্ধুরা তার সাথে সহমত করলো না। শুরু হলো এক বিতর্ক। ‘রেড গ্রুজ নাকি গোল্ডেন প্লোভার’– ইউরোপের সবচেয়ে দ্রুতগতির পাখি কোনটি?– এই নিয়ে তাদের মধ্যে বাদানুবাদ। কিন্তু দু’পক্ষই মুখে মুখে নিজেদের মতকে সঠিক হিসেবে দাবি করলেও কেউই প্রমাণ করতে পারছিল না। কিন্তু স্যার বিভার হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র ছিলেন না। তিনি এবার যার বাসায় আতিথেয়তা নিয়েছিলেন, তার বাসায় গিয়ে তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে খোঁজ শুরু করলেন এই আশায়, যদি এমন কোনো বই পাওয়া যাওয়া যায়, যেটি তার মতামত যে সত্যতা তা ‘রেফারেন্স’ হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু সেখানে হতে হলো তাকে হতাশ । তিনি তেমন কোনো বই পেলেনই না। তিনি ও তার বন্ধুদের বিতর্ক এমন মাঝমাঝি অবস্থাতেই শেষ হয়ে গেলো।

এরপর এই কারণেই স্যার হিউ বিভার এমন এক বই বের করতে চাইলেন যা দিয়ে তিনি এরকম বিতর্কের সত্যতা যাচাই করতে পারবেন, যেটায় পৃথিবীর সমস্ত বিশ্বরেকর্ড লিখা থাকবে। বিতর্কে প্রমাণ না দিতে পারার সীমাবদ্ধতা তিনি ভাঙতে চাইলেন। কিন্তু কাজটি এতটা সহজ ছিল না। শেষমেশ স্যার বিভার নরিস ম্যাকহুইর্থার এবং রস ম্যাকহুইর্থার নামে দুই সাংবাদিক ভাইয়ের কাছে গেলেন। স্যার বিভার যখন এরকম একটি বইয়ের প্রস্তাব রাখলেন, তখন দুই ভাই সেটাতে আগ্রহ প্রকাশ করল। তারাও বুঝতে লাগলো, কাজটা খুব সহজ হবে না। কিন্তু সফলভাবে এরকম একটা বই প্রকাশ করতে তারা খুব আগ্রহী ছিলেন। অবশেষে প্রায় সাড়ে তিন মাস রাতদিন খাটার পর একটি খসড়া বই প্রস্তুত করেন দুই ভাই। এই সাড়ে তিন মাসে নরিস এবং রস সপ্তাহে নব্বই ঘন্টা ধরে কাজ করেছিলেন, রাতদিন এক করে দিয়েছিলেন তারা। ১৯৫৫ সালের ২৭ আগস্ট প্রথম প্রকাশিত হয় ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’।

বইটি প্রথম দিকে প্রকাশিত হতো শুধু ইংল্যান্ডেই পরবর্তীতে চাহিদা বাড়ার ফলে এখন বইটি বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়।

বিয়ার কোম্পানির পাশাপাশি স্যার বিভার চিন্তা করলেন কেননা একটি প্রকাশনা সংস্থাও চালু করা যাক। যথাযথ অনুমোদন পাওয়ার পর ‘গিনেস সুপারলেটিভ’ নামে লন্ডনের ফ্লিট স্ট্রিটে একটি প্রকাশনা সংস্থা খোলা হলো। এবং এই প্রকাশনী থেকেই গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড প্রকাশ করা হয়েছিল। স্যার বিভারের ধারণাও করেন নি যে, বইটি এত বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করবে। মাত্র চার মাসেই বইটির এতগুলা কপি বিক্রি হয়েছিল যে, ইংল্যান্ডে বড়দিন আসার আগেই ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’ বইয়ের গায়ে ‘বেস্টসেলার’-এর ট্যাগ লেগে গিয়েছিল। পুরো ইংল্যান্ডে এই বই নিয়ে এত বেশি আলোচনা হলো যে, প্রথম সংস্করণের সমস্ত বই শেষ হতে খুব বেশিদিন লাগে নি। পরবর্তীতে বইয়ের চাহিদা আরও বাড়তে লাগলো। এরপর স্যার হিউ বিভারকে আর কখনও পেছনে তাকাতে হয়নি।

বইটিতে যে বিশ্বরেকর্ড গুলো লেখা হতো, সেগুলো সম্পর্কে মানুষের জানার আগ্রহ ছিল অনেক। শুধু পড়তেই নয়, বইটিতে মানুষ তাদের নাম তোলার জন্যও অনেকে বিশ্বরেকর্ড গড়ার চেষ্টা করা শুরু করছিল। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের সিনিয়র প্রেসিডেন্ট পিটার হার্পার বলেন, “বইটি যখন ১৯৫৫ সালে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়, তখন এর নাম ছিল ‘গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস বুক’। আমাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো পাঠককে বিভিন্ন বিশ্বরেকর্ড গড়তে উদ্বুদ্ধ করা।”
বইটির প্রকাশক স্যার বিভার অনেক মর্যাদা লাভ করেছিলেন এবং বইটির প্রথম সংস্করণের লেখক হিসেবে নরিস ও রস– দুজনই ইংল্যান্ড ছাড়িয়ে বাইরেও জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
১৯৭২ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তারা বিখ্যাত ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি-র একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করতেন। ২০০১ সালে ‘রস ম্যাকহুইর্থার’ মারা যাওয়ার পর অনুষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়।

আন্তর্জাতিক মর্যাদা পাওয়া এখন এই ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’, যা পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্বরেকর্ডকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। অদ্ভুত অদ্ভুত সব বিশ্বরেকর্ড রয়েছে বইটির ভিতরে। এর মধ্যে কয়েকটি হলোঃ
মার্কিন নাগরিক রয় সুলিভান আটবার বজ্রাহত হওয়ার পরও দিব্যি বেঁচে ফিরে নাম লিখেছেন গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে।
বাংলাদেশের নাগরিক আয়মান মোহাম্মদ এক মিনিটের মধ্যে একটি টাওয়ারে ৭৫টি কয়েন স্তুপ করে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লিখেছেন।

বর্তমানে ‘গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড লাইভ’ নামে একটি শো ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নিয়মিত আয়োজন করা হয়, যে শো-তে সরাসরি দর্শকদের সামনে বিভিন্ন বিশ্বরেকর্ড গড়ার ঘটনা দেখানো হয়। যখন নতুন কোনো বিশ্বরেকর্ড করা হয়, তখন সেটি গিনেস বুক কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক ওয়েবসাইটের ‘হল অব ফেম’ সেকশনে সংরক্ষণ ও প্রদর্শনও করা হয়।

স্যার হিউ বিভারের সাধারণ একটি চিন্তা থেকে জন্ম নেয়া এই বইটি আজ পৃথিবীজুড়ে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বইগুলোর মধ্যে একটি। নতুন ও অদ্ভুত সব রেকর্ড জানার আগ্রহ আজীবন বাঁচিয়ে রাখবে এই বইটিকে এবং হিউ বিভারের নামকে এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ