Skip to content

১৮ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | সোমবার | ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এখনো নারীকেই চাইতে হয়

এখনো নারীকেই চাইতে হয়

আধুনিক নারী উদ্যোক্তা হতে পারেন, হতে পারেন প্রতিষ্ঠিত। আধুনিক সময়ে একজন নারী চাইলেই অনেক কিছুর দিকে হাত বাড়াতে পারেন। কিন্তু এই সম্ভাবনার জন্য তাকেই চাইতে হবে। তার আকাঙ্ক্ষা থাকতেই হবে। অনেকেই বলতে পারেন, আকাঙ্ক্ষা তো সবারই আছে। নারীর ক্ষেত্রে বিষয়টিকে নিয়ে আবার বাড়তি জোর দেওয়া কেন? এর কারণ হন্যে নারীর জন্য সামাজিক বাধার পাশাপাশি কিছু পিছুটানও তৈরি হয়। নারীকে ঘর সামলাতে হবেই। এই সামলানোর বাইরে তারপর বাকি কাজটুকু করতে হবে। সমাজের স্বাভাবিক নিয়মের ছন্দ তো ভাঙা যাবে না। তাই নিরন্তর ক্লান্তিতে নারী ঘর সামলে আবার নিজের প্রতিষ্ঠার পথ দেখেন। এভাবে একটানা কাজ করার যত আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা কতটুকু হতে পারে একবার ভেবে দেখেছেন কি? অনেক পুরুষই অফিস থেকে ফিরে নিজের জামাটা খুলে ভালোভাবে আলনায় টাঙিয়ে রাখতে পারেন না। কিন্তু নারীকে তো অন্যের দায় নিতেই হয় সঙ্গে নিজেরটাও গুছিয়ে রাখতে হয়। সেজন্যই প্রথমে বলা, নারীকে চাইতে হবে। কিন্তু সবখানেই তো নারী চাইতে পারে না। গ্রামীণ সমাজে একজন নারীর জগতটা তো গ্রামের সীমানার বাইরেই যেতে পারে না। তার কাছে জগতটাই এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়া। বাইরে বের হলেও পরিচিত আলপথ বা গ্রামীণ রাস্তা ধরে বাবার বাড়ি যাওয়া নাহয় নিজের স্বামীর ঘরে ফেরা। এইতো।

তবু এখন একটু আনন্দের অবসর আছে। ক্রীড়াক্ষেত্রে নারীদের জয়জয়কার। বিজয়ী এই মেয়েদেরই আবার লাঞ্ছনার মাধ্যমে বাড়িতে ফিরতে হয়। এই মেয়েদের অলিম্পিক বাছাই পর্বে পাঠানোর টাকা জোগাড় হয় না। নারী এখন প্রকৌশল বা বিজ্ঞানের জটিল বিষয়েও অধ্যয়ন করছে। আগে নারী শুধু মেডিক্যালেই পড়তে যেতো। আর পড়তে গেলেও সে সার্জারি বা জটিল কোনো বিশেষজ্ঞ হতেন না। এমন ধারণা তো অনেকেরই। প্রাইমারি স্কুলে কেউ পড়াতে গেলে তা নারীই হবেন। নারীর মেধার মূল্যায়নের জায়গাটিতে আমাদের ধামতে হয় এখন। কারণ সিভিল সার্ভিসেও নারীর দৃপ্ত পদচারণা। রাষ্ট্র পরিচালনা, রাজনীতি এমনকি উদ্যোগী পরিসরেও নারী আজ নেতৃত্বে। কিন্তু নারীর জীবনের পালাবদল আসে দ্রুত। এখনো সমাজ মায় নারী কারও অভিভাবকত্বের অধীনে থাকুক। আমার এক সহকর্মীর সঙ্গে কদিন আগে কথা হচ্ছিল। তিনি বিয়ের আগেই ব্যাংকে চাকরি পেয়েছিলেন। তবে নতুন নতুন বিয়ে হওয়ায় স্বামী তাকে বোঝায়, এক দূরে ব্যাংকে চাকরিতে না যাওয়াই ভালো। চাইলে পরেও ব্যাংকে চাকরি নিতে পারবেন। কিন্তু ওই সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার পর আর সুযোগ ধরা দেয়নি। ধরা দেয়নি বলেই তিনি এখনো কিছুটা আফসোস করেন। তবে বিষয়টিকে মনে ধরে রাখেন না। তার স্বপ্ন বা চাওয়ার পরিসরে সমন্বয় করতে যাওয়ার এই মানসিক দৃঢ়তা শুধু তার একার না।
প্রায় অধিকাংশ নারীর মানসিকতাই এমন বিধায় নারী সমন্বয়করে।

নিজের পরিবার ছেড়ে যখন সংসার করতে নতুন ঘরে যেতে হয় তখন নারী চাওয়ার চেষ্টা করার আগে গোছানোর কাজেই নিয়োজিত হতে বাধ্য হয়। হাজার সম্ভাবনা থাকার পরও অনেক সময় স্বপ্নকে টুটি চেপে ধরতে হয়। সম্ভাবনা ও স্বপ্নের সমস্যা এখানেই। সময় বত্য কম। একটি নির্দিষ্ট সময়ের গণ্ডিতে এই দুটোকে চর্চায় রাখতে হয়। না রাখলেই বিপদ। তখন কিছুতেই কিছু গুছিয়ে ওঠা হয় না।

রাজধানীতে আমরা নারীর কাজের সম্ভাবনার পরিসর শুনু শিক্ষাক্ষেত্রে বা চাকরির বাজারে দেখেই বিচার করছি। কিন্তু নারীর কর্মস্থর আরো বিস্তৃত। কয়েকটা হতবাক করা তথ্য এবার স্বাভাবিক করা যাক। করোনার সময় এক নারী ফুডপান্ডা অলকের সংবাদ পাওয়া গিয়েছিল। আরও আগে নারী রিকশাচালক দেখা গিয়েছিল। এখন নারী লেগুনা চালকও দেখা যাচ্ছে। শ্রমের জগতে নারীর এই অবস্থান আগেও ছিল।
হয়তো রিকশা চালানো ছিল না। তবে ভ্যানগাড়ি ঠেলার ক্ষেত্রে নারীকে দেখা গেছে। এমনকি বাড়ি বাড়ি সিটি করপোরেশনের ময়না আনার কাজেও গাড়ির সঙ্গে নারীর অবস্থান ছিল। আমরা সামাজিকভাবে নারীর এই অবস্থানকে কাজ হিসেবেই দেখতে পারিনি। তাই যখনই সংবাদমাধ্যমে এমন খবর আসে আমরা হতবাক হয়ে পড়ি। অথচ হতবাক হওয়ার মতো কিছুই এখানে নেই। বরং আমাদের সামাজিক স্থবিরতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যেতে পারে। কারণ উন্নত বিশ্বে অনেক নারীই এসব কাজে সম্পৃক্ত থাকে। যেহেতু ওটি উন্নত বিশ্ব তাই ওখানে নারী এমনটা করতে পারে আর আমরা অনুন্নত বলে নারী এখানে তা করতে।

পারবে না? যদি আমরা অনুন্নত অবস্থাতেই তা শুরু করতে না পারি তাহলে উন্নত হওয়ার সম্ভাবনাটা থাকলো কোথায়? সামাজিক জ্বরে স্ববিরোধিতার চর্চার কারণে এসব প্রশ্নের বিশ্লেষণ ও আলোচনা সম্ভব হয় না। অথচ পরিসংখ্যান ভিন্ন গল্পই বলে। এক্ষেত্রে একটি মজার পরিসংখ্যান তুলে ধরা যেতে পারে। বাংলাদেশে বর্তমানে সক্রিয় সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিলান্সার কাজ করেণ। এর মধ্যে ১১ শতাংশ, অর্থাৎ ৭১ হাজার ৫০০ নারী ফ্রিলান্সার কাজ করছেন। ই-গ্ল্যাটফর্মের ডেটা বিশ্লেষণের রিপোর্টে বলা হচ্ছে, অনলাইন কাজে শ্রমিক বা ফ্রিল্ডাধার সরবরাহে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। বিশ্বের মোট বাজারের ১৬ শতাংশ বাংলাদেশের দখলে রয়েছে। এটা বেশ আশা জাগায় মনে ঘরে বসে গৃহিণীরা অবসর সময়ে এসব কাজ করছেন। তারা অন্তত চাচ্ছেন যে কিছু একটা করবেন। তৈরি পোশাক খাতের একজন নারী স্বপ্ন দেখেন বাড়ি ফিরে যাবেন। সেখানে অন্য নারীদের নিয়ে তিনি নিজেই একটি কাপড়ের উদেরগ নিয়ে ফেলেন। সরকার গ্রামীণ অঞ্চলে নারীদের প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। এই প্রশিক্ষণ শহরে জীবনে আমাদের হাসির রসদ। কারণ ওতেন ব্যবহার, ঘর পরিষ্কার, ওয়াশিং মেশিন ব্যবহার, সেলাই মেশিনের কাজ শেখা বা কম্পিউটার অন অফের ফাংশনগুলো প্রশিক্ষণের কি আছে। এই ভাবনাটা ভুল বোঝারেই প্রথমে গ্রামীণ নারীর জীবনের একটি চিত্র তুলে ধরেছিলাম। যাহোক, জনশক্তি হিসেবে নারীও বাংলাদেশে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা সুপ্ন পরিসরে বোঝানোর জন্যেই এতগুলো উদাহরণ ও পরিসংখ্যান দেয়া।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) তাদের করা গবেষণা রিয়ালাইজিং দ্য ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট ইন বাংলাদেশ প্রমোটিং ফিমেইল লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন’-এ বের করেছে, জিডিপিতে নারীর ভূমিকা ২০ শতাংশ। এটি একজন নারী বছরে যত কাজ করেন, তার মাত্র ১৩ থেকে ২২ শতাংশের হিসাব। বাকি ৭৮ থেকে ৮৭ শতাংশ কাজের বিনিময়ে কোনো মূল্য পান না তারা। তাই ওই কাজের হিসাব জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হয় না। তবে সংসারের ভেতর ও বাইরের কাজের মূল্য ধরা হলে নারীর অবদান বেড়ে দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, এক কোটি ৮৭ লাখ নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা অর্থনীতির বৃহত্তর এই তিন খাতে কাজ করছে। এটি যুক্ত হলে জিডিপিতে নারীর অবদান হতো পুরুষের সমান কিন্তু নারীর শ্রমের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কোনো মূল্যায়নই সম্ভব হয়নি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীরা চরম মজুরি বৈষম্যের শিকার। পর্যাপ্ত যোগ্যতা থাকার পরও নারীর জন্য চাকরিতে ভিন্ন পদ করা হয় বেতন কম দেয়ার জন্য। অনেক খাত শুধু নারী নির্ভর কারণ নারীকে কম মজুরি দিতে হয়। যেমন বগুড়ার সেমাই শিল্প। এখানে নারী শ্রমিকদের প্রাধান্য বেশি। আর এই নারীরা বাড়তি আয়ের জন্য নামমাত্র মজুরিতে কাজ করেন। কারণ তারা তো জানেন না কতটা আদের শ্রমের মূল্য। যা আসে আতেই হয়। অন্য সকল বিষয়ের পরিবর্তন হলেও আরেকটি বিষয় বরাবরই একই থাকছে তা হলো, চাকরি, কর্মসংস্থান ও কর্মক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়। এখনো আমাদের সমাজে অনেক ক্ষেত্রেই মূলত পুরুষদের শ্রমশক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। নারীদের বিশেষ বাস্তবতাকে বিবেচনা করা হয় না। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নারীরা কম মজুরি ও প্রযুক্তি প্রমের সঙ্গে যুক্ত আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী নারীদের সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয় না। যেখানে নারীরা চরমভাবে মজুরি বৈষম্যের শিকার। অবশ্য দেশে কোনো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানই গড়ে ওঠেনি। গড়ে উঠেনি বলেই এখনও অধিকারের প্রশ্নে জটিলতা রয়ে গেছে। নারীর ক্ষেত্রে অধিকারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিরাপত্তাহীনতার বঞ্চনা।

অথচ আমরা আলোচনা করছি এমন একটি দিনকে কেন্দ্র করে যে দিনটি অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যেই সংগঠিত হয়েছিল। মহান মে ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের রক্তকরা দিন। সারা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দিবসটি পালন করা হয়। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা আট ঘন্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। ওই দিন অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে কয়েকজন শ্রমিককে জীবন দিতে হয়। এর পর থেকে দিনটি মে দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দিনটি শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের চরম আত্মত্যাগে ন্যায্য অধিকার আদায়ের এক অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনটিতে আজো আমরা নারির এই অদম্য শক্তির উপেক্ষাকে নিয়ে আলোচনা করি। বর্তমান বিশ্ব পুঁজিবাদি জ্বরে আক্রান্ত। তারপরও মানুষের সুযোগ-সুবিধা ও অস্তিত্ব বিপন্ন না হওয়ার আলোচনা আছে। থাকতেই হয়। সেখানেও আমাদের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো নয়। এখনও আমাদের দেশে নারীকে নিজের পেশার নির্ধারক হতে হয়। কারণ নারীকে চাইতে হয়। নারীকে পথ দেখিয়ে দেয়া হয় না। বরং কোন পথে যাওয়া উচিত না সেটাই বারবার বলা হয়। কিন্তু শৃঙ্খলিত হওয়ার পর নারী কুহেলিকা আপন শক্তিতে এগিয়ে যায়। এটি আশার সংবাদ। কিন্তু বর্তমান বৈশ্বিক সংকট কোনো রাষ্ট্রকে আশায় থাকার মতো পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে না। বরং রাষ্ট্রকে যুথবদ্ধ হওয়ার তাগাদা দিচ্ছে। মহান মে দিবসের সময়ে তাই দেশের অর্ধেকের বেশি (সর্বশেষ জনজরিপ অনুসারে দেশে নারী বেশি) জনশক্তিকে স্থবির রাখণে এই সংকটের যুথবদ্ধ প্রয়াস সফল হবে কিভাবে।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ