Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সংখ্যায় নারী বেশি হলেও শ্রমে সুযোগ কম

নারীর ক্ষেত্রে প্রচলিত প্রবাদটিকে একটু উল্টে দিতে হয়। উল্টে দিতে হয় দেশের সর্বশেষ জনশুমারি এবং গৃহগণনার ফলাফল দেখে।
জনশুমারির ফলাফল বলছে, পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা ১৬ লাখ ৩৪ হাজারের বেশি। আবার কর্মক্ষম হিসেবে ১৫ থেকে ৫৯ বছর বা ২৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশি। জনসংখ্যাবহুল আমাদের এই দেশে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার অবারিত দাড় জনশক্তি। কিন্তু এন্ড সত্য, আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি হওয়ায় এখানকার জীবনযাপন ব্যাহত হচ্ছে নানা প্রক্রিয়ায়। এই প্রক্রিয়া নিয়ে আমাদের অভিযোগ থাকতেই পারে। কিন্তু দেশের অর্থনীতি যে এগিয়ে চলেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে জনশক্তি বা দক্ষ জনসম্পদ জরুরি। সেক্ষেত্রে নারী-পুরুষ ভেদাভেদের প্রশ্ন আসাটা অনেক সেকেলে ধারনা। আমরা এখন আর সত্তরের দশকের বাংলাদেশ নই। কিন্তু আমাদের উপনিবেশিক মন আটকে রেখেছে অনেক ভ্রান্ত ধারণায়। তার প্রতিফলন আছে অর্থনীতিতে, সমাজে এবং শ্রমের বণ্টনেও।
চলতি বছর বিআইডিএসের এক সেমিনারে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ কম। এর মধ্যে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নতি, নারীশিক্ষার হার বৃদ্ধি, জন্মহার হ্রাস- এসব অগ্রগতি সত্ত্বেও শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ আনুপাতিক হারে বাড়েনি। বরং তা এক জায়গাতেই অনেক দিন স্থবির ছিল। বাংলাদেশে ১৯৭০-এর দশকে জন্ম নেওয়া নারীদের ৩৬ শতাংশ এখন শ্রমশক্তিতে আছেন। ১৯৯০-এর দশকে জন্মগ্রহণ করা নারীদের ক্ষেত্রে তা আরও কম, মাত্র ১৩ শতাংশ। এর পেছনে সামাজিক রীতিনীতি ও মানদন্ডের প্রভাব আছে। দক্ষিণ এশিয়ায় উন্নয়নের সঙ্গে এখানকার নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই অঞ্চলের নারীরা অর্থনৈতিক সুযোগের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছেন। তাঁরা বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছেন, আবার যোগাযোগ, সামাজিক যোগাযোগ, সম্পদের মালিকানা-এসব ক্ষেত্রেও পিছিয়ে আছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের মানদণ্ড অনুযায়ী শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের বিষয়টি মেলানো যায় না। হান্স টিমার বলেন, সমাজের গভীরে প্রোথিত রীতিনীতির কারণে নারীরা পিছিয়ে পড়ছেন, বিশেষ করে পরিবারের শ্রমের বিভাজন এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে।

অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহন কমার বিষয়টি এখন আর সামাজিক রীতিনীতির বিষয় নয়। বরং সমস্যাটি অর্থনৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক। নারীকে সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে। তাকে শিক্ষার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার মান কি নিশ্চিত হয়েছে? কোনো মেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। সরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি হলে তার খরচ কম লাগে। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নত না হওয়ায় ক্রমান্বয়ে শিক্ষার প্রতিযোগীতায় অকে পিছিয়ে যেতে হয়। ফলে শিক্ষার সচেতন একটি দিক অর্থাৎ আত্মসাবলম্বী হয়ে ওঠার প্রবণতা তার মধ্যে গড়ে উঠতে পারে না। তাকে হয়ে উঠতে হয় আরও জটিল সমস্যার মুখোমুখি। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা এখনও অনেক মেয়ের বিয়ের যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত। যদিও বিষয়টি শহরাঞ্চলে কম। তবে গ্রামীন অঞ্চলে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে দশম শ্রেণী পাশ স্বাভাবিক।

বিগত কয়েক বছরে নারীর যদি শ্রমখাতে অংশগ্রহন বাড়ে তাহলে তা অনানুষ্ঠানিক খাতে। দেশের ৮০ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাত। আর এই অনানুষ্ঠানিক খাতের মধ্যে কম মূল্যের শ্রমে নারী নিয়োজিত। ঈদের আগে আমরা অনেক খুশি হয়ে সংবাদমাধ্যমে চোখ রেখে দেখেছি, বগুড়ায় সেমাই শিল্পে নারীর অংশগ্রহন। দৈনিক ২০০-২৫০ মজুরিতে ভাবা এই শিল্পকে জিইয়ে রেখেছেন। মাত্র ২০০ টাকা মজুরি। নারীদের আর কাজ নেই বলে তারা বাড়তি হিসেবে এই কাজে আসছেন। এই নারীদের নিজেদের শ্রমের মূল্যটুকুই বোঝার ক্ষমতা হয়নি। কারণ না করলে নাই। অনানুষ্ঠানিক খাত এমনই। আমাদের দেশে কৃষিখাত, শিল্পখাত এবং রেমিট্যান্স এই তিনটি জায়গায় শ্রমিকের অংশগ্রহন অনেক। শিল্পখাতে গার্মেন্টস, কুটির, তাঁত, পোশাকখাত ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীদের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প আছে। নারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। দেয়া হচ্ছে। তাদের আজ ওয়াশিং মেশিন পরিচালনা এবং ঘরের স্মার্ট টেকনোলজি চালানর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তারা মেইড হতে পারে। কিন্তু এই প্রশিক্ষণও তাকে কম মূল্যের শ্রমেই নিয়োজিত করে। ফ্রিল্যান্সিং খাতে নারীর অংশ বাড়ছে। ই-কমার্সে বাড়ছে। তবে এ বিষয়ে তাদের পর্যাপ্ত সহযোগীতা ও ঋণের ব্যবস্থা কই? একজন শ্রমিকের যে ন্যায্য পাওয়া ও হিস্যা তা কি নারী পান?
বিশেষত অনানুষ্ঠানিক খাতে তাকে কাজ করতে হলে তো কথাই নেই। শস্য মাড়াই, সংরক্ষণ ও গোছানোর মতো কাজ তাদের করতে হয়। শিল্পখাতেও হেভি মেশিনারি পরিচালনার কাজটিতে নারীর সুযোগ কম। এইযে লিঙ্গভিত্তিক অসমতা এটি অবশ্যই একটি বড় সমস্যা। আমাদের যথেষ্ট জনশক্তি রয়েছে। কিন্তু দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের পরিকল্পনায় বিরাট ঘাটতি রয়ে গেছে। এই ঘাটতি পূরণ করতে না পারলে আমরা কোনোদিন নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে পারব না। বরং নারী পিছিয়ে থাকবে। শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহন নিয়ে সম্প্রতি আলোচনা শুরু হয়েছে। বিষয়টি নতুন মাত্রা পেতে শুরু করেছে। এখন থেকেই বিষয়টাকে আলাদা গুরুত্ব দেয়া জরুরি। নাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকেই এগুবে। কারণ একের লাঠি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে টিকে আছে। নারী দশের বোঝা হয়ে টিকে আছে তার নিজের কারণে নয়। বরং অর্থনৈতিক কাঠামোর বৈষম্য তাকে বোঝা বানিয়ে রেখেছে।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ