আমের যত কথা
আম অন্যতম রসালো ফল। গরমকে সবাই অপছন্দ করলেও আমের জন্য কিন্তু ঠিকই অপেক্ষা করে। আম যে শুধু পছন্দের শীর্ষে তা নয়। আম একটা অনুভূতির জায়গায়ও বটে। আম পছন্দ করে না এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আম বিশ্বের সেরা ফল। স্বাদে, গন্ধে আর পুষ্টিমান বিবেচনায় কোনো ফলই এর সমান নয়। তাইতো আমকে বলা হয়, ‘ফলের রাজা’।সেই পাঁচ হাজার বছর আগেই সিন্ধু নদের তীরে আমের স্বাদ আস্বাদিত হয়েছিল এমন প্রমাণ নাকি আছে ইতিহাসের পাতায়।
তবে আমের আদি বাড়ি জানেন কোথায়?
যে আমের জন্য সারা পৃথিবী পাগল সেই আমের জন্য পৃথিবী ঋণী পূর্ব ভারতের কাছেই। বিজ্ঞানীরা বলছেন আসাম থেকে ব্রহ্মদেশ মানে আজকের মায়ানমার। এই হচ্ছে আমের আদি জন্মভূমি । এখানকার গহীন অরন্যে না জানি কতদিন মুখ লুকিয়ে বসেছিল কিন্তু যার এত রুপ এত গুণ তার খবর আর কি করে গোপন থাকে বলুন। কিন্তু আমবিজ্ঞানী ও বিশারদদের তথ্য–তালাশে সে সব যুক্তিতক্ক তেমন ধোপে টেঁকেনি। কমপক্ষে ৬০০০ বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে আমের চাষ হচ্ছে। আর এইযে আজ আমরা আম আম বলে যাকে ডাকছি এই আম কথাটা আসলে এসেছে আম্রফল থেকে, তবে এটি সঠিক তথ্য নাকি মিথ্যে তা বলা খুব কঠিন। এছাড়াও কে কখন একে যে নামে ডেকেছেন সেটা ই রয়ে গেছে। পেকে গাছ থেকে খসে পরে যায় বলে তার দেওয়া হয়েছিলো চ্যুত। রসে রসময়ী বলে কখনো তার নাম রসালো। কেউ ডাকে সোমধারা, কখনো নৃপপ্রিয় কখনো প্রিয়ন্কু, মধুলী, মাদাঢ্য সুমদন, কামশর কামাঙ্গ কীরেষ্ট কোকিলবাস আরও কতো যে আছে। ইংরেজিতে ডাকি আমরা ম্যাংগো আবার পর্তুগিজে ম্যাংগা। প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন শুত্রে আমের উল্লেখ নানাভাবে পাওয়া যাচ্ছে। কোথায় এবং কিভাবে তা হলো দেখার বিষয়। ভারতে আমের অস্তিত্বের সবচেয়ে পুরোনো প্রমাণ মিলেছে মেঘালয়ের গারো পাহাড়ে। যেটা পাওয়া গিয়েছিলো আজ থেকে ৬০ মিলিয়ন বছর আগে। বইপত্রে খুজতে গেলে আমের কথা খুজে পাবেন আজ থেকে প্রায় ৩ হাজার বছর আগে। এমনকি রামায়ণে বহুবার এসেছে আমের কথা। আম উল্লেখিত হয়েছে পবিত্রতার সঙ্গে। সোনা যায় যে গৌতমবুদ্ধকে তার এক শীর্ষ আম বাগান দান করেছিলেন। গৌতমবুদ্ধ সেখানে গাছের তলায় বিশ্রাম নিতেন ধ্যান করতেন। তার হাতেও নাকি একটি আম গাছ জন্ম নিয়েছিলো সোনা যায়। তাই আম গাছকে জ্ঞান ও শান্তির প্রতিক বলে মনে করেন। আবার ধনৈষী দেবী অম্বিকার হাতে আমের পল্লব দেখতে পাওয়া যায়। তাই আম তাদের কাছে ঐশ্বর্যের প্রতীক। অজন্ত ইলোরা’র গুহা চিত্রে সেকারণেই আম গাছের দেখা মিলে। দিল্লির ফিরোজ সহা যে অসস্থম্ব রয়েছে সেখানেও আমের কথা রয়েছে। আর পানি নির লিখাতেও বহুবার এসেছে এই আমের প্রসংগ। শুধু এখানেই নয় বিভিন্ন সময় ভারতে আসা মেগাস্তিনিস, হিউয়েন সাঙ, ইবন বতুতা দের লেখায় আমের প্রসংসা রয়েছে ভড়ে ভড়ে।চীন পর্যটক হিউয়েন সাং ৬৩২ থেকে ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এ অঞ্চলে ভ্রমণে এসে বাংলাদেশের আমকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত করেন। তারপর মধ্যযুগে আকবর জাহাঙ্গীর এদের সকলের জীবনিতে আম একেবারে আমবাত হয়ে আছে।
জানা যায়, মোগল সম্রাট আকবর ভারতের শাহবাগের দাঁড়ভাঙায় এক লাখ আমের চারা রোপণ করে উপমহাদেশে প্রথম একটি উন্নত জাতের আম বাগান সৃষ্টি করেন। আমের আছে বাহারি নাম বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদ। ফজলি, আশ্বিনা, ল্যাংড়া, ক্ষীরশাপাতি, গোপালভোগ, মোহনভোগ, জিলাপিভোগ, লক্ষণভোগ, মিছরিভোগ, বোম্বাই ক্ষীরভোগ, বৃন্দাবনী, চন্দনী, হাজিডাঙ্গ, সিঁদুরা, গিরিয়াধারী, বউভুলানী, জামাইপছন্দ, বাদশভোগ, রানীভোগ, দুধসর, মিছরিকান্ত, বাতাসা, মধুচুসকি, রাজভোগ, মেহেরসাগর, কালীভোগ, সুন্দরী, গোলাপবাস, পানবোঁটা, দেলসাদ, কালপাহাড়সহ চাঁপাইনবাবগঞ্জে পাওয়া যায় প্রায় ৩০০ জাতের আম। তবে অনেকগুলো এখন বিলুপ্তপ্রায়।
৩২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ আলেকজান্ডার যখন ভারতে এসেছিলেন সোনন যায় তিনি আমের প্রেমে পরেছিলেন। দিল্লির সুলতান জালালউদ্দিন, আলাউদ্দিন সকলেই আম ভিষন পচ্ছন্দ করতেন। মুঘল সাম্রাটরা প্রত্যেকেই আম খেতে ভালোবাসতেন। বাবার যখন প্রথম ভরতে আসেন তখন তাকে আম দিয়েই সমাগত জানানো হয়েছিলো। আর প্রথম সাক্ষাৎ এই বাবার আমের প্রেমে পরেন তা তিনি লিখে গেছেন তার বাবরনামায়। বাবরের পুত্র হুমায়ুনও আম খেতে খুব ভালোবাসতেন। এ নিয়ে একটি গল্পও রয়েছে হুমায়ুনকে চৌষার যুদ্ধে পরাজয় করে সেই জয়কে সের সাহ একটা আমের নামকরণ করেন চৌষা এ বেপারটা কানে লেগেছিলো হুমায়ুনের এ নিয়ে তিনি ভেবেছিলেন তিনি যদি আবার দিল্লি দখল করতে পারেন তাহলে তবে এর জবাব দেবেন। এবং এই কথা রেখেছিলেন তিনিও তখন একটি প্রজাতির নামকরণ করেন হুমায়ুন পাসান্দ নামে। জাহাঙ্গির ও নুর জাহান দুজনেই আম খেতে ভিষণ ভালোবাসতেন মধ্যপ্রাচ্যে নুর জাহান নামে আমও পাওয়া যায়। সেই আমের এক একটার ওজন ২ বা ৩ কেজি। তারপর শাহজাহান এর পুত্র যখন আগ্রাদুরকে বন্দী করে রেখেছিলেন শাহজাহানের অন্যতম আপসোস ছিলো যে তিনি ইচ্ছে করলেও আর আম খেতে পারবেন না। মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের স্বাস্থ্যের অবনতির অন্যতম কারণ অতিমাত্রায় আম এবং লাল মরিচে আসক্তি, এ কথা লিখে গ্যাছেন খোদ ইতিহাসবিদ পারসিভ্যাল স্ফিয়ার। লালকেল্লার ভিতরে বাহাদুর শাহ জাফরের বাদশাহি বাগিচা ‘বাগ-ই-হায়াৎ-বক্শ’-এ ছিল দেশি-বিদেশি আমের সম্ভার! এই বাগিচায় নবাবের সঙ্গী হতেন আরেক দিলখোলা কবি মানুষ— মির্জা আশাদুল্লা বেইগ খান ‘গালিব’! শুধু মুঘল বাদশাহরাই নয় আমির খশরু থেকে মির্জাগালিব আমের প্রেমে সকলেই ছিলেন মসগুল। আমির খশরু বলেছিলেন এটি সবচেয়ে সুন্দর ফল। আর গালিবের সায়েরীতে লিখেছিলেন, ‘আমাকে যদি জিঙ্গেস করা হয় তোমার নেশা কি? জবাবে আমি বলবো আম ছাড়া নেশা করার মতো আর আছেটা কি।’
রাজা-বাদশারা শুধু আম গাছ লাগানোই বা আম খাওয়া ই নয় সেকালে কিভাবে আম সংরক্ষণ করা যায় তারও উপায় বের করে ফেলেছিলেন। আইনি আকবরিতে লিখা আছে একটা আধ পাকা আমের বোটা কমপক্ষে দু আঙ্গুল লম্বা রেখে গাছ থেকে প্রথমে পারতে হবে। তারপর বোটার আগা মোম দিয়ে ঢেকে মাখন আর মধুর মধ্যে রাখতে হবে এ অবস্থায় আমের স্বাদ ২ থেকে ৩ মাস অক্ষুন্ন থাকবে।
এবার বলা যাক আমের বিশ্বজয়ী কথা। অর্থাৎ কিভাবে এই আম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরেছিলো। যখন বাইরের কেই আম চেখে দেখেছেন তার অনুভব হয়েছে যে যদি আমাদের দেশেও নিয়ে যাওয়া যায় কতোই না ভালো হবে। আমে মুগ্ধ আলেকজান্ডার অনুরোধ রেখেছিলেন যে কিছু আমের চারা তিনি সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন কিন্তু সে আর হয়ে উঠেনি। মনে করা হিউয়েং সাং ই প্রথম আমকে বহির্বিশ্বে নিয়ে যান। তার মাধ্যমে খ্রিষ্ট সপ্তম শতকে আম পৌছায় চীনে। দশম শতাব্দীর দিকে পার্সিদের সঙ্গে আম পারি দেয় সুদুর পূর্ব আফরিকায়। চতুর্থ দশকে ইবনবাতুদা সোমালিয়ার মেগা দিৎসুতে আম গাছ দেখেছিলেন। পঞ্চদশকে পর্তুগিজরা আসে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দেয়া-নেয়া হয় আমাদের মাঝে তারা যেমন আমাদের দেয় আলু, টমেটো ইত্যাদি এখান থেকে তারা নিয়ে যায় আম। পর্তুগিজরা অনেকবার এ দেশ থেকে সরস ফল আমের চাষকে তাদের দেশে নেওয়ার চেষ্টা করে বিফল হয়েছে। কেননা, আমের আঁটির সতেজতার কাল থাকে খুব কম। তাই জাহাজে করে আঁটি নিয়ে পুঁতে এত দূরে আমগাছ তৈরি করা সম্ভব ছিল না। তাই হয়েছিলো চারা তৈরি ও কলম করার কৌশল আবিষ্কার। এর আগেও ইউরোপে আম পৌছালেও ইউরোপীয়রা আমের প্রেমে পরে পঞ্চদশকের পরই। আনুমানিক ১৭০০ সালে এ উপমহাদেশ থেকে ব্রাজিলে যায় আম। সেখান থেকে ১৭৪০ সালে আমগাছ যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজে এবং ১৭৯৩ এর দিকে পৌছে যায় মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়। জামাইকা আবার আম খেতে পায় জলদস্যুরদের কারণে। তবে ভারতের সঙ্গে মিশরের সুসংযোগ থাকলেও সেখানে পৌছায় আম অনেক দেরিতে। তবে এ আম যেখানে ইচ্ছে সেখানেই যাক না কেন এর খুটি টা কিন্তু আমাদের এখানেই বাধা। আমাদের আবহাওয়া ও আদরে ভালোবাসায় আমের রুপ গুন যা খুলে তার তুলনা সারাবিশ্বে নেই। তাইতো ভারতীয় সাব কেন্টিনেন্টে ১৬০০ রকমের আমের প্রজাতি রয়েছে। বাংলাদেশ সহ আরও কয়েকটি দেশের জাতীয় ফল এই আম। আমাদের দেশে যেসব ফল উৎপন্ন হয় তার মধ্যে আমের জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। আমের নানাবিধ ব্যবহার, স্বাদণ্ডগন্ধ ও পুষ্টিমাণের জন্য এটি একটি আদর্শ ফল হিসেবে পরিচিত। তাই আমকে ফলের রাজা বলা হয় এবং সকল রাজার পচ্ছন্দের ফল এই আম।
এই ছোট্ট ফলটা তার প্রেমে মানুষকে দেশ, কাল, জাত, ধর্ম সমস্ত কিছুর উর্ধ্বে নিয়ে যেতে পেরেছে। তার প্রেমে মুগ্ধ হয়েছে পুরোবিশ্ব। ছড়িয়ে দিয়েছে তার রুপ গুন উপকারিতা ও ভালোবাসা, তাই যদি এই আম পারে তা করতে, তাহলে আমরাও পারি।