নারীর জীবনে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি
বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ জলবায়ুগত ঝুঁকিতে বেশি রয়েছে। মূলত এর ফানেল-আকৃতির দক্ষিণ উপকূল এবং নদীপ্রধান দেশ হওয়ার কারণে এখানে ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস, মাঝারি থেকে উচ্চ লবণাক্ততা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, খরা, অসংলগ্ন বৃষ্টিপাত এবং আকস্মিক বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে অনেক। তাছাড়া ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবেও এই অঞ্চল চিহ্নিত। গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স। (জিসিআরআই) অনুসারে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ শীর্ষ দশ দেশের একটি এবং দীর্ঘমেয়াদি (১৯৯৮-২০১৭) রুকি সূচকে সপ্তম স্থানে রয়েছে।
সম্প্রতি ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনও জানাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও প্রান্তিক পর্যয়ের মানুষ। বাংলাদেশের উপকূলীয় জনপদ, হাওরাঞ্চল, তিস্তা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার বন্যা ও নদীভাঙনপ্রবণ এলাকাগুলোয় বসবাসকারীরা প্রতিনিয়ত জলবায়ু ঝুঁকির মধ্যে বাস করছেন। আকস্মিক দূর্যোগ এই জনজীবনকে স্থবির করে দিতে পারে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু সংবেদনশীল পরিকল্পনা গ্রহনের বিষয়টি নিয়েও আলোচনা বহু পুরোনো। বাংলাদেশের নারীরা নানা অর্থনৈতিক, সামাজিক, শারীরিক সমস্যার সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। গ্লাসগোতে কপ২৬-এর সাইডলাইন ইভেন্ট ‘উইমেন অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ’ শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের এক প্যানেল আলোচনায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ের কারণে বিশ্বের বেশিরভাগ দুর্বল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে
বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নারীরা এর মধ্যে অন্যতম। ওই সম্মেলনে জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলার ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা এবং অবদান নিয়েও অনেক আলোচনা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা এ বিষয়ে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছিলেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নারী ও শিশুর ওপর ব্যাপক সামাজিক প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কারণ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয় জীবন। নগরায়নের ফলে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও আমাদের প্রত্যেকের অবকাঠামো প্রকৃতির সঙ্গে মানানসই হয়ে থাকে। আর আমাদের দেশের গ্রামীন অঞ্চলের জন্য বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় দিন দিন মানুষের কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে। পরিবারের পুরুষরা নতুন জীবিকার খোঁজে স্থায়ীভাবে অথবা বছরে একটি নির্দিষ্ট সময়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। এজবে মৌসুমি অভিবাসন বাড়ছে। ফুড ফর হাংগ্রির অর্থায়নে সেন্টার ফর পিপল অ্যান্ড এনভায়রনের (সিপিই) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, পটুয়াখালী জেলায় ২৭.০৫ শতাংশ, কক্সবাজার জেলায় ৯.০৫ শতাংশ, বরগুনা জেলায় ৩৩.৯ শতাংশ মৌসুমি অভিবাসন হয় জীবিকার তাগিদে। এই অভিবাসনের কারণে নারীর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। অভিবাসিত পুরুধের একটি বড় অংশ বহুবিবাহে জড়িত হয়ে এলাকায় ফিরে না আসার কারণে ডিভোর্সের হার বাড়ছে, বাড়ছে নারীপ্রধান পরিবারের সংখ্যা। গবেষণায় আরও দেখা যায়, বেশিরভাগ মৌসুমি অভিবাসিত মানুষ ইটভাটায় কাজ করে। যেসব পরিবার নারী, শিশুসহ অভিবাসিত হয়, সেসব নারী ও শিশুরা ইটভাটায় কাজ করে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে, পাশাপাশি স্বাস্থ্যের ওপর পড়ছে বড় রকমের প্রভাব। জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোয় দারিদ্র্য বাড়ছে। যে কারণে দরিদ্র পরিবারগুলো অর্থনৈতিক ঝুঁকি কমাতে কন্যাশিশুকে বিয়ে দিচ্ছে। এতে করে বাড়ছে বাল্যবিয়ের হার। সিপিই সম্প্রতি জ্যানিশ রিফিউজি কাউন্সিলের অর্থায়নে খুলনা ও সাতক্ষীরায় পরিচালিত আরেকটি গবেষণায় দেখা যায়, খুলনার দাকোপ ও কয়রায় বাল্যবিয়ের হার ১৮.১৪ ও ৮.৩০ শতাংশ।
উপকূলীয় জেলাগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর লবণাক্ততা ক্রমেই বাড়ছে। লবনাক্ততার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে নারী ও প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর। উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ত পানিতে মাছের রেণু ধরা, খাবারে এবং দৈনন্দিন কাজে অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে নানা ধরনের রোগ বেড়েই চলেছে। হাঁপানি, চর্ম রোগ, লিউকোরিয়া এবং জরায়ু রোগ- এমনকি প্রতিবন্ধী শিশু জন্মহার বাড়ার মতো ঘটনা বাড়ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে, পরিষ্কার পানির অভাবে নারীরা দূষিত লবণাক্ত পানিতে ঋতুস্রাবের কাপড় পরিষ্কার এবং গোসল করতে বাধ্য হচ্ছেন। এসবকিছুর নেতিবাচক প্রভাব সরাসরি প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর পড়ছে। কিশোরীর প্রজনন স্বস্থোর জটিলতার কারণেও এসব এলাকায় কিশোরীদের বাল্যবিয়ে বাড়ছে এবং অল্প বয়সে সন্তান প্রসবের কারণে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন নারীরা। ভেঙে পড়ছে স্থানীয় সামাজিক সুরক্ষা। গবেষণায় জানা যায়, জলবায়ু ঝুঁকিগ্রস্ত এলাকায় নারী ও শিশু পাচার, নারী নির্যাতনের মতো ঘটনা বাড়ছে। নারীর সম্পদ ও সেবায় প্রবেশগম্যতা না থাকা, সমাজ ও পরিবারে সমতা না থাকা, অভিযোজন দক্ষতার অভাব, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সীমিত অংশগ্রহণ অথবা একেবারেই অংশগ্রহণ না থাকা, অভিযোজন পরিকল্পনায় অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি না করা প্রভৃতি কারণে এই ঝুঁকি আরও বেড়ে চলছে। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।