মুক্তিযোদ্ধা নারীদের অবদান যেন আমরা ভুলে না যাই
মুক্তিযুদ্ধে নারী মুক্তিযোদ্ধারা পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলে যুদ্ধ করেছেন। তবে, সাধারণ নারীদের কাজের স্বীকৃতি দিতে সমাজ যেমন কার্পণ্য দেখায়, তেমনি নারী মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দিতেও উদার হতে পারে না।
আমরা জানি, মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু সম্মুখ যুদ্ধকারীই যোদ্ধা ছিলেন না। বরং যারা সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তাদের আশ্রয়দাতা, সেবাদাত্রী, বিভিন্ন পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে যুদ্ধে অংশগ্রহণের মতো অসংখ্য নারী-পুরুষ যুদ্ধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। প্রত্যক্ষ নারী যোদ্ধাদের কিছু কিছু নাম ইতিহাস তন্ন তন্ন করে খুঁজলে পাওয়া যায়। কিন্তু পরোক্ষভাবে যারা যুক্ত ছিলেন, তারা আজ বিস্তৃতির অতল তলেই যেন হারিয়ে গেছেন। নারী তার মনোবল ও শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশের কল্যাণে সর্বস্ব বিসর্জন দিয়েছে। কেউ স্বামী-সন্তান হারিয়েছেন, কেউবা সম্ভ্রম হারিয়েছেন! আবার কেউবা উভয়ই হারিয়ে দেশের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। নিজের মৃত্যুশয্যা রচনার আগে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে কাজ করেছেন!
শত্রুর হিংস্রতা ও নখরাঘাত থেকে দেশকে বাঁচাতে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান অপরিসীম। নারীরা দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতেও পিছপা হননি। আর স্বামী-সন্তানকে আটকে না রেখে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রেরণা জুগিয়েছেন। মুক্তিযদ্ধোদের ভাত রেঁধে খাওয়ানো থেকে শুরু করে বাড়িতে আশ্রয় দেওয়া, সেবা-শুশ্রূষা করা, অস্ত্র সরবরাহ করাসহ গুপ্তচরের কঠিন দায়িত্বও নারীরা পালন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে নারীর যে অবদান, সে বিষয়ে অতীতে পরিপূর্ণ তালিকার দেখা যেমন পাওয়া যায়নি, তেমনি তাদের যথাযোগ্য মর্যাদা ও স্বীকৃতি দানের উদ্যোগও দেখা যায়নি। আশার কথা এই যে, সম্মিলিত নারী সমাজ এবং মহিলা সমাজের উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধা নারীদের খুঁজে বের করার একটা প্রয়াস চালানো হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে নারী সংগঠক হিসাবে যারা কাজ করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন, বেগম তাইবুন নাহার রশিদ, বেগম সাজেদা চৌধুরী, বেগম বদরুন্নেসা আহমদ, নূরজাহান মুরশিদ ও বেগম মতিয়াচৌধুরী।
সহ-সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বেগম সুফিয়া কামাল, ড. নীলিমা ইব্রাহিম,
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, বেগম রাফিয়া আক্তার ডলি, আইভি রহমান, অধ্যাপক মমতাজ বেগম, বেগম হোসনে আরা মান্নান, মালেকা বেগম, আয়শা খানম, বেবী মওদুদ, মুশতারি শফি প্রমুখ নারী।
মুক্তিযুদ্ধে যারা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। তিনি পুরান ঢাকা, ইলিফেন্ট রোডসহ ঢাকার আশেপাশের পুরোটা শহরজুড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। বাড়িতে তাদের আশ্রয় দিয়েছেন। ওষুধ-পথ্য, খাবারসহ নানাবিধ প্রয়োজনীয় সামগ্রী দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহোযোগিতা করেছেন। ইতিহাস এই শহীদ জননীকে অবশ্য আজও শ্রদ্ধাভারে স্মরণ করে! কিন্তু শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মতো আরও অনেক নাম না জানা নারীও এদেশকে শত্রুমুক্ত করতে সহয়তা করেছেন। তাদের আত্মত্যাগ ও রক্ত, সম্ভ্রমের বিনিময়ে এ জাতি আজ স্বাধীনতার লালসবুজ পতাকা পেয়েছে। পেয়েছে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। তাঁদেরই একজন অদম্য সাহসী নারী কাঁকন বিবি। তার আসল নাম কাঁকাতো হেনিনচিতা। তিনি মুক্তিবেটি নামেও পরিচিত।তিনি খাসিয়া সম্প্রদায়ের এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার মূল বাড়ি ছিল ভারতের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশের এক গ্রামে।
১৯৭০ সালে দিরাই উপজেলার শহীদ আলীর সঙ্গে কাঁকন বিবির বিয়ে হয়। বিয়ের পর তার নাম পরিবর্তিত হয় এবং তার নতুন নাম হয় নুরজাহান বেগম। ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ তিনি এক কন্যাসন্তানের (সখিনা) জন্ম দেন। কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার ফলে স্বামীর সঙ্গে তার মনোমালিন্য দেখা দেয়। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে এপ্রিল মাসে তার সঙ্গে ইপিআর সৈনিক মজিদ খানের বিয়ে হয়। মজিদ তখন কর্মসূত্রে সিলেট ইপিআর ক্যাম্পে থাকতেন। তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর নির্যাতনের শিকারও হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে অসমান্য অবদানের জন্য তাকে বীরপ্রতীক খেতাব দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে সরকারিভাবে আজও গেজেট প্রকাশিত হয়নি। তার অবদানকে যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে এখনই উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।
কাঁকন বিবির মতো আরও অনেক নারী এ দেশের জন্য লড়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন সন্ধ্যারানী সাংমা। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং অনন্যা পুরস্কারপ্রাপ্ত নারী। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে ক’জন নারী বিশেষ অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে তিনি একজন। তিনি ১৯৫০ সালে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার বোকারবাইট গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার নলচাপ্রা গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।
১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন নার্সিং দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ময়মনসিংহ থেকে হালুয়াঘাটের দিকে অগ্রসর হলে সন্ধ্যা রানী সাংমা তাঁর দূর সম্পর্কীয় বোন ভেরোনিকা সিমসাংয়ের সঙ্গে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেন্দ্রগঞ্জ থানার অধীনে চাপাহাতি গ্রামে চলে যান। আর এমন সংবাদ শুনে হালুয়াঘাটের জয়রামকুড়া নার্সিং হাসপাতালের ডাক্তার প্রেমাংকুর রায় সন্ধ্যারানী সাংমা ও ভেরোনিকা সিমসাংকে ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে অবস্থিত ফিল্ড নার্সিং হাসপাতালে নিয়ে যান। এই হাসপাতালের দায়িত্বে ছিলেন ১১ নম্বর সেক্টরের ক্যাপ্টেন আব্দুল মান্নান ও ডাক্তার প্রেমাংকুর রায়। হাসপাতালটির অবস্থান ছিল বাঘমারা ক্যাম্প থেকে ৪০০ গজ দূরে। সেই হাসপাতালে মেডিক্যাল ওয়ার্ড ও সার্জারি ওয়ার্ডে প্রতিদিন আহত ও রোগাক্রান্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেওয়া হতো। পরবর্তীকালে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠেন।
মুক্তিযুদ্ধে যাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তাদের মধ্যে রয়েছেন রাখাইন নারী প্রিনছা খে’। প্রিনছা খে মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে সেবিকার দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি পাকিস্তান বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। শুরু হয় পাশবিক নির্যাতন। সহ্য করতে না পেরে গোপনে বিষ সংগ্রহ করেন। পাকিস্তানি সেনাদের খাবারে তা মিশিয়ে দিয়ে প্রিনছা খে ১৫ জন পাকিস্তানি সেনাকে মেরে ফেলেন। সারা বাংলাদেশে এমন অসংখ্য আদিবাসী নারী মুক্তিযুদ্ধে সম্ভ্রম হারিয়েছেন। কেউ কেউ অস্ত্র ধরেছেন পাকিস্তানি বর্বর পশুদের বিরুদ্ধে।
ভেরেনিকা সিমসাং মুক্তিযুদ্ধের একজন সক্রিয় নারী। তিনি ২০০৫ সালে ১৩ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাহিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে ডা. সেতারা বেগম ও তারামন বিবির অংশগ্রহণও ছিল প্রত্যক্ষ। তাদের অদম্য সাহস ও মনোবল দিয়ে তারা শত্রুকে পরাজিত করেছেন।
নাম জানা ও না জানা অসংখ্য নারী মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তারাও সক্রিয় যোদ্ধা ছিলেন। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে লালসবুজের পতাকা ছিনিয়ে এনেছেন। সম্মানের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংয়গ্রহণকারী নারীদের স্মরণ করতে হবে। তাদের আলোয় আনতে হবে। জাতির পরিচয় যারা নির্ধারণ করেছে তারা যেন সর্বদা ইতিহাসে উজ্জ্বল থাকে।