Skip to content

২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শনিবার | ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশের রেমিট্যান্স খাত নিয়ন্ত্রণে চ্যালেঞ্জ


২০২১ সালে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) পৌঁছায় ৪১৬.২৬ বিলিয়ন ডলারে, যেখানে মাথাপিছু আয় ছিল ২,৪৫৭.৯ ডলার। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এটি একটি অগ্রগতির নির্দেশক। বাংলাদেশের এমন অর্থনৈতিক সাফল্যের একটি বড় অংশ নির্ভর করে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থের ওপর। যেখানে লাখ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি দেশে প্রচুর পরিমাণে অর্থ পাঠান। ২০২২ সালে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের জিডিপির প্রায় ৮ শতাংশ।

তবে এই রেমিট্যান্সের অর্থ দেশে পাঠাতে প্রবাসীদের সম্মুখীন হতে হয় অনেক নিয়মনীতি এবং নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকির। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে কারও কাছে অর্থ পাঠাতে এই সমস্যাগুলো আরও বেশি হয়ে থাকে। এ ধরনের জটিলতার মধ্যে, ট্যাপট্যাপ সেন্ড-এর মতো ফিনটেক প্রতিষ্ঠান দেশের রেমিট্যান্স খাতের ভবিষ্যতের জন্য গেম-চেঞ্জার হিসেবে অবদান রাখছে।

দেশের রেমিট্যান্স সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণ
বাংলাদেশের রেমিট্যান্স পরিচালনা করার মূলে রয়েছে সরকারের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। বাংলাদেশের ‘মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০০২’-এর পাশাপাশি ২০০৭ সালে জাতিসংঘের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কনভেনশন অনুমোদনের মধ্য দিয়ে আর্থিক অপরাধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় বাংলাদেশ। হুন্ডির মতো অর্থ লেনদেনের অনানুষ্ঠানিক এবং অবৈধ মাধ্যমগুলো ঠেকাতে এই বিধিমালা প্রয়োগ করা হয়। বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য যেটি কিনা একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ।

অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপগুলো গুরুত্বপূর্ণ হলেও রেমিট্যান্স প্রবাহে সেটি বাধা সৃষ্টি করতে পারে। অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং (এএমএল) নির্দেশাবলী বাস্তবায়ন করতে এবং জালিয়াতি থেকে তহবিল রক্ষা করার ক্ষেত্রে রয়েছে অনেক জটিলতা। তাই স্থানীয় অর্থনৈতিক দিকগুলোর পাশাপাশি বৈশ্বিক আর্থিক নিয়মগুলো সম্পর্কেও বোঝা অপরিহার্য।

হুন্ডি এবং হাওলা এর মধ্য দিয়ে আন্তঃসীমান্ত লেনদেন হচ্ছে প্রায় ৬০ শতাংশ। এই মাধ্যমগুলো খুব দ্রুত কাজ করে। কিন্তু এতে অর্থ পাচার, এবং সন্ত্রাসবাদের অর্থায়নের মতো নানান ঝুঁকি থেকে যায়। অন্যদিকে ব্যাংকের মতো বৈধ মাধ্যমগুলো নিয়ন্ত্রিত হলেও, এর কঠিন নিয়মকানুন, উচ্চ ফি এবং গ্রামাঞ্চলে সীমিত অ্যাক্সেস থাকায় গ্রাহকদের জন্য অর্থ আদান-প্রদান প্রায়ই জটিল হয় দাঁড়ায়।

২০২২ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে রেমিট্যান্স গ্রাহকদের মধ্যে ৭১% মানুষ সরাসরি নগদে অর্থ নিয়ে থাকে। অপরদিকে, ২০২১ সালে ‘বেটার দ্যান ক্যাশ অ্যালায়েন্স’ এর সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর গড় ব্যয় ৬.৪ শতাংশ যেখানে বৈশ্বিক গড় ব্যয় ৬ শতাংশ।

বাংলাদেশে রেমিট্যান্স শিল্পের বাজার এবং এর গ্রাহকদের সুরক্ষাকে দেশের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা্ অনেকভাবে প্রভাবিত করে। বৈধ রেমিট্যান্সের মাধ্যমগুলোর প্রচারের কারণে ধীরে ধীরে এর কার্যকারিতা সামনে আসছে। এই পরিবর্তনের ফলে গ্রাহকরা বৈধ মাধ্যমগুলোর সুবিধা বুঝতে পারছে এবং পাশাপাশি অবৈধ মাধ্যমগুলোর ঝুঁকি সম্পর্কেও তারা সচেতন হতে পারছে।

ডিজিটাল বিপ্লব
‘ট্যাপট্যাপ সেন্ড’ এর মতো ফিনটেক প্রতিষ্ঠানগুলো একইসাথে নিরাপত্তা, বৈধতা এবং সাশ্রয়ী মূল্যের সেবা নিশ্চিত করে। থ্রিডিএস এবং শক্তিশালী এনক্রিপশনের মতো প্রোটোকলগুলো ব্যবহার করে গ্রাহকদের সুরক্ষা দেয় এই পরিষেবার অ্যাপগুলো। এই বৈধ মাধ্যমগুলোতে অনানুষ্ঠানিক এবং অবৈধ মাধ্যমগুলোর মতো কোন ঝুঁকি থাকে না। বরং গ্রাহকদের জন্য এটি আস্থা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করে।

ট্যাপট্যাপ সেন্ড এর ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইমের প্রধান, জো লরেন্স বলেন যে ট্যাপট্যাপ সেন্ডের গ্রাহকদের তথ্য এবং লেনদেন রক্ষা করতে সবচেয়ে শক্তিশালী এনক্রিপশন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। তিনি আরও বলেন, “আমরা আমাদের গ্রাহকদের অর্থ প্রদান এবং তথ্য সুরক্ষার জন্য অত্যাধুনিক, ব্যাংক-পর্যায়ের নিরাপত্তা এবং এনক্রিপশন প্রযুক্তি ব্যবহার করি। বিশ্বে বিভিন্ন দেশে অর্থ প্রেরণ পরিচালনার জন্য আমরা অনুমোদন এবং সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করি।”

রাষ্ট্রীয় ব্যাংক, বেসরকারী ব্যাংক এবং শীর্ষস্থানীয় মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসগুলোর (এমএফএস) সঙ্গে সরাসরি কাজ করার কারণে ট্যাপট্যাপ সেন্ড অ্যাপের মাধ্যমে অর্থ আদান-প্রদানের প্রক্রিয়াটি আরও সহজ হয়েছে। এছাড়া, খরচ ও লেনদেনের সময়ও এতে কমে যায়।অন্যদিকে, এমন বৈধ মাধ্যম ব্যবহার করায় মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছ থেকে গ্রাহকরা রক্ষা পায়। অর্থ প্রেরক এবং প্রাপক উভয়ের জন্য লেনদেনের পদ্ধতিটি সুবিধাজনক যেখানে কিনা পার্টনারশিপ ব্যাংকগুলোর থেকে সহজে নগদে অর্থ সংগ্রহ করা যায়। বিশেষভাবে গ্রামাঞ্চলের যারা ডিজিটাল পরিষেবাগুলো পায় না তাদের জন্য ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলনের এই দিকটি আরও বেশি সুবিধা দেয়।

কোন ফি ছাড়াই ট্যাপট্যাপ সেন্ড এ লেনদেন করা যায়। ফলে বাংলাদেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ আদান-প্রদানের করার ক্ষেত্রে এমন মাধ্যম অনেক সহজলভ্য। এতে কোন ফি না থাকায় ধর্মীয় উৎসবে বা ধর্মীয় বিশেষ কোন সময়ে, যেমন পবিত্র রমজান মাসে সদকা এবং যাকাতের জন্য অর্থ এতে পাঠানো খুবই সুবিধাজনক।

তবে এই পরিষেবাগুলো নিরাপত্তা, বৈধতা এবং সাশ্রয়ী মূল্য নিশ্চিত করলেও, দেশের রেমিট্যান্স খাতে লেনদেন সংক্রান্ত নানা ধরনের জটিলতা থেকেই যায়। যার মধ্যে রয়েছে লাইসেন্সিং, কেওয়াইসি/এএমএল এর নিয়মাবলী এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে কাজ করার জন্য বহু শর্তাবলী এবং আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া।

এখন প্রয়োজন ফিনটেক প্রতিষ্ঠান, নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যকার লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া সহজতর করা। একইসাথে কেওয়াইসি/এএমএল এর কাঠামোগুলোকে আরও সুস্পষ্ট করে তোলাও জরুরী। আর এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন হলে কেবল তখনই ফিনটেক প্রতিষ্ঠানের সম্ভাবনা আরও বেড়ে যাবে এবং নিশ্চিত হবে বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থিক সুবিধা।

২০২৩ সালে বাংলাদেশের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড পলিসি রিসার্চের (সিএসপিআর) এর সমীক্ষায় দেখা গেছে, ফিনটেক অ্যাপ্লিকেশনগুলোর মাধ্যমে লেনদেনের ব্যয় প্রচলিত পদ্ধতি থেকে গড়ে ৩-৫ শতাংশ কমে যায়। আপাতদৃষ্টিতে খরচের এই তফাত সামান্য মনে হলেও নিম্ন আয়ের পরিবারের জন্য এটি উল্লেখযোগ্য। এতে আরও প্রমান হয় যে ডিজিটাল পদক্ষেপগুলো কিভাবে রেমিট্যান্স সেবার খাতে ভূমিকা রাখতে পারে। তাই আর্থিকখাতে বাংলাদেশ সরকারের ডিজিটাল পরিষেবাগুলো গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক কাঠামোর সাথে উদ্ভাবনের ভারসাম্য বজায় রাখা আবশ্যক। যার দায়িত্ব বর্তায় বাংলাদেশ সরকার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর উপর। ফিনটেক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যৌথ উদ্যোগে কাজ করলে লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া আরও সহজ হয়ে উঠবে। আর এর ফলস্বরূপ স্বচ্ছতার সাথে ও কাঠামোগতভাবে রেমিট্যান্সের আয় অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।

অনেক চ্যালেঞ্জ থাকলেও বাংলাদেশের রেমিট্যান্স খাতের ভবিষ্যৎ আশাব্যঞ্জক। নিয়ন্ত্রক কাঠামোর পরিবর্তন এবং ফিনটেক প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্ভাবন অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশিরা নিরাপত্তার সাথে, এবং সাশ্রয়ী মূল্যে আন্তঃসীমান্ত লেনদেন করতে পারবে। সর্বোপরি ডিজিটাল সমাধানের মধ্য দিয়ে দেশে ও বিদেশের লাখ লাখ বাংলাদেশিকে উপকৃত হবে। একইসাথে দেশের রেমিট্যান্স খাতের সম্ভাবনাও আরও বেড়ে যাবে।

লেখক: ইমাদ আহমেদ, জন্মগতভাবে একজন বাংলাদেশি। তিনি ২০২২ সালে বাংলাদেশি প্রবাসীদের জন্য ‘ট্যাপট্যাপ সেন্ড’ চালু করতে সহায়তা করেন। তার নিজ দেশের রেমিট্যান্সের জন্য এই প্রতিষ্ঠানটি এখন পরিষেবা দিচ্ছে যেটি কিনা একটি অন্যতম বৃহত্তম অ্যাপ-ভিত্তিক ফিনটেক প্রতিষ্ঠান।

তথ্যের উৎস:
১. ওয়ার্ল্ড ব্যাংক (২০২২): মাইগ্রেশন অ্যান্ড রেমিট্যান্স ডাটা
২. বেটার দ্যান ক্যাশ অ্যালায়েন্স (২০২১): রেমিট্যান্স প্রাইস ট্র্যাকার
৩. সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড পলিসি রিসার্চ (সিএসপিআর) (২০২৩): ফিনটেক অ্যান্ড ইটস ইমপ্যাক্ট অন দ্যা রেমিট্যান্স ইন্ডাস্ট্রি অফ বাংলাদেশ

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ