Skip to content

১০ই মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ২৭শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আমার মেয়ে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ায়

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু বউ বাচ্চা নিয়ে আমার বাসায় বেড়াতে এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই আমার মনে আনন্দ। খুব খুশি হয়েছি। সাধ্যমতো আপায়নের আয়োজন করেছি। মনের ভেতর অনেক কথা, অনেক গল্প জমা করে রেখেছি। সব উজাড় করে দেবো।

কিন্তু বন্ধুর সঙ্গে কথা বলার ফুরসতই মিলছে না। সে ব্যস্ত আছে তার ৫ বছরের ছেলেকে নিয়ে। নাস্তাটাও মুখে দিতে পারেনি।

আমার সুসজ্জিত ড্রইংরুমে এসির ঘাটতি আছে। আর বাসায় নেই আইপিএস বা জেনারেটর সুবিধা। আসলে এতটা সাধ্য আমার নেই। তবে বৈদ্যুতিক পাখা আছে দুটি। দুটি পাখাই পূর্ণ গতিতে ঘুরছে। কিন্তু বন্ধুর ৫ বছরের ছেলের তাতে হচ্ছে না (এটা বন্ধুর মতো)। ছেলে ঘেমে-নেয়ে উঠছে। তার শরীরে ঘামাচি উঠে যাচ্ছে। শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। বন্ধু ছেলের চিন্তায় অস্থির, ছেলের পরিচর্যায় অস্থির।

ছেলের গায়ের জামা সে খুলে দিয়েছে। তোয়ালে দিয়ে ছেলের শরীরের ঘাম মুছে দিচ্ছে। দুটা সিলিং ফ্যান পূর্ণপতিতে ঘোরা সত্ত্বেও সে হাতপাখা নিয়ে ছেলেকে বাতাস করছে। আমি সোফার এককোণায় বসে এসব দেখছি আর ভাবছি যে, বড়লোক বন্ধুকে দাওয়াত করার আগে ড্রইংরুমে এসি লাগানো উচিত ছিল, বাসায় আইপিএস, জেনারেটর ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। ভয়ও হচ্ছিল এখনই যদি বিদ্যুৎ চলে যায়!
বন্ধু বললো-এবার ঢাকা শহরের তাপমাত্রা যেন হঠাৎ করেই অনেক বেড়ে গেলো। আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। যাক বন্ধুর সঙ্গে তবু একটু বাক্যালাপের সুযোগ হলো। আমি বললাম-বৃক্ষনিধন করে চলছে উন্নয়নের জোয়ার, তাপমাত্রা তো বাড়বেই।
আজ দিনের তাপমাত্রা কত !

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছে ৩৯ তবে অনুভূত হচ্ছে ৪২-এর মতো।
একথা শুনে বন্ধু ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। সে তার স্ত্রীকে বললো- তুমি তোয়ালেটা একটু ভিজিয়ে আনো তো, ওর শরীরটা একটু মুছে দেই। ঠাণ্ডা ডাবের পানি খাওয়ানো গেলে ভালো হতো।
আমি বললাম-ডাবের পানি তো নেই। লেবুর শরবত তো আছে। ওটা খাওয়াও।
বন্ধুর স্ত্রী বসেছিলেন পাশের একটা সিঙ্গেল সোফায়। আমি তার দিকে তাকালাম। গরমের অস্বস্তি যেন এবার আমাকে পেয়ে বসলো। সূতি না, পুরোপুরি কালো পলিস্টারের কাপড়ে বন্ধুস্ত্রীর আপাদমস্তক আবৃত। কোনোমতে চোখটা দেখা যাচ্ছে। ‘দোস্ত, ছেলের চিন্তায় তো তুই অস্থির, তোর বউয়ের গরম লাগতেছে না?’ রসিকতার ছলে এরকম একটা প্রশ্ন করেই ফেলেছিলাম প্রায়।
বন্ধু যখন ভেজা তোয়ালে দিয়ে তার ছেলের গা মুছছিল তখন আমার সাত বছরের মেয়ে একটা বল নিয়ে এলো বন্ধুর সাত বছরের মেয়ের কাছে। এসে বললো-এসো, আমরা বল খেলি।

এবার আমি তাকালাম বন্ধুর মেয়ের দিকে। কালো প্যাকেটেরে ভেতর ডালিমরাঙা একটা মুখ বের হয়ে আছে কোনোমতে। পুরোমুখ ঘামে ভেজা। মুখে ঘামের বিন্দু এমনভাবে আছে যেন গোলাপের ওপর ভোরের শিশিরবিন্দু। আমার মনে হচ্ছিল, ওর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সত্যিই আমি ৩৯ ডিগ্রি তাপমাত্রাকে ৫৫ ডিগ্রি অনুভব করতে লাগলাম এবং বলেই ফেললাম-এখানে তো বাইরের কেউ নেই। আর ও তো আমার মেয়ের বয়সী, আমার মেয়েই। এতটুকু একটা বাচ্চা! ওসব খুলে রেখে আমার মেয়ের সঙ্গে পাখার বাতাসে একটু খেলুক, ওর ভালো লাগবে।

এ কথা বলতেই বন্ধু প্রায় চিৎকার করে উঠলো-না না না, কিছু খোলা যাবে না। ও ফ্যানের নিচে বসুক। ঘাম এমনিতেই জুড়িয়ে যাবে।
আমি চুপ করে গেলাম। কথাটা বলে যেন আমি খুব অপরাধ করেছি। অপরাধীর মতো হাতপা গুটিয়ে বসে রইলাম। বন্ধু শুধু বড়লোকই নয়, নামকরা অধ্যাপকও। ছাত্রজীবনের বই পড়ত প্রচুর। হুমায়ূন আজাদ কালেকশন সে-ই আমাকে উপহারদিয়েছিল। সেই বন্ধু আজ আমার মেয়ের পরনে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর সূতি কাপড়ের একটা ফতুয়া। মেয়ে আমার বন্ধুর মেয়েকে বললো- এসো খেলি।

মেয়েটার মুখে মিটিমিটি হাসি। হাসি দিয়ে সে বোঝাচ্ছে, এই পোশাক পরে তো বল খেলতে পারবো না। আমার মেয়ে বলে একটা কিক করে বলটা আমার বন্ধুর মেয়ের কাছে দিলো। বন্ধুর মেয়ে মুখে হাসি ধরে রেখে হাত দিয়ে ধরে বলটাকে আমার মেয়ের কাছে ফিরিয়ে দিলো। ফুটবল হাত দিয়ে ধরে ফিরিয়ে দেওয়াটা আমার মেয়ের পছন্দ হলো না। আমি বললাম-বল রাখো, তোমরা বরং বারান্দায় বসে পুতুল খেলো।

আমার মেয়েটা খুব চঞ্চল। দৌড়-ঝাপ করতে খুব পছন্দ করে। একা একা তো দৌড়ঝাপ করা যায় না। সমবয়সী সঙ্গী পেলে সে দৌড়ঝাপ করতে চায়। মেয়ে পুতুল খেলতে রাজি হলো না। সে দৌড়-ঝাপের কিছু খেলতে চায়। সে বললো-পুতুল খেলতে ভালো লাগে না। এসো ছোঁয়াছুঁয়ি বা কানামাছি খেলি।

বন্ধুর মেয়ে এসব খেলতে আগ্রহী না। মনের দিক থেকে আগ্রহী, পোশাকের কারণে আগ্রহী না। তবু আমার মেয়ে তাকে টেনে নিলো। খেলতে গিয়ে বন্ধুর মেয়ে পা জড়িয়ে পড়ে গেলো। আমার মেয়ে বললো এগুলো খুলে এসো খেলতে ভালো লাগবে।

বন্ধুর মেয়ে খেলা বন্ধ করে আবার সোফার কোণায় গিয়ে বসলো। সে একবার তাকালো আমার মেয়ের মুখে, একবার তার বাবার মুখে। তার দৃষ্টিতে অসহায়ত্বে ছাপ। আমার মেয়ে রাগ করে অন্যরুমে চলে গেলো।

আমি আমার বন্ধুকে বলতে চেয়েছিলাম-তোমার ছেলেমেয়ে দু’জনই শিশু। শীত-তাপ-ক্ষুধা, তৃষ্ণার জ্বালা দু’জনেরই সমানভাবে অনুভব হয়। পর্দার নামে একটা শিশুকে তুমি এভাবে কষ্ট দিতে পারো না। ওর মন এখন আমার মেয়ের সঙ্গে খেলতে চাচ্ছে। ঘরময় ও ছুটে বেড়াতে চায়। ছাদে যেতে চায়। আনন্দ করতে চায়। হাসতে চায় খিলখিল করে। মুক্তির নিঃশ্বাসে মুক্ত বায়ু দিয়ে ভরে নিতে চায় বুকের হাঁফর। অথচ তুমি ওকে স্থবির করে বসিয়ে রেখেছ।

কিন্তু আমি মুখফুটে কিছু বললাম না। বলে লাভ নেই। আমার বন্ধু যুক্তির ধারে-কাছে যাবে না। বাস্তবতার ধার সে ধারবে না। আমি কল্পনার খেয়ায় ভেসে গেলাম। না, অতীত কোনো কল্পনা না। আমি ভবিষ্যৎ কল্পনায় ভাসতে লাগলাম। দেখলাম, আমার মেয়ে এবং আমার এই বন্ধুর মেয়ে বড় হয়েছে। ওরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। আমার বন্ধুর মেয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছে। প্ল্যাকার্ডে লেখা-
হিজাব ইস মাই চয়েস।
আমার মেয়ে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ায়। প্ল্যাকার্ডের লেখার দিকে তাকায়-তাকায় বন্ধুর মেয়ের মুখে। ও ফিরে যায় ওর শৈশবের কোনো এক স্মৃতিতে। মনে মনে বলে-ইটস অ্যা গ্রেট লাই। হিজাব তোমার চয়েস নয়, প্রথম শৈশবেই তোমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি তা জানি।
‘আমি টেবিলে খাবার সাজিয়েছি, দয়া করে সবাই চলে আসুন’ আমার স্ত্রীর এই আহ্বানে আমার কল্পনার স্রোতে বাধা পড়লো।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ