Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নারীদের ভোটাধিকার: জীবনের বিনিময়ে যেভাবে নারীরা পেলেন ভোট দেওয়ার অধিকার

সময়টা উনবিংশ শতকের শেষ দিকে। ইউরোপের নারীরা চাইলেন, তারাও পুরুষদের পাশাপাশি দেশের প্রতিনিধি নির্বাচনে অংশ নিতে। ভাবা যায়? ইউরোপ মহাদেশেও এই একশ বছর আগেও মেয়েরা ভোট দিতে পারতেন না? রীতিমতো জীবন দিয়েই আদায় করেছিলো ভোট দেয়ার অধিকার?

নারীর ভোটাধিকার বলতে নির্বাচনে নারীর ভোটপ্রদানের অধিকার বোঝায়। ১৯শ শতকের শেষ দিকে এসে ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, সুইডেন, কিছু অস্ট্রেলীয় উপনিবেশ এবং পশ্চিম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অঙ্গরাজ্যের নারীরা সীমিত আকারে ভোটের অধিকার অর্জন করেন।এর কিছু পরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংগঠন গঠনের মাধ্যমে এই প্রচেষ্টার সমন্বয় সাধন করা হয়। এদের মধ্যে ১৯০৪ সালে জার্মানির বার্লিনে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নারী ভোটাধিকার মৈত্রী উল্লেখযোগ্য, যারা নাগরিক হিসেবে নারীর সমান অধিকারের জন্যও কাজ করতেন। ১৮৮১ সালে আইল অফ ম্যান যেসব নারী সম্পত্তির অধিকারী, তাদেরকে ভোটাধিকার প্রদান করে। ১৮৯৩ সালে যুক্তরাজ্যের তৎকালীন নিউজিল্যান্ড উপনিবেশ তাদের নারীদেরকে ভোটের অধিকার দেয়। ১৮৯৪ সালে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া উপনিবেশও একই কাজ করে এবং সেখানে ১৮৯৫ সালের নির্বাচনে নারীরা ভোট দিতে যান। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়াতে নারীরা নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পান।১৮৮৯ সালে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়াও নারীদের পূর্ণ ভোটাধিকার দেওয়া হয়। ১৯০২ সালে অস্ট্রেলিয়ার ছয়টি উপনিবেশ একত্রিত হবে অস্ট্রেলীয় কমনওয়েলথ গঠন করলে বাকী উপনিবেশগুলিতেও নারীরা নির্বাচনে প্রার্থিতা এবং ভোটপ্রদানের অধিকার অর্জন করে।

১৮৯৩ সালে নিউজিল্যান্ডের নারীরা ভোট দেওয়ার অধিকার পান। সেটাই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে নারীদের ভোটের অধিকার পাওয়ার প্রথম ঘটনা। কিন্তু নারীর ভোটাধিকারের ধারণা নানান দেশে ছড়িয়ে পড়লেও বিশ শতকের গোঁড়ার দিকেও ভোটাধিকার বঞ্চিত ছিলেন খোদ ইংল্যান্ডের নারীরা! কেননা অন্যান্য অনেক দেশের মতো সেখানকার নারীদেরও পুরুষের সমকক্ষ বলে মনে করা হতো না। 

ব্রিটিশ নারী অধিকারকর্মী এমেলিন প্যাংকহার্স্ট ১৯০৩ সালের শেষের দিকে নারীর ভোটাধিকার এবং অন্যান্য অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উইমেনস সোশ্যাল অ্যান্ড পলিটিক্যাল ইউনিয়ন (ডব্লিউএসপিইউ) নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এর প্রায় দুই বছর পর, ১৯০৬ সালে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইল–এ সাংবাদিক চার্লস ই হ্যান্ডস বিষয়টির বিরোধিতা করে একটি লেখা লেখেন। সেখানে লেখক এই সংগঠনের সদস্যদের ব্যঙ্গ করে ‘সাফ্রেজেটিস’ নাম দেন। তখন থেকেই নামটি প্রচলিত হতে থাকে। ভোটাধিকারপ্রাপ্তির জন্য লড়া নারীরা পরিচিতি পান সাফ্রেজেটিস নামে। যদিও এই শব্দের উৎপত্তি বিদ্বেষপ্রসূত এবং এটি ব্যবহার করা হতো ব্যঙ্গার্থে। তখনকার সময় বেশির ভাগ সংবাদপত্র নারীর ভোটাধিকারপ্রাপ্তির আন্দোলনকে অহেতুক, অসার এবং ফালতু আখ্যা দিয়ে নানান ধরনের রচনা প্রকাশ করে।

আন্দোলনে আত্মাহুতি : সাফ্রেজেট বা ভোটাধিকারপ্রাপ্তির জন্য লড়া এই নারীরা কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। তাঁরা কাজে বিশ্বাসী ছিলেন, কথায় নয়। এই আন্দোলনকারীরা জানালা ভাঙচুর করতেন, দালানে আগুন দিতেন এবং রেলিংয়ের সঙ্গে নিজেদের শিকলবন্দী করে রাখতেন ইস্যুটির প্রতি সর্বস্তরের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। কিন্তু এত করেও যেন কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। 

১৯১৩ সালে ব্রিটিশ ‘সাফ্রেজেট’ অধিকারকর্মী এমিলি ডেভিসন (১৮৭২–১৯১৩) ইংল্যান্ডের সারের এপসম শহরে এক ঘোড়দৌড়ের সময় ঘোড়ার পায়ের নিচে পড়ে প্রাণ হারান। অনেকে মনে করেন, সেটি ছিল আত্মহত্যা। তবে এটা নিশ্চিত করা যায়নি যে তিনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন নাকি শুধু দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন। 

যে ঘোড়ার পায়ের নিচে পড়ে প্রাণ হারান ডেভিসন, সেই ঘোড়াটি ছিল ব্রিটেনের রাজা পঞ্চম জর্জের। সুতরাং এটা অসম্ভব নয় যে ডেভিসন নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই তা করেছিলেন। কিন্তু যে উদ্দেশ্যেই হোক, ডেভিসনের মৃত্যু আবারও ইস্যুটিকে সামনে নিয়ে আসে।

বেশ কয়েক বছর ভয়ডরহীন আন্দোলন করার পর অবশেষে সাফল্য ধরা দেয়। ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ নারীরা ভোট দেওয়ার অধিকার পান। মার্কিন নারীরা পান এর দুই বছর পর—১৯২০ সালে। এরপর ধীরে ধীরে অনেক দেশেই নারীরা ভোটাধিকার লাভ করেন। বর্তমানে বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকটি দেশ ছাড়া প্রায় সব অঞ্চলেই নারীরা তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।

এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সর্বপ্রথম মধ্য এশিয়ার নারীরা ভোটাধিকার অর্জন করেন। মার্ক্সবাদীরা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নারীদের ভোটাধিকারে বিশ্বাস করতেন, তাই ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের শেষ দিকে রাশিয়ার নারীদের ভোটাধিকার প্রদান করা হয় এবং এসময় রাশিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্ত মধ্য এশীয় দেশগুলিতেও নারীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত হয়। এর পরবর্তী ২০ বছরে যেসব মধ্য এশিয়ার দেশের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক ছিল না, সেগুলিতেও নারীদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে সর্বপ্রথম নারীদের ভোটাধিকার দেওয়া রাশিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্র মঙ্গোলিয়াতে, ১৯২৪ সালে। এরপর ১৯৩২ সালে থাইল্যান্ডে পুরুষ-নারী নির্বিশেষে সমস্ত প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়, যদিও থাই নারীরা ১৮৯৭ সাল থেকেই স্থানীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারতেন। ২০শ শতকে এশিয়ার বৃহত্তম ও সবচেয়ে জনবহুল রাষ্ট্র চীনে নারীদের ভোটাধিকার অর্জনের আন্দোলন বিদ্যমান সরকারী কাঠামো পরিবর্তনের আগে শুরু হয়নি। ১৯৩৬ সালে নতুন চীন প্রজাতন্ত্রের সংবিধানে নারীদের ভোটাধিকার থাকলেও ১৯৩৭ সালে জাপানের চীন আক্রমণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সাম্যবাদী বিপ্লব, ইত্যাদি কারণে চীনা নারীদেরকে ১৯৪৭ পর্যন্ত ভোটাধিকারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। জাপানেও ১৯৪৫ সালে গিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে নারীদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়। যদিও ১৯২৮ সালে যুক্তরাজ্যে নারীরা ভোটাধিকার অর্জন করেন, এশিয়াতে যুক্তরাজ্যের বৃহত্তম উপনিবেশ ভারতীয় উপমহাদেশে খুবই সীমিত সংখ্যায় পুরুষ ও নারীদের ভোটাধিকার প্রদান করা হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৫০ সালে ভারতে সার্বজনিক ভোটাধিকারের অংশ হিসেবে নারীদের ভোটাধিকার প্রদান করা হয়। এর বিপরীতে পশ্চিম এশিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যে নারীরা তাদের ভোটাধিকার অর্জনের জন্য সবচেয়ে বেশি সময় ধরে আন্দোলন করেন। কিছু মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ যেমন আফগানিস্তান, পাকিস্তান, লেবানন, সিরিয়া, ইরান, ইরাক ও ইয়েমেন ১৯৫০-এর দশক থেকে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নারীদেরকে ভোটাধিকার প্রদান করলেও অনেক আরব দেশে নারীদের ভোটাধিকার পেতে ২০শ শতক পার হয়ে যায়। আফগানিস্তানে তালিবানরা ক্ষমতায় এলে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত নারীদের ভোটাধিকার হরণ করা হয়। এর বিপরীতে ওমানে ১৯৯৭ সালে, কাতারে ১৯৯৯ সালে, বাহরাইনে ২০০২ সালে নারীদের ভোটাধিকার দান করা হয়। সবশেষে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে এসে নারীরা প্রথমবারের মত সৌদি আরবে পৌরসভা নির্বাচনে ভোট দেবার সুযোগ পান। 

নারীদের ভোটাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে আইনি ও সাংবিধানিক সংশোধন আদায়ের জন্য নারীদেরকে এবং তাঁদের সমর্থকদেরকে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রচারণা চালাতে হয়েছে। বেশির ভাগ দেশে সম্পদশালী নারীরা অনেক আগেই ভোটের অধিকান পান, এমনকি সার্বজনীন পুরুষ ভোটাধিকারেরও আগে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জাতিসংঘ নারীদের ভোটাধিকারকে উৎসাহিত করতে থাকে এবং ১৯৮১ সালে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ নামক সনদটিতে জাতিসংঘের ১৮৯টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে নারীর ভোটাধিকারকে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
ভোটাধিকারপ্রাপ্তিতে নারীরা সমাজের উন্নয়নে আরও বেশি ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছেন। নারী অধিকার আদায়ে এটা ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ। নারীর মতামতের গুরুত্ব এর মাধ্যমেই রাষ্ট্র ও সমাজে অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। পৃথিবীতে এখনো সমান অধিকারের জন্য নারীদের লড়ে যেতে হচ্ছে।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ