কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ: সমাজের অবক্ষয় আর কত!
বর্তমান সময়টা খুবই কলুষিত। মানুষ মানুষকে মূল্যায়ন করছে না। একজনের বিপদে আরেকজন এগিয়ে আসার মানবিক শিক্ষা এ সমাজে বেশ অপ্রতুল। আর নারীর ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো আরও অধিক। নারীকে ঘরবন্দি করতে, টেনেহিঁচড়ে নিচে নামানোর পায়তারা চলছে। শিশু থেকে বয়োবৃদ্ধ কেউ এই সহিংসতা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। যার যা খুশি তাই উচ্চারণ করছে। যেন এক অঘোষিত আইনে পরিণত হয়েছে যে, নারীকে অপমান-অপদস্ত-লাঞ্ছিত করতেই হবে!
সমগ্র বিশ্বের প্রতি ৩ জন নারীর ১ জন নানাবিধ নির্যাতনের শিকার। কেউ যৌন নির্যাতনের শিকার, কেউবা ধর্ষণ, গৃহ নির্যাতন, লিঙ্গভিত্তিক গর্ভপাত, প্রসবকালীন সহিংসতা, পারিবারিক কলহ, দাম্পত্য সংকট, যৌতুকের শিকার, নারী খৎনা, অপহরণপূর্বক বিবাহ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, শ্বশুর, দেবর বা স্বামী কর্তৃক নিপীড়ন, বাল্যবিয়ের শিকার, পাথর ছুড়ে- চাবুক মেরে হত্যা, পোশাক পরিধানকে কেন্দ্র করে নারী নিপীড়ন, যৌন দাসত্ব, জোরপূর্বক গর্ভপাত, নারী পাচার, জোরপূর্বক বেশ্যাবৃত্তি, রীতি বা সম্মানরক্ষার্থে হত্যা তথা অনার কিলিং প্রভৃতি বহুমুখী সহিংসতা নারীর সঙ্গে ঘটে চলেছে সমাজে। নারীর এই বন্দিদশার মুক্তি কোথায়? ধর্ষণ থেকে নারীকে বাঁচাতে সমাজের কি কোনোই উদ্যোগ নেই!
গণমাধ্যম বরাত জানা যায়, খুলনায় বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় বাড়িতে ঢুকে এক কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও লুটপাট করেছে কয়েকজন দুর্বৃত্ত। সোমবার রাতে নগরীর এ ধর্ষণ ও লুটপাটে জড়িত থাকার অভিযোগে গোবিন্দ ফৌজদার (৩২) নামে একজনকে আটক করেছে পুলিশ।
দুই প্রতিবেশী জানান, গোবিন্দ ফৌজদার নামে স্থানীয় এক যুবক প্রায় সময় মেয়েটিকে বিয়ের প্রস্তাবসহ নানাভাবে উত্ত্যক্ত করত। মেয়েটি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় সে ক্ষুব্ধ হয়। পরে পরিকল্পিতভাবে সংঘবদ্ধভাবে তাকে ধর্ষণের পর বাড়িতে লুটপাট করে। তারা জানান, কিছুদিন আগে মেয়েটির আশীর্বাদ (বাগদান) হয়েছে। কয়েকদিন পর তার বিয়ে হওয়ার কথা রয়েছে।
পুলিশ জানায়, সোমবার দিবাগত রাত ২টার দিকে তিনজন দুর্বৃত্ত গোলা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত এক সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার বাড়িতে প্রবেশ করে। এ সময় তারা বাড়ির লোকজনকে জিম্মি করে প্রায় একঘণ্টা ধরে ঐ সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার মেয়েকে ধর্ষণ করে। যাওয়ার সময় দুর্বৃত্তরা ঐ বাড়ির স্বর্ণালঙ্কারসহ মালামাল লুট করে নিয়ে যায়।
হরিণটানা থানার ওসি মো. মনিরুল ইসলাম জানান, ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে গোবিন্দ নামে একজন যুবক বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। ঐ প্রস্তাবে মেয়ের পরিববার রাজি না হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে তিনজন মিলে ধর্ষণ করেছে। তাকে ধর্ষণের শিকার মেয়েটি সনাক্ত করেছে। আটক গোবিন্দ ফৌজদারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্য দুই যুবককে গ্রেপ্তার করার জন্য অভিযান চলছে। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে বলে ওসি জানান।
সমাজে দিনকে দিন এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা অহরহ ঘটছে। যদি এখনই এর উপর্যুপরি ব্যবস্থা করা না যায় তবে নারীদের টিকে থাকা আরও কঠিন হয়ে পড়বে!
যৌনবিজ্ঞানী ও সাধারণ শারীরিকভাবে সক্ষম ব্যক্তি মাত্রই স্বীকার করবেন, ধর্ষণে যৌনসুখ ধর্ষক পায় না। প্রকৃতপক্ষে বিকৃত পুরুষ ধর্ষণে লিপ্ত হয় যৌনসুখের জন্য নয়, তার ক্রোধ, প্রতিহিংসাপরায়ণতা দেখানোসহ লালসা চরিতার্থ করতে। তাই ক্রোধান্ধ ধর্ষকদের কেবলই আইন করে দমানো পুরোপুরি সম্ভব নয়। সমাজ থেকে ধর্ষণ দূর করতে হলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। এক. যৌনবিষয়ে পারিবারিক শিক্ষা, দুই. প্রাথমিক শিক্ষাঙ্গন থেকেই যৌনসচেতনতামূলক পাঠ যুক্ত করা, তিন. ছেলে শিশু, মেয়ে শিশুর অভিভাবক ও নারীর ব্যক্তিগত সচেতনতা, চার. সামাজিক আন্দোলন এবং পাঁচ. আইনের পাশাপাশি গণসচেতনতামূলক প্রচারণা।
এই কথা অনস্বীকার্য যে, পরিবারই হচ্ছে শিশুর প্রথম পাঠশালা। তাই যেকোনো শিক্ষার শুরু পরিবার থেকে হলে তার ভিত্তি মজবুত হয়। তার মানসগঠনে সেই শিক্ষা প্রতিফলিত হয় সবচেয়ে বেশি কার্যকরভাবে। তাই শিশুকে যৌনবিষয়ে বয়সভিত্তিক ধারণা দিতে পরিবারের অগ্রজদের দায়িত্ব নিতে হবে। যৌনতার গুরুত্ব, ভালো-মন্দ দিক, এর পাত্র-পাত্রীর বয়স ও সময় সম্পর্কে শৈশব থেকে সচেতন করে তুলতে হবে। যেভাবে পাপ-পুণ্য-ধর্মীয়-নৈতিক জ্ঞানসহ অন্যান্য শিক্ষা পরিবার থেকে দেওয়া হয়, যেভাবে যৌনশিক্ষাও দিতে হবে। ভালো-মন্দের বিভেদ বোঝাতে হবে। মানুষ হিসেবে নারীকে মূল্যায়ন করতে হবে। মতের গুরুত্ব দিতে হবে। নারীও মানুষ। তারও মনের ভালোলাগা-মন্দলাগা আছে। ফলে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যাতে আর না ঘটে সে জন্য কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।