বেগম রোকেয়ার দীক্ষায় জাগুক নারী
আজ ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া দিবস। আজকের দিনে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন জন্ম ও মৃত্যুবরণ করেন। বাংলার নারী সমাজকে অবরুদ্ধ দশা থেকে বের করে আনতে তিনি আজীবন লড়ে গেছেন। তাই তাকে নারী জাগরণের অগ্রদূত বলা হয়। এই মহীয়সী আজীবন নারীর সম্মান আদায়ে, নারীকে শিক্ষিত করতে, নারীর জীবনকে মূল্যবান করে তোলার সব চেষ্টাই করেছেন। যা বাঙালি নারীর প্রেরণার মূল অংশ। আজও নারী অবরুদ্ধ৷ তবে সেখানে শৈথিল্য এসেছে। বেগম রোকেয়ার যুগকে অতিক্রম করে কালের আবর্তে নারীরা কিঞ্চিৎ স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বুকে পদাঘাত করে নারী তার আপন পরিচয় তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছেন।
আর তারচেয়েও বড় কথা আজকের নারী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের দেখানো পথকে ভুলে যাননি। তাইতো পথে বাধা আসলেও তা ডিঙিয়ে চলার মানসিক শক্তি তারা ধীরে ধীরে বেশ অর্জন করে নিচ্ছেন।
ঘরে-বাইরে নারী নির্যাতনের যে চিত্র প্রতিনিয়ত সম্মুখে আসছে তার বাইরে গিয়ে নারীরা নিজেকে নিয়ে ভাবতে শিখেছেন। সবকিছু জয় করার অদম্য স্পৃহা ও প্রবল তৃষ্ণা তাদের সামনের দেওয়ালকে গুড়িয়ে দিচ্ছে। রোকেয়ার যুগে যে নারীরা ছিল সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ, যাদের বাইরে প্রবেশের কোনরকম সম্মতি সমাজ দেয়নি সেখান থেকে আজকের নারী বেরিয়ে এসেছে । আজকের নারী ঘরে-বাইরে শারীরিক- মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন না এমন নয় কিন্তু তারা ভীতু হয়ে মাথা নোয়াবার নয়। তারা জানে জীবনের পথে বাধা আসলে তাকে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেতে নেই। বরং শতগুণ প্রবল ও প্রচণ্ড মনোবল নিয়ে শত্রুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে হয়। তাইতো আজকের নারী বিমানের ককপিট থেকে শুরু করে
নভোযানের সঙ্গী হচ্ছে৷ বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, শিল্প-ইতিহাস-সংস্কৃতিকে চর্চা করছে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলছে।
বাংলাদেশে ট্রেনে প্রথম নারী এটেনডেন্ট যুক্ত হয়েছেন। এর আগে এই পেশায় পুরুষের দেখা মিললেও নারীর সাক্ষাৎ ঘটেনি। যা আবারও নতুনযুগের সূচনা বা হাতছানি বলা যেতে পারে। মানুষ হিসেবে যে মানুষের দ্বারা অসাধ্য কিছু নেই তা নতুনভাবে প্রমাণ করছেন এই নারীরা। সাম্যের পৃথিবী হোক। সব বাধা-বিপত্তির নিষ্পত্তি ঘটুক।
গণমাধ্যম বরাত জানা যায়, ইতিমধ্যে যাত্রা শুরু করেছে ‘কক্সবাজার এক্সপ্রেস’। ১ ডিসেম্বর কক্সবাজার থেকে প্রথম ট্রেনটি ছেড়ে আসে ঢাকার উদ্দেশে। এতে পরীক্ষামূলকভাবে ৯ জন নারী অ্যাটেনডেন্টকে যুক্ত করা হয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ের ইতিহাসে প্রথম এই পদে নারীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিমানবালার কথা বিবেচনায় এনে অনেক যাত্রীই তাঁদের বলছেন ট্রেনবালা। শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টায় প্রথমবারের মতো ২০টি কোচ নিয়ে কক্সবাজার থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয় কক্সবাজার এক্সপ্রেস। প্রথম দিনে যাত্রী ছিলেন ১ হাজার ২০ জন। যাত্রীদের প্রয়োজনীয় সেবায় নিয়োজিত ছিলেন ২৪ জন অ্যাটেনডেন্ট বা ট্রেন হোস্টেস। তাঁদের মধ্যে রেলের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দায়িত্ব পালন করেছেন ৯ জন নারী অ্যাটেনডেন্ট। ইতিমধ্যে আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে ২৬ জন নারী অ্যাটেনডেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া আগামী ১ জানুয়ারি থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে চালু হতে যাওয়া নতুন সুবর্ণ এক্সপ্রেসেও ২০ জন নারী অ্যাটেনডেন্ট দায়িত্ব পালন করবেন।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের যুগে পুরুষ যখন চাঁদ ও সূত্রের গতিপথ মাপতে ব্যস্ত নারী তখন বালিশের ওয়াড় সেলাই করতেই নিজের জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। তার জগৎ পরিবার পরিজনের বাইরে ছিল না। নারীকে পুরুষ যেভাবে শোষণ করেছে, পদতলে নিষ্পেষিত করেছে তেমনই থেকেছেন। আজ যুগ পাল্টেছে। আজকের যুগে নারী ঘরে-বাইরে উভয়ই সামলানোর দীক্ষা গ্রহণ করেছেন। তবু তার ওপর পদাঘাত কমেনি। অবরুদ্ধ করতে না পেরে পুরুষের আক্রোশ-আক্রমণ থেমে নেই। গত ১০ মাসে বাংলাদেশে ৬৯৫ জন নারী ও কন্যাশিশু হত্যার শিকার হয়েছেন। এছাড়া ১০২২ জন বিভিন্ন সময়ে ও স্থানে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ যা একদিকে আলো দেখালেও অন্যদিকে অন্ধকারকে তুলে ধরছে।
চোখ খুলতেই নারীকে আবারও ঘরের মধ্যে বন্দি রাখার সব জল্পনা-কল্পনা পুরুষতন্ত্র করেই চলেছে। তারা নারীর স্বাধীন ও স্বাভাবিক জীবন মেনে নিতে অপারগ ফলে নারীর ওপর নির্যাতনের মাত্রা ক্রমাগত বাড়াচ্ছে! নারী যত স্বাধীন-সুস্থ জীবনের তাগিদে বাইরে পা বের করছে পুরুষ তত তাকে জাপটে ধরছে! নারী সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন একথা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের যুগ যে পাল্টেছে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে।
কিন্তু নারীর সার্বিক মুক্তি কই? এ সমাজ কেনো নারীকে বারবার টেনেহিঁচড়ে নামাতে চায়? কেনো রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নারী জাগরণের সুফল সামগ্রিকভাবে আজকে একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারীকে ভোগ করতে পারছেন না? তার দায় কি এ সমাজের নয়? হ্যাঁ নারীর চাকরিতে অংশগ্রহণ বেড়েছে, সামজিক অবস্থান পাল্টেছে কিঞ্চিৎ কিন্তু তা একান্ত নারীর প্রচেষ্টায়। সেখানে জাতির দায় নেই। আরও দৃঢ়ভাবে বললে বলা যায় পুরুষের অবদান সেখানে নেই বললেই চলে। একজন নারীকে স্বাবলম্বী করতে কোন বাবা তার জমি বিক্রি করেন না, সহায়-সম্বল দাওয়ায় দিয়ে বলেন না আমার কন্যারা মানুষ হোক কিন্তু ঠিকই তিনি ছেলের জন্য জমি বন্দক রাখছেন। এ সমাজ অতি আধুনিক এখানে নীরবে নিভৃতে চলে নারীর শোষণ!
রোকেয়ার যুগে যা ছিল আমজনতার তা এখন ব্যক্তিবিশেষের হয়ে উঠেছে। একজন নারী প্রতিবন্ধকতাকে ডিঙিয়ে ওপরে উঠলে তার পিছনে নানারকম কটু মন্তব্য জুড়ে দেয় এই ভদ্রবেশী সমাজ! এগুলোর পরিবর্তন হওয়া জরুরি। যতদিন এগুলোর পরিবর্তন হবে না ততদিন সম্পূর্ণভাবে আমরা রোকেয়াকে ধারণ-লালন করার কথা অকপটে স্বীকার করতে পারি না। রোকেয়ার বাণী চিরন্তন হতে হবে যেমন নারীর জীবনে তেমনই পুরুষের জীবনে সর্বোপরি মানুষের জীবনে। তবেই নারীর সর্বৈব মুক্তি।