মানসিক চাপ ও নারীর সুস্থতা
প্রত্যেক মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকা প্রয়োজন। প্রতিদিন মানুষকে বিভিন্ন ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়। এর মধ্যে কখনো সেসব ঘটনা থাকে সুখের, আবার কোনো ঘটনা মনে বিষাদ, রাগ-ক্ষোভ কিংবা দুঃখ বয়ে আনে।
আর যে কারো জীবনেই দুঃখ- হতাশা- নৈরাশ্যের মত কালো মেঘ বাসা বাঁধতেই পারে, তাই বলে জীবনকে তো ব্যর্থ ভাবলে চলবেনা। খারাপ সময় বা পরিস্থিতিকে মোকাবিলার মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান থাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ।
তবে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হলে এর সম্পর্কে ভালো করে জেনে নিতে হবে অবশ্যই। অর্থাৎ স্বাস্থ্য কী এই বিষয়টি না জানলে এটি সম্পর্কে সচেতন হওয়ার কথা কেউ ভাববে না এটাই স্বাভাবিক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO এর মতে স্বাস্থ্য হল ব্যক্তির শারীরিক , মানসিক এবং সামাজিক এই তিন অবস্থার একটি সুস্থ সমন্বয়।
সুতরাং সহজ ভাষায় বলা যায় ,একজন মানুষের স্বাস্থ্য হল রোগবালাই মুক্ত সুস্থ শরীর ও সেই সঙ্গে ভয় , হতাশা, বিষণ্নতা ,মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকা। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে , স্বাস্থ্যের অন্যতম উপাদান হল মনের সুস্থতা বা মানসিক স্বাস্থ্য। মানুষের চিন্তা ,আবেগ ও আচরণ এই তিন মিলেই হলো মানসিক স্বাস্থ্য।
এককথায় মানসিক স্বাস্থ্য বলতে বোঝায় “ Full and harmonious functioning of whole personality “.
সত্যি কথা বলতে, একজন মানুষ তার শারীরিক স্বাস্থ্য নিয়ে যতটা সচেতন থাকেন, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ততটা সচেতন হননা। অথচ মানসিক স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে তা অবশ্যই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর ভীষণ ভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ শারীরিক স্বাস্থ্য এবং মানসিক স্বাস্থ্য ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।
সাধারণত খুব কম মানুষই আছেন যারা নিজের শরীরের ব্যাপারে সচেতন থাকেন। খুব বেশি অসুস্থ না হওয়া পর্যন্ত বেশির ভাগ মানুষ চিকিৎসকের দারস্থ হতে চান না।
আর যেখানে শরীরের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেই এমন চুপ থাকতে দেখা যায় সেখানে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবা তো তাদের জন্য খুবই অস্বাভাবিক একটা বিষয়। অথচ শরীর ও মনের সমান যত্নেরই প্রয়োজন।
তবে কজনেই বা শুনেন তাদের সে মনের কথা। আর মনের যত্নের কথা কজনই বা ভাবেন? আর সেখানে নারী সদস্যের বেলায় তো খুবই আশ্চর্যজনকই শোনায়। তারা নিজের খিদা লাগার কথাই যেখানে গুরুত্ব দেননা সেখানে মনের সুস্থতাকেই বা কতটা গুরুত্ব দেবেন!
অথচ প্রতেক নারীর শরীরের যত্নের সঙ্গে সঙ্গে দরকার মনেরও যত্ন নেয়া। আমাদের সমাজে নারীরা শারীরিক অসুস্থতা, অপর্যাপ্ত ঘুম, সাংসারিক কাজ, যৌন নির্যাতন, ইভটিজিং, পারিবারিক নির্যাতনসহ নানা ধরনের মানসিক চাপে থাকেন। আবার মেনোপজ, গর্ভকালীন বিষণ্নতা, বয়ঃসন্ধিক্ষণসহ কিছু প্রাকৃতিক নিয়মের কারণেও নারীরা বিষণ্নতা, হতাশা, কাজে অনীহাসহ নানা ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকেন। কিন্তু এটাকে অসুখ বলে গণ্য করার প্রবণতা এখনো নারীর মধ্যে তৈরি হয়নি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিতএক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে দুই কোটির বেশি মানুষ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছে।আর প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ১৮ শতাংশের বেশি বিষণ্নতায় আক্রান্ত, যাদের বেশির ভাগই নারী।
আসলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নারীর মানসিক অবস্থা যে মানসিক অসুস্থতা, তা অনেকেই বুঝতে বুঝতে চান না। ফলে অসুস্থ মানসিক অবস্থা একসময় নারীকে মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত করে তোলে, যা নারীকে কখনো কখনো ঠেলে দেয় আত্মহত্যার পথে। কখনো বা তারা হত্যা করে বসে সন্তান, স্বজনকেও। কেউ আবার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। কেউ বা নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে।’
অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় মেয়েদের অসুখের কথা পরিবার তেমন আমলে নেয় না।আর যদি হয় মানসিক সমস্যা তাহলে পরিবারের সদস্যরা বদনামের ভয়ে তাকে ডাক্তারের কাছে নিতে চান না। আর নারী নিজেও তার রোগ সম্পর্কে সচেতন নন। তাদের মধ্যে রোগ লুকানোর একটি প্রবণতা থাকে।
এদিকে প্রকৃতি গত ভাবেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নারীর শারীরিক পরিবর্তন হতে থাকে। আর সে পরিবর্তনের প্রভাব পরে নারীর মানসিক স্বাস্থ্যে। এসম্পর্কে আলোচনা করেছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার শাহনিলা তৈয়ব।
তিনি বলেন, মেনোপজের মত একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় নারীদের মাঝে নানা মানসিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে ।এসময় বিভিন্ন ধরনের উদ্রেক, রেগে যাওয়া, অরুচি হতে থাকে। ছাড়াও গর্ভধারণে অক্ষমতা, গর্ভপাত, ছেলেসন্তান না হওয়া নিয়ে ভাবনা, গর্ভবতী অবস্থায় হীনম্মন্যতাবোধ, বিষণ্নতা নারীর মানসিক চাপ অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়।
নারীর মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে যেসব বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি
* মানসিক সুস্থতা ও সুস্থ ভাবাবেগ পেতে নিজের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। নিজের জন্য কিছুটা সময় আলাদা রাখা যেতে পারে , নিজের মনের কথা শোনা ,বই পড়া, গান শোনা।
* সুষম ও পুষ্টিকর খাবার কেবল শরীরকেই নয় , মনকেও ভালো রাখে। অন্যদিকে অস্বাস্থ্যকর ফ্যাটি খাবার আমাদের বিষন্নতার জন্য মারাত্মক দায়ী। ভিটামিন বি -১২, ওমেগা -৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার মস্তিষ্কের আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী হরমোনগুলোকে চাঙ্গা রাখতে সাহায্য করে।, তাই প্রত্যেক নারীকে পুষ্টিকর খাবার নিয়মিত খাওয়া জরুরি।
* শরীর ও মন সুস্থ রাখতে পর্যাপ্ত ঘুমের বিকল্প নেই। কারণ পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠে ফলে ক্লান্তিবোধ করেন। নারীর তাই মানসিক স্বাস্থ্য সুস্থ রাখতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম জরুরি।
* মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য শারীরিক ব্যায়াম খুবই জরুরি। স্ট্রেস ও বিষন্নতা কাটাতে ব্যায়াম ভীষণ কাজে আসে। ব্যায়ামের ফলে শরীরে ক্লান্তি ও মানসিক চাপ হ্রাস পায়। তাই মনকে চাঙ্গা রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম করার অভ্যেস গড়ে তোলা সব নারীর জন্য প্রয়োজন।
* নিজের শখের কাজগুলি করতে পারলে মন ভালো থাকে, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। দুশ্চিন্তা মাথায় আসে না। যেমন – বাগান করা , রান্না কিংবা সেলাই করা, নতুন কোনো কিছু শেখা ইত্যাদি। ফলে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করে।
* নিজের দুর্বলতাগুলো মেনে নিয়ে নিজের ক্ষমতার ওপর বিশ্বাস রাখলে জীবনে এগিয়ে চলার সাহস পাওয়া যায়।