সোশ্যাল মিডিয়া ও দুরন্ত শৈশব
সাধারণত শৈশব বলতে যা বোঝায় তা বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিশুরা কতটা পাচ্ছে! মাঠ-ঘাটে ছুটে চলা দুরন্ত শৈশবকে যেন গ্রাস করে নিয়েছে স্রেফ সোশ্যাল মিডিয়া। এতে আসক্ত হয়ে শিশুরা যেন একরকম খালিই ফেলে রাখছে স্মৃতির বাক্সগুলো। শৈশবের সোনালি দিনের দুরন্তপনায় ডুব না দিলে আর কতটাই বা স্মৃতি জমবে সে বাক্সে! সোশ্যাল মিডিয়ার নেশায় ডুবে এসময়ের শিশুরা প্রকৃতির দুরন্তপনার সৌন্দর্য উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সম্প্রতি কচি হাতের মুঠোতে স্মার্টফোন আর সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার গ্রীক ও রোমান রূপকথার সেই হাইড্রার মাথার মতো দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর দেখা যাচ্ছে শিশুদের অনুসন্ধিৎসু মনের সুযোগে সোশ্যাল মিডিয়া তার শতবাহু বাড়িয়ে অক্টোপাসের মতো পেঁচিয়ে ধরছে তাদের। ফলে বাড়ন্ত শিশুদের হাতে স্মার্টফোন আর সোশ্যাল মিডিয়া তাদের উপকার করছে নাকি ঝুঁকিতে ফেলছে তা নিয়ে ভাবতে হবে অভিভাবকদেরই।
যদিও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা অস্বীকার করা কোন উপায় নেই। আধুনিক ডিজিটালের এ যুগে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার করা থেকেও বিরত থাকা যায়না। ছেলেমেয়েদের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ ও পরিবারের সবার খোঁজ রাখতে হয় এর ব্যবহারের মাধ্যমেই। অনুভূতি প্রকাশের এই মাধ্যমটির উপকারিতার কথা সর্বজনবিদিত। ছাত্রছাত্রী, শিক্ষকরা গ্রুপের মাধ্যমে পড়াশোনার কাজেই ব্যবহার করছে সোশ্যাল মিডিয়া। তবে এই স্মার্টফোন আর সোশ্যাল মিডিয়ার মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেদিকে মনোযোগ রাখা জরুরি।
মনে রাখতে হবে, ‘প্রতিরোধ প্রতিষেধকের চেয়ে উত্তম’। প্রথম থেকেই শর্ত না দিলে পরবর্তীতে শর্তারোপ করা কঠিন হয়ে পড়ে। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা যতই থাকুক তবুও ছেলেমেয়েদের জন্য সেটির একটা রুটিন মাফিক হাতে দেয়া অভিভাবকদেরই দায়িত্ব। অর্থাৎ কখন বা কতক্ষণ ব্যবহার করা যাবে, রাতে ও স্কুলের সময়ে ফোনটি কোথায় থাকবে, লক সিস্টেম বাবা-মা জানবে কিনা, কোন কোন অ্যাপ ব্যবহার করবে, অনিয়মের কি প্রতিফলন হবে ইত্যাদি বিষয় নির্দ্দিষ্ট করে শিশুর হাতে স্মার্টফোন দেয়া ভালো।
এছাড়া দেখা যায় , সোশ্যাল মিডিয়ার সাইটগুলোতে নানা ধরনের রেকমেনডেশন পাঠানোর জন্য যেসব প্রোগ্রাম দেয়া থাকে, সেগুলো শিশুদের বয়সোপযোগী না হওয়ায় অনেক বেশি ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। অনেকে মানসিক অবসাদ কিংবা আত্মহত্যার জন্য তথ্য খুঁজলে তাও এসব রেকমেনডেশন ইঞ্জিনগুলো আরও বেশি করে তথ্য পাঠায়। তাই সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষতিকর কন্টেন্ট ও ভিডিও থেকে শিশুদের দূরে রাখতে বাবা-মায়ের সচেতনতাটাই সবচেয়ে জরুরি।
ব্রিটেনের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ অফকমের হিসাব অনুযায়ী, ১২-১৫ বছর বয়সীদের ৯০ শতাংশের হাতে মোবাইল ফোন রয়েছে। এদের মধ্যে প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজনের এখন সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টও রয়েছে। আইন অনুযায়ী, জনপ্রিয় অ্যাপগুলোতে ১৩ বছর বয়সের নিচে কাউকে অ্যাকাউন্ট খুলতে দেয়ার কথা না। কিন্তু তা সত্ত্বেও শিশুরা এসব অ্যাকাউন্ট তৈরি করছে এবং তাদের ঠেকাতে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো কিছুই করছে না। ব্রিটেনের শিশু রক্ষা চ্যারিটি ন্যাশনাল সোসাইটি ফর দ্য প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েল্টি টু চিলড্রেন্স (এনএসপিসিসি) শিশুরক্ষা নীতি বিভাগের প্রধান এন্ডি বারোস জানান, শিশুরা এসব কন্টেন্ট দেখে যে ঝুঁকির মুখে পড়ছে তা বিবেচনা করার জন্য আইন তৈরি করে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করা উচিত।
সোশ্যাল মিডিয়ার অনেক নেতিবাচক দিক রয়েছে। বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে, এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহারের প্রভাবে বিপথগামী হচ্ছে অল্পবয়সীরা, মানসিক সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে, পড়াশোনায় মনোযোগ হারাচ্ছে, খেলাধুলা ছেড়ে দিয়ে দিনরাত ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত থাকছে।
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ব্যবহারকারীদের বড় একটি অংশ বয়সে কিশোর-কিশোরী, যারা অল্প সময়ে কিছু একটা করে দেখানোর মনোভাব নিয়ে থাকে। ফলে অনেক সময় সাইবার অপরাধীদের ফাঁদে পড়ে অপরিসীম ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হলো কম্পিউটারকেন্দ্রিক এক ধরনের প্রযুক্তি যা ভার্চুয়াল কমিউনিটি এবং নেটওয়ার্কের মধ্যে মানুষকে বিভিন্ন তথ্য, ধারণা, ক্যারিয়ার-সম্পর্কিত বিষয় এবং অন্যান্য ঘটনা ভাগাভাগি করার সুযোগ করে দেয়।
বর্তমানে ফেসবুক যেন হঠাৎকরেই সমাজের দর্পণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সমাজে ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচক চিন্তার মানুষ যে বেশি এটি ফেসবুকের বদৌলতে আরও স্পষ্ট হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত উত্থান এক কল্পিত জগৎ তৈরি করেছে। ছবি, শব্দ, লেখার সাহায্যে সামাজিক মাধ্যমে যে জগৎ তৈরি হচ্ছে সেটি কৃত্রিম। এটি গ্রাস করে নিচ্ছে বাস্তবজগৎকে।
আজকের পৃথিবীতে নেট আসক্তিকে তুলনা করা হচ্ছে জীবনগ্রাসী মাদকাসক্তির সঙ্গে। প্রযুক্তি বিশ্লেষকগণ প্রযুক্তি আসক্তির অশনিসঙ্কেত দিলেও কে শুনে কার কথা! রঙিন চশমা পরা সে দুনিয়ায় গা ভাসিয়েছে ছেলে বুড়ো সকলেই। আর দারুণ সুকৌশলে সোশ্যাল মিডিয়াগুলো ছেলেমেয়েদের মগজধোলাই করে তাদের সবটুকু মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছে। তাদের জীবনেরসীমা আটকে যাচ্ছে আঙুলের ছাপের কিছু লাইক, শেয়ার আর কমেন্ট সেকশনে। এই সোশ্যাল মিডিয়াগুলো তরুণ সমাজের যেমন উপকার করছে, তেমনি তাদের নিজেদের অজান্তে তাদের ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকারে। শিক্ষাগ্রহণের এই বয়সে সারাক্ষণ ফেসবুকের নেশায় বুদ হয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে নতুন প্রজন্ম।
ক্ষুধামন্দা, মানসিক বৈকল্য, বিষণ্নতা ও শারীরিক অক্ষমতা তৈরি হচ্ছে তাদের মধ্যে। ফলে কোমলমতি এসব ছেলেমেয়ের মনোযোগ কমে যাচ্ছে পাঠাভ্যাসে, সেই সঙ্গে সামাজিক সৌজন্যতাবোধও। খিটখিটে মেজাজ, হিংস্রতা, চোখের অসুখ, নার্ভের সমস্যা দেখা দিচ্ছে তাদের। মানসিক ভারসাম্যহীনতার মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ফেসবুকচারী এই প্রজন্ম।
শিশুদের এই আসক্তি থেকে বাঁচাতে নজর দিতে হবে শিশুদের ফোন ব্যবহারের ওপর। কখন, কোথায়, কতক্ষণ তারা ফোনে সময় কাটাচ্ছে তা খেয়াল রাখতে হবে। এক্ষেত্রে তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে ক্ষতিকর দিক গুলো সম্পর্কে। এছাড়া অভিভাবকদেরও সন্তানের সামনে অনুকরণীয় রোল মডেল হতে হবে। অভিভাবক নিজেই যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্ত থাকেন, বাচ্চারা তো সুযোগ পাবেই। আসক্ত সন্তানদের সামনে অন্য আত্মীয়স্বজন ও পারিবারিক বন্ধুদেরও মোবাইলে বুঁদ হয়ে থাকতে নিষেধ করতে হবে।
অন্যদিকে এই আসক্তি থেকে শিশুদের দূরে রাখতে তার পছন্দের কিছু দিয়ে তাকে ব্যস্ত রাখতে হবে। এক্ষেত্রে নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি, সাতার, জুডো, কারাত অনুশীলন, শরীরচর্চা, বইপড়া, বাগান করা, সেলাই বা রান্না- এমন অনেককিছু নিয়ে ভাবতে হবে যা আপনার সন্তান ভালোবাসে। প্রযুক্তির এই যুগে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। সন্তানের সোশ্যাল মিডিয়ার আইডি সম্পর্কে নিশ্চিত থাকতে হবে। তার একাধিক আইডি আছে কিনা খোঁজ রাখতে হবে। বন্ধুসুলভ আচরণ করে ফোনের পাসওয়ার্ড ও সেফটি লক সম্পর্কে জেনে নেয়া ভালো।