নারীর পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাই নারীর শত্রু
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন থেকে শুরু করে তসলিমা নাসরিন পর্যন্ত সবাই নারীকে নিয়ে নানাবিধ কথা বলেছেন। তবে আজ অবধি নারী শেকল ছিঁড়ে বের হতে পারেনি। এ সম্পর্কেও সমাজে নানামুখী কথোকতা প্রচলিত। শিক্ষা-জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পরও নারীরা অসহায়-নিপীড়িত-নির্যাতিত। নারীর নিজস্ব অভিরুচি সমাজের প্রচলিত সংস্কার-কুসংস্কার বা প্রথার কাছে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে। নারী হয়ে পড়েন অসহায়।
পুরুষতন্ত্রের ধারক-বাহক এ সমাজে এক শ্রেণির নারীও বটে। যারা বিশ্বাস করে একইসঙ্গে সর্বদা মন এবং মগজে ধারণ ও লালন করে স্ত্রীর ওপর স্বামীর কল্যাণ নিহিত। তাই স্বামীর কল্যাণকামনায় স্ত্রীকে তথা নারীকে নানারকম ত্যাগের মধ্যে দিয়ে জীবনকে প্রতিপালন করতে হবে। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যদি নারী তার জীবনাচরণে পরিবর্তন না আনেন তবে নারীকে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হয়। বলা চলে নারীকে কৈফিয়ত দিতে হয়। মূলত একজন নারী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে তার বিবাহপূর্ব যে আচরণ বা উচ্ছলতা থাকে তার সবটাই বিয়ের হলুদ লাগার সঙ্গে সঙ্গে মুছে ফেলতে হয়।
নারী হয়ে পড়েন কোনো বিশেষ ব্যক্তির গচ্ছিত আমানত। আর এই আমানতের ফলস্বরূপ নারী কিন্তু তার সবটাকে বিসর্জন দেওয়ার চেষ্টা করলেও পুরুষ সেক্ষেত্রে নির্বিকার। তার বা এই গোষ্ঠীর জীবনাচরণে কোনোই পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় না। এমনকি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পূর্বে তার যত অভ্যেস তিনি ঠিক ততটাই আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করেন। আবার তেমনই অনেক স্বাধীনচেতা পুরুষ নারীর ওপর ছেড়ে দেন যে, তাকে ভালো না লাগলে সঙ্গে না থাকুক কিন্তু তিনি তার কোনো অভ্যেসই ছাড়তে নারাজ। একইসঙ্গে যৌক্তিক প্রশ্ন থেকেই যায় তাহলে এই শ্রেণি কি স্ত্রী বা নারীর সব চাওয়া বা তার অভ্যসে বাধা দেন? বেশিরভাগেরই উত্তর আসবে হ্যাঁ । তারা নিজেরা অর্থাৎ পুরুষ নিজে না পাল্টালেও নারীকে অবশ্যই পরিবর্তন হতে হবে। কারণ সে কারো বউ, বউমা, ভাবি, মামি, কাকি, চাচি, পিসি, মাসি ইত্যাকার সম্পর্কে জড়িত৷ ফলে নারীর মধ্যে পূর্বের উচ্ছলতা, প্রাণবন্ততা, হাসি, মজার ক্ষেত্রে রেশ টানতে হয়। সর্বোপরি জীবনের পুরো ভূগোলটাই পরিবর্তন করতে হয়। কখনো চাপে পড়ে কখনো সংস্কার, প্রথা, কুসংস্কারের প্রেক্ষিতে।
একটি কথা আরেকটির জালে বন্দি ফলে নারীর প্রসঙ্গে বলতে গেলে প্রকৃতার্থে কোনটিকে আসলেই এড়িয়ে যাওয়া যাবে তা বলা মুশকিল। ফলে নারী মানেই এক অবরুদ্ধ, অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত পোষ মানা প্রাণী। যার নিজের কোনোই অস্তিত্ব থাকতে নেই। পিতা-ভাই-স্বামী-সন্তানের কাছে অবলা নির্জীব প্রাণহীন জড়বস্তুর মতো কোন এক পুতুল সদৃশ। তাই নারীকে ইচ্ছে মতো সাজানো যায়, শাসন-শোষণ করা যায়। দায় চাপিয়ে মুক্তি পাওয়া যায়। এই দায় প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে কিছু বিষয়ের অবতারণা করতেই হয়-
নারীকে অবরুদ্ধ করে পরিবার-পরিজন সর্বোপরি সমাজ। নারী শৃঙ্খলে আবদ্ধ। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক, প্রথমত সমাজের ধারক-বাহক হিসেবে একজন নারী মূলত দুটি পরিবারকে কেন্দ্র করে বসবাস গড়ে ওঠে। জীবনের প্রথম পর্যায়ে অর্থাৎ শৈশব -কৈশোর এবং যৌবনের কিয়দংশ পিতার আশ্রয়ে বড় হয় মেয়েরা। তৎপরবর্তীকালে স্বামীর সংসারের অন্যতম ধারক-বাহক বা প্রতিপালক হিসেবে উপনীত হন। তবে এখনও অনেক মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার! ফলে তাদের জীবনের বেশিরভাগাংশই কাটে স্বামীর দাসীবৃত্তি করে।
দাসীবৃত্তি শব্দটির সঙ্গে আজকের সভ্যযুগে এসেও নারীমাত্রই পরিচিত। কারণ প্রথমত নারীকে একজন পুরুষ যখন বিয়ে করেন তখন তিনি কিছু জিনিসের সার্টিফিকেট পেয়ে যান। প্রথমত. যৌন চাহিদা মেটানোর একজন পার্মানেন্ট সঙ্গী। দ্বিতীয়ত. গৃহকর্মে নিপুণা অবলা নির্জীব প্রাণী যিনি শত দুঃখ-কষ্টেও মুখে রা কাড়বেন না। ফলে পুরুষতন্ত্রের এই চাহিদানুযায়ী অভিভাবক শ্রেণিও তার কন্যা সন্তানকে প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। বিয়ের পর স্বামীর আদর-যত্ন-আপ্যায়নে যেন কোনোই ত্রুটি না থাকে সেলক্ষে কন্যা সন্তানকে পড়াশোনা করানোর পাশাপাশি গৃহকর্মে নিযুক্ত করা হয়। যদিও সময়ানুযায়ী কিঞ্চিৎ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে তবু আজও অধিকাংশের মনেই সুপ্ত বাসনা লালিত। ফলে নারী হতে হলে নিজের এবং পরিবার-পরিজনের দায়ভার তাকে সামাল দিতেই হবে।
এবার আসুন নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া কিছু সংস্কার তথা কুসংস্কারের সীমানায়। আজও পুরুষতন্ত্রের ধারক-বাহকেরা মন ও মগজে ধারণ করেন পুরুষের কল্যাণের জন্য বিয়ের পর নারীর আমূল পরিবর্তন আনা জরুরি। উদাহরণস্বরূপ বলা যাক, যদি কোনো নারী বিয়ের পর হাতে চুড়ি, নাকে নাকফুল না পরেন তবে স্বামীর ক্ষেত্রে অশুভ হিসেবে ধরা হয়৷ যদি স্বামীর কোনোরকম অসুখ-বিসুখ হয় বা কোনো দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন তবে সর্বপ্রথমে আঙুল তোলা হয় নারীর ওপর। তাকে নানাভাবে অপদস্ত করা হয়। যদিও পূর্বের সব নারীই এসব রীতিনীতি মেনে চলতে পটু ছিলেন তবে আধুনিকতার যুগে কিঞ্চিৎ নারী সমাজ এসব তুচ্ছ বিষয়কে আমলে নেন না। ফলে তারা যে আমলে নিচ্ছেন না এই বিষয়ে তাদের গোয়ার্তমিকেই দোষারোপ করা হয়! তবু আশ্চর্য হতে হয় এসব সংস্কার-কুসংস্কার বা প্রথার কোনোই পরিবর্তন হচ্ছে না, কিছু মানুষের কাছে। আর বলি হতে হয় কিছু যুক্তিবাদী, নির্বিবাদী নারীকে। ফলে তারাও নিজের ওপর থেকে তির্যক তীর ঠেকাতে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসায়। এই উদাহরণ শুধু নাকফুল বা হাতের চুড়ির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয় এই পরিস্থিতি-পরিবেশ নানাবিধ সমস্যা-সংকট-প্রতিকূলতাকে এড়িয়ে যাওয়ার মাধ্যম কিছু নারীর কাছে! তবে কী আজীবন নারীরা মেনে নেবে পরিবার-পরিজন -সমাজের যুক্তিহীন, কুসংস্কার-সংস্কার বা প্রথা নামক অপপ্রথাকে?
পরিবার-পরিজন-সমাজের এসব কপটতা, ভণ্ডামিকে গ্রাস করতে হলে নারীর গোয়ার্তুমিই প্রাধান্য পায়। কারণ কথায় আছে, সোজা আঙুলে ঘি ওঠে না। ফলে সমাজের আমূল পরিবর্তন আনতে হলে নারীকেও যুগের চাহিদা অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করতে হবে। অর্থাৎ যুক্তি-বিচার-বিজ্ঞান এবং কল্যাণের পথে হাঁটতে হবে। একমাত্র মাথা নত করতে শিখতে হবে জ্ঞান-বিজ্ঞান -বিবেক-মনুষ্যত্ব -মানবিকতা এবং কল্যাণময় কাজের কাছে। শৃঙ্খলতার সব অপঘাতের বুকে পদাঘাতে জর্জরিত করুক নারী শক্তি। চেতনার অমেঘ বাণ বিদ্ধ করুক নারীর সৃজনশীল-মননশীল সত্তা। নারী হয়ে উঠুক আপন পথের দিশারী৷ জাগুক প্রাণ। গড়ুক পৃথিবী।