নারীর প্রতি মানবিক হওয়ার এখনই সময়
জান্নাতুল যূথী
নারীর প্রতি সহিংস অপরাধ প্রবণতা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। নারী কোথাও নিরাপদ নয়। পরিবার-পরিজন তথা ঘরে-বাইরে ওঁৎ পেতে বসে আসে একশ্রেণির ভণ্ড ও অসাধু। যার ফলস্বরূপ নারীকে ভোগ করতে হচ্ছে নানামুখী সমস্যা। আমরা জানি, সমাজে নারীরা একদিকে যেমন এগিয়ে যাওয়ার জন্য দিনান্ত লড়াই করে চলেছে তেমনই নারীদের আবদ্ধ করে রাখতে তাদের ওপর চলছে শোষণ, অত্যাচার, জুলুম। নারীর প্রতি সহিসংতার ধরণ যুগের সঙ্গে বদলালেও মূল অত্যাচার থেকে নারী রক্ষা পায়নি। অত্যাচারের মাধ্যমে নারীকে বশে আনার চেষ্টা করে নিপীড়নকারী। নারীকে তার অবস্থান থেকে সরিয়ে দিতে কুচক্রী মহলের ফাঁদ থেকে বাঁচতে নারীকে সবসময় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়।
বর্তমান সময়টা খুবই কলুষিত। মানুষ মানুষকে মূল্যায়ন করছে না। একজনের বিপদে আরেকজন এগিয়ে আসার মানবিক শিক্ষা এ সমাজে বেশ অপ্রতুল। আর নারীর ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো আরও অধিক। নারীকে ঘরবন্দি করতে, টেনেহিঁচড়ে নিচে নামানোর পায়তারা চলছে। শিশু থেকে বয়োবৃদ্ধ কেউ এই সহিংসতা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। যার যা খুশি তাই উচ্চারণ করছে। যেন এক অঘোষিত আইনে পরিণত হয়েছে যে, নারীকে অপমান-অপদস্ত-লাঞ্ছিত করতেই হবে!
সমগ্র বিশ্বের প্রতি ৩ জন নারীর ১ জন নানাবিধ নির্যাতনের শিকার। কেউ যৌন নির্যাতনের শিকার, কেউবা ধর্ষণ, গৃহ নির্যাতন, লিঙ্গভিত্তিক গর্ভপাত, প্রসবকালীন সহিংসতা, পারিবারিক কলহ, দাম্পত্য সংকট, যৌতুকের শিকার, নারী খৎনা, অপহরণপূর্বক বিবাহ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, শ্বশুর, দেবর বা স্বামী কর্তৃক নিপীড়ন, বাল্যবিয়ের শিকার, পাথর ছুড়ে- চাবুক মেরে হত্যা, পোশাক পরিধানকে কেন্দ্র করে নারী নিপীড়ন, যৌন দাসত্ব, জোরপূর্বক গর্ভপাত, নারী পাচার, জোরপূর্বক বেশ্যাবৃত্তি, রীতি বা সম্মানরক্ষার্থে হত্যা তথা অনার কিলিং প্রভৃতি বহুমুখী সহিংসতা নারীর সঙ্গে ঘটে চলেছে সমাজে। নারীর এই বন্দিদশার মুক্তি কোথায়?
একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বিশ্বজুড়ে নারী নিপীড়নের চরমতম রূপ সর্বত্রই চোখে পড়ছে৷ ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান থেকে শুরু করে বিশ্বের মোটামুটি সবদেশেই নারীকে জিম্মি করা হচ্ছে। নারী সেখানে শোষণের হাতিয়ার। ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, অপব্যাখ্যা দিয়ে নারীকে বারংবার তার জায়গা থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে । বিশ্বের দিকে লক্ষ করলে সহজেই অনুধাবনযোগ্য যে, নারীদের অবস্থান সত্যি চরম সংকটে। নারীকে অবরুদ্ধ করতে শ্বাসরোধ করা হচ্ছে।
মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতার পথে অন্তরায় দেখা দিলে সেই ব্যক্তি বা সেই গোষ্ঠীর স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হয়। নারীর ওপর নানারকম বিধিনিষেধ চাপিয়ে দিয়ে নারীর পথকে শ্লথ করা হচ্ছে। নারীর গতি স্তিমিত করা হচ্ছে। আর নারীরা এই সংকট থেকে বের হতে যখন আন্দোলনের পথ বেছে নিচ্ছে তখনও নারীকে পুনরায় অবরুদ্ধ করা হচ্ছে। জীবন্ত পাথর নিক্ষেপ করা হচ্ছে, কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। বাজে এবং কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ভরে উঠছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এসব ধুরন্ধর মিথ্যাশ্রয়ী বিধিনিষেধ নারীর জন্য হুমকি। নারীরা তাদের জীবনযাত্রার সঠিক, স্বাভাবিক পরিবেশ পাচ্ছে না। যতই বলা হোক না কেন আজকের নারীরা পূর্বের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে চলেছে কিন্তু সহিংসতা প্রতিরোধ করা যায়নি। নারী এগিয়েছে তার দক্ষতা, যোগ্যতায়, মনোবলে। এক্ষেত্রে সমাজের বৃহত্তর অবদান নেই বললেই চলে।
নারী জন্ম থেকে বৃদ্ধ অবস্থা পর্যন্ত সর্বদা নিপীড়নের শিকার। শুধু ধরণটা বদলে যায়। আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে নারী নিপীড়নের যেমন নতুন কিছু প্লাটফর্ম তৈরি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যামে যৌন নিপীড়ন, হুমকি- ধামকি, ব্লাকমেইলিং, এডিটিং করে ন্যুড ছবি প্রকাশ, প্রেমের নামে যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রভৃতি সহিংস অপরাধ গড়ে উঠেছে সময়ের সঙ্গে। ফলে বলা চলে নারী আগের থেকে এখন আরও বেশি সমস্যার মধ্যে দিয়ে সময় পার করছে। এখন সহজেই নারীকে ফাঁদে ফেলা যায়।
নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রকে একযোগে কাজ করতে হবে। কথায় আছে দশের লাঠি একের বোঝা। তাই একজন যতই সমাজের আমূল পরিবর্তন ঘটাতে চেষ্টা করুক না কেন তা ফলপ্রদ হওয়ার সম্ভবনা কম। ফলে পরিবার থেকে নারীর প্রতি সহিংস আচরণ কমিয়ে আনতে হবে। আমাদের পরিবারগুলো আজও কন্যা সন্তান এবং ছেলে সন্তানকে আলাদা গুরুত্ব দেয়। যতদিন পরিবারে সাম্য গড়ে না উঠবে ততদিন সমাজেও সমতা স্থাপন করা আকাশ- কুসুম কল্পনা। কারণ পরিবারের মাধ্যমেই ব্যক্তির প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি। একজন মা সন্তানকে সুন্দর মননের এবং সুস্থ মানসিকতায় গড়ে তুলতে পারেন। ফলে সন্তান যেহেতু মায়ের সান্নিধ্যে বড় হয় ফলে এখানে নারীদেরই কিন্তু অবদান বেশি তার নিজেকে সম্মানীয় করে তুলতে। নিজে নারী হয়ে যদি ঘরের কন্যা সন্তানটিকে ছোট করে দেখেন বা নিজ জীবনে কষ্ট বলে নারী জন্মই কষ্টের এই ধারণার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। পরিস্থিতি বোঝানো অবশ্যই মায়ের দায় কিন্তু সেইসঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলাও মা’কেই শিক্ষা দিতে হবে। পরিবারের মাঝে যদি সন্তানের সুষ্ঠু মানসিক বিকাশ ঘটে তাহলে বৃহত্তর অর্থে সমাজের পরিবর্তন নিশ্চিত হবে।
স্কুল- কলেজ -বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছেলে-মেয়েদের মানস গঠনের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান। ফলে স্কুলের শিক্ষকদের হতে হবে উদারচিন্তার। নৈতিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ। ফলে তাদের জীবনাচারণ পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত হবে। কন্যা শিক্ষার্থীদের প্রতি পারস্পারিক শ্রদ্ধাপূর্ণ মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। প্রত্যেক মানুষ স্রষ্টার সৃষ্টি। মানুষের ব্যক্তিক স্বাতন্ত্র্য অবশ্যই থাকবে। হাতের পাঁচটি আঙ্গুল যেমন একই মাপ বা গঠনের নয় তেমনই মানুষের মত- পথের বৈশিষ্ট্য কখনোই খারাপ নয়। কিন্তু তা যেন নেতিবাচক না হয় সেদিকে আমাদের সমাজ গঠনের কর্তা ব্যক্তিদের নজর দিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠ্যের মধ্যে এরূপ কিছু অধ্যায় সংযোজন করতে হবে যার দ্বারা মানবিক গুণ বৃদ্ধি পায়। নৈতিক জীবনযাপনের প্রতি আকৃষ্ট করা যায়। রিপু থেকে মুক্তি মেলে।
সমাজ পরিবর্তনে মানসিকভাবে সুস্থ জীবনের বিকাশ ঘটাতে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অভিভাবক, বন্ধু, পরিজন, শিক্ষকদের একযোগে দায়িত্ব পালন করতে হবে। জাতি এখন বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি। যদি এই সমাজের সুস্থ পরিবেশ গড়ে তুলতে হয় তবে দ্রুত মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। মানুষকে মানুষরূপে দেখার দৃষ্টি তৈরি করতে হবে৷ কে নারী আর কে পুরুষ এই লিঙ্গবৈষম্য ভুলে সমাজের জন্য একযোগে কিভাবে উন্নয়নে অংশ নেওয়া যায় তার প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে। বিশ্বজুড়ে চলা নারীর অবরুদ্ধ পরিস্থিতি ধ্বংস করতে হবে৷ কুসংস্কার, গোঁড়ামি শোষণমূলক মনোভাব নারী জাতির জাগরণের পথে অন্তরায় ফলে সমাজ থেকে এই চিন্তাধারা দূর করতে হবে। এ লক্ষে নারীরাই পারে নিজস্ব অবস্থান সৃষ্টি করতে। পরিবার থেকে সন্তানের মানস গঠনের প্রতি মনোযোগী হতে। তাই স্বজাতির প্রতি নিপীড়ন রুখে দিতে গাছের গোঁড়ায় জল ঢালতে হবে। তাহলে নিশ্চিত অর্থেই একদিন গাছের আকার-আকৃতি বাড়ার সঙ্গে ফুল-ফলে ভরে উঠবে।
যতদিন নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বৃদ্ধি না পাবে, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির উদয় না হবে ততদিন নারীকে এই কলুষতাযুক্ত সমাজে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে! নারীর সুন্দর-সুশৃঙ্খলরূপে বসবাসে ব্যাঘাত ঘটবে। নারীকে বাঁচাতে হলে, পৃথিবীর সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে হলে এ জগৎ সংসারে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। নারীর প্রতি মানবিক ও উদার চৈতন্যই দেশ ও রাষ্ট্রের আমূল পরিবর্তন ঘটাতে বাধ্য।