নারীর মুডসুইং: বিরক্ত নয় পাশে থাকুন
যান্ত্রিক জীবনের টানাপোড়েনে বর্তমানে সবাই বেশ মানসিকভাবে বিধস্ত-হতাশাগ্রস্ত। তবে নারীর ক্ষেত্রে মুডসুইং বিভিন্নভাবে দেখা দিতে পারে। সামাজিক জটিলতাকে কেন্দ্র করে যেমন আসতে পারে ঠিক তেমনই “হরমোনাল ক্রাইসিস”-এর কারণেও এ সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তাই বিরক্ত নয় বরং নারীকে ভালোবাসুন। পাশে থাকুন। কিন্তু তা না করে আমাদের সমাজ কটুক্তি, বিদ্রুপের হাসি হাসতে বেশি পছন্দ করে। ফলে বর্তমানে সুইসাইডাল এটেম্প বেশি ঘটছে! নারীরা মানসিকভাবে অসুস্থ হলে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন!
মুডসুইং’ লিঙ্গভেদে নারী-পুরুষ উভয়েরই হয়। তবে নারীদের জীবনে বিভিন্ন কারণে মুডসুইং ঘটে থাকে। প্রধানত নারীরা অনেকটা ঘরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত। ফলে একঘেয়ে, বিষাদ থেকে মুডসুইং ঘটে। আবার যে নারীরা কর্মজীবী, তাদের ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক নানা চাপে মুডসুইং ঘটে থাকে। তবে মেডিক্যাল সাইন্সে নারীর মুডসুইং বিষয়ে কিছু বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। নারীর ‘মুডসুইং’ সম্পর্কে বলা হয় হরমোনের প্রভাব, পুষ্টিহীনতা, লৌহ, ভিটামিন ও খনিজের অভাব মেজাজের দ্রুত ওঠা-নামার জন্য দায়ী। এ সময় নারীর হঠাৎ করে মন খারাপ হয়ে যায়, রাগ হয়, কান্না পায়, আবার চট করেই মনে উৎফুল্লভাব বা আনন্দ অনুভব করার মতো অনুভূতিও হয়। ফলে নারীদের মুড সুইং এর ঘটনায় নারীর জীবনে বিশেষ প্রভাব পড়ে।
পিরিয়ডের সময় শরীর থেকে প্রচুর আয়রনের ক্ষয় হয় নারীদের । এবং তা পূরণ না করার ফলে ধীরে ধীরে ‘মুড সুইং’য়ের দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনকি বেশিরভাগ নারীরই এসময়টা মেজাজ খুব খিটমিটে, রাগী, এবং মনটা অশান্ত থাকে। এছাড়া যান্ত্রিক জীবনে ‘মুড সুইং’ নারী পুরুষ উভয়েরই হয়ে থাকে। জীবনযাত্রা, কাজের চাপ, মানসিক চাপ, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি বিষয়ও ‘মুড সুইং’য়ের অন্যতম কারণ।
আবার কৈশোরে ছেলে-মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন হয়। এবং দেহের হরমোনের পরিবর্তন ঘটে। ফলে ‘মুড সুইং’ হয়। এই সময়ে ছেলে-মেয়েরা অনেক বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ার কারণে তাদের মধ্যেও মুডসুইং ঘটে থাকে। মুড সুইং নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করলেও নারীর মধ্যে বিশেষভাবেই মুড সুইং এর প্রবণতা লক্ষ করা যায়। নারীদের শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন কারণে মুড সুইং হয়। তবে প্রতিমাসে পিরিয়ডের কারণে অধিকাংশ নারীরই ‘মুড সুইং’ হয়। এছাড়াও, গর্ভাবস্থায় হরমোনের ওঠানামা মনের ওপর প্রভাব ফেলে। এই সময়ও মায়েদের মধ্যে দেখা দেয় ‘মুড সুইং’। মায়ের শারীরিক পরিবর্তন ঘটে বিধায় তার মেজাজেরও তারতম্য ঘটাতে পারে।
নারীদের ক্ষেত্রে মুড সুইং এর আরও একটি কারণ যখন পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মেনোপোজের সময় এস্ট্রোজেন নামক হরমোনের মাত্রা কমতে থাকে। তাই এই সময়েও ‘মুড সুইং’ হতে পারে। ‘মুডসুইং’ সম্পূর্ণই হরমোনের ওপর নির্ভর করে। হরমনের ওঠা নামার কারণেই মানুষের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হয়। এবং আচরণগত পরিবর্তন ঘটে।
‘প্রি-মিন্সট্রুয়াল সিন্ড্রম (পিএমএস)’ সাধারণত পিরিয়ড হওয়ার দুএক সপ্তাহ আগে থেকে দেখা দেয়। এই সময়ে অনেকের আবেগের পরিবর্তন, খাবারের চাহিদায় পরিবর্তন, দুর্বলভাব, বমি ভাব, মানসিক উদ্বেগ দেখা দিতে পারে। নারীদের মধ্যে এই সময়কালে একটা আলাদা রকম আবেগ-অনুভূতির সৃষ্টি হয়। যেটাকে মেডিক্যাল সাইন্সে মুডসুইং নামে অভিহিত করা হয়। তবে ডাক্তারেরা এটাকে হরমোনের পরিবর্তন বলেই উল্লেখ করেন। এবং নারীর এসকল গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মুড সুইং খুব একটা অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। পিরিয়ডের আগে এস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায় বলেই মানসিক অবস্থার এমন নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন।
‘মুড সুইং’ অধিকাংশ নারীর ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে। যা পিরিয়ড শেষ হওয়ার দুই-একদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু কিছু সংখ্যক নারী গুরুতর ভাবে এই সমস্যার মুখোমুখি হয়। অনেকের মধ্যেই মানসিক স্বস্তি স্থায়ীভাবে নষ্ট করে ‘মুডসুইং’। অনেকে এর ফলে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যায় পড়েন। মারাত্মক হতাশা, সব সময় মেজাজ খিটমিট করা, রাগারাগি করার মতো সমস্যায় ভুগে থাকেন। এগুলোর জন্যও নারীদের সচেতনতা বিশেষ জরুরি। নতুবা ‘মুডসুইং’ ঘটতে ঘটতে একসময় মানসিক বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
তবে নারীদের মানসিকভাবে যেহতু নানারকম চাপ সামলাতে হয় তাই নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া খুবই জরুরি। যান্ত্রিক জীবনে নিজের জন্য সময় বের করতে হবে। দিনের নির্দিষ্ট সময় ভালো অভ্যাসগুলোর চর্চা করতে হবে। যেন এ ধরনের সমস্যা এড়ানো যায়। এক্ষেত্রে নিজের মনকে প্রাধান্য দিতে হবে প্রথমত। যেটা করতে ভালো লাগে তার পেছনে সময় ব্যয় করতে হবে। সেই সময়টুকু একদম নিজের করে তুলতে হবে। পড়াশোনা হতে পারে, বাগান করা, ব্যায়াম করা, বাইরে হাঁটাহাটি, সাজুগুজু করা, কোনো অ্যাডভেঞ্চারাস মুভি, গান শোনা নানাধরনের কাজেই নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারেন নারীরা। তবে মেডিক্যাল সাইন্সে বা ডাক্তারেরা এর কিছু উপায় নারীদের জন্য বাতলে দিয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত ঘুম, ধ্যান, ব্যায়াম করা যেতে পারে। তবে মানসিক সমস্যায় রূপ নিলে অবশ্যই চিকিৎসকের স্মরাণাপন্ন হতে হবে।
মানসিক চাপ শরীর ও মনের ওপর প্রভাব ফেলে। তাই মানসিক চাপ কমাতে নারীকে সচেতন থাকতে হবে। এছাড়া পিরিয়ড চলাকালীন পুষ্টিকর খাবার এবং ব্যায়ামের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। মানসিক চাপ কমাতে বিশ্রাম খুব জরুরি। সেদিকে নারীদের লক্ষ রাখতে হবে। স্থায়ী কোনো সমস্যা তৈরি হওয়ার আগে সঠিক পরিচর্যা এবং নিজেকে কাজের মধ্যে সম্পৃক্ত করতে হবে।
বিষয়টাকে অস্বাভাবিকভাবে না দেখে বরং এই সময়ে পছন্দের কাজ করে, নিজের যত্ন নিয়ে, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন করে এ সমস্যা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। আর অবস্থা যদি খুব বেশি খারাপের দিকে যায় তাহলে অবশ্যই চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিয়ে সেই মোতাবেক জীবন পরিচালনা করতে হবে। ‘মুডসুইং’-এর নেতিবাচক প্রভাব আছে। তবে, এটা নারীদের জন্য অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। নিজের প্রতি যত্নশীল হলে ধীরে ধীরে নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে আনা সম্ভব। মুইসুইং অস্বাভাবিক নয়। যেকোনো ধরনের স্ট্রেচ, হতাশা, দীর্ঘ দিনের মানসিক চাপ থেকেই এর সৃষ্টি। তাই বিরক্ত নয় বরং আক্রান্ত ব্যক্তির পাশে থাকতে চেষ্টা করতে হবে। সাহায্য ও সহোযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।