Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অস্ত্রে দেবীর বহুরূপ

ঈশ্বরের মাতৃভাবে আরাধনা সহজ। ‘মা’ নামটি মধুর। মা শরণাগত সন্তানকে দশ হাতে সর্বদা সব রকমের বিপদ থেকে রক্ষা করেন। তিনিই অভয় দিচ্ছেন, সন্তানকে কল্যাণ কাজের শক্তি ও প্রেরণা দিচ্ছেন, এবং পরম লক্ষ্যে পরিচালিত করছেন। দুর্গা শব্দের অর্থ যিনি দুর্গতি বা সংকট থেকে রক্ষা করেন। অর্থাৎ সংকট বা দুর্গতি থেকে তিনি রক্ষা করবেন এবং করেন বলেই তিনি দুর্গা। সময়ের প্রয়োজনেই আগমন ঘটেছে তার। সেই দেবালয়ে আসুরিক প্রবৃত্তি বেড়ে যাওয়ার ফলে অসুরদের নিবৃত্ত করতেই মা দূর্গার আগমন। দশভুজা দূর্গার অস্ত্রে তাই রয়েছে বহুরূপ। 

দেবী দুর্গাকে নিয়ে বাঙালির বিস্ময় এবং আগ্রহের অভাব নেই। বিস্ময় এজন্য যে, তিনি দশভুজা বা দশ হাত বিশিষ্টা নারী এবং দেবীর দশ হাতে দশ রকম অস্ত্র। সচরাচর হিন্দু দেবদেবীর মধ্যে এমন রূপ আর দেখা যায় না। দেখা যায় না বলেই এই স্বরূপ নিয়ে সবার আগ্রহ থাকে তুঙ্গে। চণ্ডিতে দেবী দুর্গাকে দশ প্রহরণধারিণী নামে অভিহিত করা হয়। মহালয়ার পুণ্য তিথিতে আহ্বান জানানো হয়, জাগো দুর্গা, জাগো দশ প্রহরণধারিণী। প্রহরণ শব্দের অর্থ হাতিয়ার, প্রহার বা অস্ত্র। দশ হাতে অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে যিনি অসুর বা অপশক্তি নাশ করেন তিনিই দশ প্রহরণধারিণী।

দেবীর হাতে তাহলে এত অস্ত্রই বা কেন? যতদূর জানা যায় মহিষাসুরকে বধের জন্য দেবতারা ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বরের শরণাপন্ন হলে মিলিত ত্রিশক্তি থেকে দেবী দুর্গার আবির্ভাব। প্রত্যেক দেবতার তেজে দেবীর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গড়ে ওঠে এবং দেবীর দশটি হাত আবির্ভূত হয়।জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী, পৃথিবীর দশটি দিকের প্রতিভূ এই দশ হাত। পুরাণে বলা আছে, কুবের, যম, ইন্দ্র, বরুণ, ঈশান, বায়ু, অগ্নি, নৈঋত, ব্রহ্মা ও বিষ্ণু এই দশ দিক থেকে মহিষাসুরকে বধ করার উদ্দেশ্যে দেবী দুর্গার দশটি হাত সৃষ্টি। দেবীর আবির্ভাবের পর দেবীকে সুসজ্জিত করার জন্য দেবতারা অস্ত্র প্রদান করেন। দেবতারা শুধু যে দেবীকে অস্ত্র দেন তা নয়, দেবীর শরীরের বস্ত্র, অলংকারও দেবতারা দিয়েছিলেন। দেবীর এই অস্ত্র সম্পর্কেও বিশদ ধারণা রয়েছে। সেগুলো সংক্ষেপে সাজিয়ে বর্ণনা করা হলো—

শঙ্খ: শঙ্খ জাগরণের প্রতীক এবং এটিকে ঠিক অস্ত্র বলাও যায় না। এই শঙ্খ বাজিয়েই দেবী মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পুরাণ মতে, শঙ্খ থেকে উৎপন্ন ধ্বনি থেকেই সমগ্রপ্রাণের সৃষ্টি। শঙ্খ বা শাঁখ দেবী দুর্গার বাম হাতে থাকে। বরুণদেব এই অস্ত্র দেবীকে প্রদান করেন। 

চক্র: সুদর্শন চক্র দেবীর ডান হাতে থাকে। ‘সু’ অর্থাৎ সুন্দর আর ‘দর্শন’ অর্থাৎ দৃশ্যমান। বিশ্বকর্মা সুদর্শন চক্র নির্মাণ করেছিলেন শ্রী বিষ্ণুর জন্য। জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং অশুভ শক্তির বিনাশের জন্য এই সুদর্শন চক্রের সৃষ্টি। দেবতাদের অসুর বিনাশের আকুতি দেখে স্বয়ং শ্রী বিষ্ণু চক্রটি দেবী দুর্গাকে প্রদান করেন।

গদা বা কালদণ্ড: গদা বা কালদণ্ড হলো মহা প্রীতি ও আনুগত্যের প্রতীক। দেবী দুর্গার বাম হাতে গদা বা কালদণ্ড থাকে। ধর্মরাজ যম গদা বা কালদণ্ড মহিষাসুর নিধন যজ্ঞে দেবী মহামায়াকে এই অস্ত্র প্রদান করেন। এই অস্ত্র মহাদেবীর হাতে সম্মোহনকারী শক্তি হিসেবে দেখা হয় এবং এটির ব্যবহারেই তিনি মহিষাসুরকে সম্মোহিত করেছিলেন। 

পদ্ম, অক্ষমালা ও কমণ্ডলু: দেবী দুর্গাকে শঙ্খ, চক্র, গদা পদ্ম ধারীও বলা হয়। পদ্ম আলোর প্রতীক। দেবী দুর্গাকে পদ্ম, অক্ষমালা, কমণ্ডলু প্রদান করেন প্রজাপতি ব্রহ্মা। পদ্ম ফুলের জন্ম পুকুরে অথবা জলাধারের গভীরে হলেও অন্ধকার থেকে আলোর পথে উত্তরণের প্রতীক হলো পদ্ম। হিন্দুশাস্ত্রের প্রায় সব দেবদেবীদের অধিষ্ঠান প্রস্ফুটিত পদ্মের উপর। পদ্মকে সর্ব শক্তির আধার ধরা হয়। এছাড়া দেবী দুর্গার দক্ষিণ হাতে থাকে অক্ষমালা ও কমণ্ডলু। অক্ষমালা ও কমণ্ডলু পবিত্রতার প্রতীক।

খড়গ: ষড়রিপু দমনের প্রতীক এই খড়গ বলি প্রদানের অস্ত্র। বলি বলতে শাস্ত্র অনুসারে বিবেক-বুদ্ধির মধ্যে নিহিত অশুভের নিধন যজ্ঞ বোঝায়। দেবীর ডান হাতে খড়গ উদ্যত হয়ে থাকে। শ্রী শ্রী চণ্ডীতে দেবী চামুণ্ডার কথা আছে, যিনি অসুর নিধন কালে তাঁর হাতে খড়গ দ্বারা অশুভ শক্তি নাশ করেন। দেবীর হাতে সজ্জিত খড়গ হলো, পরম মোক্ষেরও প্রতীক। ভক্তদের সামনে উদ্যত খড়গ অভয়ের প্রতীক। 

ধনুর্বাণ বা তীর-ধনুক: দেবী দুর্গার বাম হাতে ধনুর্বাণ বা তীর-ধনুক থাকে। পবনদেব এই অস্ত্র প্রদান করেন। যুদ্ধে জয় পেতে বা লক্ষ্য স্থির রাখতে তীর-ধনুক কাল্পনিক লক্ষ্যভেদের অস্ত্র হিসেবে দেবীর হাতে সজ্জিত থাকে।

ঘণ্টা: দেবীর বাম হাতে থাকে ঘণ্টা। দেবরাজ ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত ঘণ্টা অস্ত্রটি দেবীকে প্রদান করেন। ঘণ্টার ধ্বনিতে যুদ্ধের সূচনা হয়। শাঁখ-ঘণ্টার মিলিত নিনাদে অশুভ শক্তির বিনাশের কাল ঘোষিত হয়ে থাকে। ঘণ্টা আসুরিক শক্তিকে দুর্বল করে। শ্রী শ্রী চণ্ডীতে বর্ণিত আছে দেবী মহিষাসুরকে যুদ্ধে আহ্বান করার সময় সতর্কবার্তা স্বরূপ দেবী অট্টহাসি হাসেন এবং শাঁখ ও ঘণ্টার ধ্বনিতে তাদের যুদ্ধের প্রস্তুতির নির্দেশ দেন।

বজ্র: বজ্র দৃঢ়তা এবং সংহতির প্রতীক। দেবীর বাম হাতে থাকে বজ্র। দেবরাজ ইন্দ্র দেবী দুর্গাকে বজ্র প্রদান করেন। আমাদের যাপিত বা ব্যবহারিক জীবনে ও চরিত্রে কঠোরতা প্রয়োজন। সংহতি পূর্ণ সমাজ জীবন সব মানুষের কাম্য। তাই দেবীর হাতে বজ্র শোভা পাচ্ছে।

সর্প বা নাগপাশ: সর্প বা নাগপাশ বিশুদ্ধ চেতনার প্রতীক। নাগরাজ দেন সর্প বা নাগপাশ। দেবী দুর্গার বাম হাতে নিচের দিকে সর্প বা নাগপাশ থাকে। আসুরিক প্রবৃত্তি লাঘব এবং মনে বিশুদ্ধ চেতনার বিকাশে দেবী দুর্গার হাতে সর্প বা নাগপাশ শোভা পায়।
ত্রিশূল: দেবী দুর্গার হাতে ত্রিশূল অস্ত্রটি প্রধান অস্ত্র হিসেবে দেখা যায়। দেবাদিদেব মহাদেবের হাতে ত্রিশূল থাকে। ত্রিকাল দণ্ড স্বরূপ এই অস্ত্র মহাদেব দেবী দুর্গাকে প্রদান করেন। ত্রিশূল যার স্পর্শে বা স্মরণ নিলে ত্রিগুণ থেকে মুক্তি লাভ হয়।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ