এগিয়ে যাওয়ার পথ দুর্গম, যাত্রীরা হুশিয়ার!
প্রায় ২০ বছর আগের কথা। ঢাকায় মেয়েদের কুস্তি প্রতিযোগিতা হবে হটাতই এমন একটা খবর কানে এল। বাংলাদেশে মেয়েদের খেলাধুলা তখনো দুই একটি ইনডোর গেমসে সীমাবদ্ধ।
আউটডোর স্পোর্টস বলতে অ্যাথলেটিক্সেই তাদের অংশগ্রহণ ছিল কিছুটা বলার মতো। কিন্তু সেখানেও যৌন হয়রানির এক ঘটনা, যা কিনা সংসদীয় তদন্তের মতো বড় বিষয়ে রূপ নেয়, মেয়েদের খেলাধুলাকে গত শতাব্দীর শেষ দিকে একরকম থমকেই দেয়।
এরকম একটা সময়ে মেয়েদের কুস্তির আয়োজন ছিল দুঃসাহসী এক উদ্যোগ। যদিও কুস্তি একরকম ইনডোর গেমই। চার দেয়ালের মাঝেই মূলত এর আয়োজন এবং সেখানেও দর্শক, বিচারক কারা থাকবেন চাইলে সেটা নির্দিষ্ট করে দেওয়া সম্ভব। এরকম একটা খেলায় সাধারণ বিচারে তেমন বাধা আসার কথা নয়। কিন্তু বডি কন্টাক্ট গেম বলেই একটা ভয় ছিল এবং ভয়টা অচিরেই সত্যিও হয়ে গেল।
সেই সময়ে প্রভাবশালী ধর্মীয় রাজনৈতিক দল ইসলামী ঐক্যজোট ঘোষণা করে বসল তারা এটা প্রতিহত করবে। খবরটা পেয়েই ছুটে যাই মাসিক মদিনা অফিসে। এর সম্পাদক মাওলানা মহিউদ্দিন তখন ইসলামী ঐক্যজোটের বড় নেতা। উনার কাছে জানতে চাইলাম কেন তারা এধরণের প্রতিযোগিতার বিরোধী। নিউ এইজের প্রথম পাতায় এটাই ছিল সম্ভবত আমার প্রথম প্রতিবেদন।
স্বভাবতই এই খবরের প্রতিক্রিয়া হয়েছে মারাত্মক। পক্ষে, বিপক্ষে নানা প্রতিক্রিয়াই আসতে থাকলো। প্রতিযোগিতার দিন ধানমন্ডি মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে গিয়ে আধা কিলোমিটার জুড়ে কেবল পুলিশই দেখেছি। প্রতিযোগিতাটা সেবার আর হয়নি। তাতে আমার মতো অনেকেরই মন খারাপ হয়েছে। আবার কিছুটা আশার সঞ্চার হয়েছে মনে। খেলার আয়োজনটা সাময়িক ভাবে ভেস্তে গেলেও এটা নিয়ে যে বিতর্কের সূচনা হয়েছে তাতে ইতিবাচক মতামতই এসেছে বেশি।
অন্ধকার যে দ্রুতই কেটে যাবে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। পরের বছরই এই প্রতিযোগিতা চালু হয়েছে বাংলাদেশে। আর এখনতো এটা রীতিমতো স্বাভাবিক এক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এতোটাই স্বাভাবিক যে এখন মহিলা কুস্তি থেকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের পদক জেতার সম্ভাবনা জেগেছে। যেনতেন কোনো প্রতিযোগিতা নয়, ২০১৮ সালের গোল্ড কোস্ট কমনওয়েলথ গেমসে পদক জয়ের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের মহিলা কুস্তিবিদ শিরিন সুলতানা।
প্রতিরোধকারীর চেয়ে প্রতিবাদকারীর সংখ্যা বেশি ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। কুস্তির পর কাছাকাছি সময়ে বাধা এসেছে সাঁতারেও। সাঁতার প্রতিযোগিতায় মেয়েদের কস্টিউম কারো কারো পছন্দ হয়নি। কিন্তু ধোপে টেকেনি সেই বাধাও।
কুস্তি আর সাঁতারে বাধা দেওয়ার এই ঘটনা গুলো ঘটে ২০০৩-০৪ সালে। এই ঘটনার পরের কয়েকটা বছর বলা চলে মেয়েদের খেলাধুলায় বাংলাদেশে নতুন নতুন সূর্যোদয় হয়েছে। মেয়েদের ফুটবল, ক্রিকেট পুরোদমে চালু হয়েছে বাংলাদেশে। সাফল্যও এসেছে অনেক। ছেলেরা এখনো না পারলেও বাংলাদেশের মেয়েরা এশিয়া কাপ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, মেয়েদের ফুটবল দল দক্ষিণ এশিয়ায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ক’মাস আগেই। অন্য কিছু খেলায়ও তারা অল্প বিস্তর সাফল্য পেয়েছে। সর্বশেষ কাঠমান্ডু সাফ গেমসে ফেন্সিংয়ের মতো অপ্রচলিত খেলায় বাংলাদেশের মেয়েরা স্বর্ণ জিতেছে।
এখনতো মেয়েদের বডি বিল্ডিং প্রতিযোগিতাও চালু হয়েছে। বছর দুয়েক আগে ঢাকার একটি জিমন্যসিয়ামে গিয়েছিলাম বাংলাদেশের প্রথম নারী বডি বিল্ডিং চ্যাম্পিয়ন অহনা রহমানের সঙ্গে কথা বলতে। পুরনো ঢাকায় ঢাকেশ্বরি মন্দিরের পাশে এই জিমন্যসিয়ামে অহনা ছাড়া আরোও অনেক মেয়েই প্রশিক্ষণ নেয়। কথা হয়েছে তাদের অনেকেরই সাথে।মিষ্টি নামের একজনের দেখা পাই যার থাইরয়েডের সমস্যা আছে। ওজন কমাতে ডাক্তার তাকে নিয়মিত ব্যায়াম করার পরামর্শ দিয়েছিল। সেই থেকে ব্যায়ামাগার তিনি নিয়মিত ভিজিটর। ৭৪ থেকে ওজন ৫৭ কেজিতে নামিয়ে এনে মিষ্টি দেখতে আরো মিষ্টি হয়েছেন। বডি বিল্ডিংটা অচিরেই তার কাছে খেলায় রূপ নিয়ে প্রতিদিনের আনন্দের উপলক্ষ্য হয়ে আছে।
বছর খানেক আগে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে কি রিপোর্ট করা যায় এটা নিয়ে যখন ভাবছিলাম হটাত একটা বিষয় বিদ্যুচ্চমকের মতো খেলে যায়। বেশ কয়েক বছর ধরেই লক্ষ্য করছি, কম্ব্যাট স্পোর্টসে, মানে মারামারির খেলায় মেয়েদের অংশগ্রহণ ইদানীং বেশ বেড়ে গেছে। এর পেছনে অনুঘটক হিসেবে যেটা কাজ করেছে, সেটা সম্ভবত আত্মরক্ষার তাগিদ।
আমাদের সমাজ যে মেয়েদের জন্য এখনো পুরোপুরি নিরাপদ নয় এটা আমরা প্রায় সবাই জানি। সমাজকে তাদের জন্য নিরাপদ করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগের সংখ্যাও খুবই সীমিত। অনেক পরিবারকে তাই দেখেছি, তায়কন্দো, জুডো, কারাতে এসব প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে স্বউদ্যোগে মেয়েদের পাঠাতে। যারা ধর্মীয় কারণে মেয়েদের খেলাধুলার বিরোধিতা করেন, তারা এর ইতিবাচক দিকটা কখনোই মাথায় নেননি।
খেলাধুলায় মেয়েদের অংশগ্রহণ এবং সাফল্য প্রায় সব দেশেই নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম প্রতীক মনে করা হয়। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রথম দিকে যখন মেয়েদের ফুটবল চালু করা হয় খেলোয়াড়দের অধিকাংশই আসে পাহাড়ি অঞ্চল থেকে। সেখানে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে এটা নিয়ে তেমন কোনো সংস্কার নেই। মেয়েদের তাই কেউ বাধা দেয়নি। বরং এটিকেও জীবিকার উপলক্ষ্য ভেবে তারা এগিয়ে যেতে চেয়েছে।
সাম্প্রতিক বছর গুলোতে সমতলের মেয়েদেরও ফুটবলে আগ্রহ বেড়েছে। ময়মনসিংহের কলসুন্দর তো এখন মেয়েদের ফুটবলের কারণেই দেশ বিখ্যাত। উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু জেলাতেও মেয়েদের ফুটবলের ভালোই চর্চা হচ্ছে। তবে সব মেয়েই যে খুব নির্বিঘ্নে খেলাধুলার চর্চা করতে পারছে তেমন নয়।
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে ধর্মীয় উগ্রবাদি গোষ্ঠী কয়েক বছর আগেও মেয়েদের ফুটবল টুর্ণামেন্টের বিপক্ষে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। গত বছর মেয়েদের সাফ জেতার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক মাদ্রাসা শিক্ষককে দেখা গেছে কড়া সমালোচনা করে ফেসবুক মন্তব্য করতে। আর সম্প্রতি খুলনায়তো মেয়েদের উপর শারীরিক আক্রমণই হয়েছে।
একটা বিষয় লক্ষণীয়, এসব বাধা বিপত্তিকে সাধারণ মানুষ খুব একটা পাত্তা দেননি। খুলনার সাম্প্রতিক ঘটনায় প্রশাসন ও ব্যবস্থা নিয়েছে দ্রুতই। সবচাইতে ভালো ভূমিকা পালন করেছে স্থানীয় সংবাদকর্মীরা। হামলার এই ঘটনা জাতীয় পর্যায়ে রিপোর্ট না হলে প্রশাসনের টনক নড়তো না কি-না সেটা সন্দেহ করার যথেষ্ট কারন আছে। সরকার প্রধান এক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তাতে আক্রান্ত এই মেয়েদের ভয় কিছুটা হলেও কেটেছে। অপরাধীদেরও কেউ কেউ হয়তো শাস্তির আওতায় আসবে এই বিশ্বাসও তৈরি হয়েছে।
সাফ জেতার পর সামাজিক বাধা-বিপত্তির নানা গল্পই আমরা মেয়েদের কাছে শুনেছি। এই সাফল্যকে মনে করা হয়েছিলো মেয়েদের ফুটবলে যুগ পরিবর্তনের সূচনা। ঠিক যেমনটা দেখা গিয়েছিলো আইসিসি ট্রফি জয়ের পর ছেলেদের ক্রিকেটে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নানা হটকারিতায় পরিবর্তন অনেকটাই ভেস্তে যেতে বসেছে। খুলনার এই আক্রমণও একটা বড় বাধা হিসেবে এসেছে। সমাজের প্রগতিশীল অংশ এই ঘটনায় দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। মিডিয়াও তার কাজ করেছে। তবে এখনো অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে।
খুলনায় যে সময়ে বাংলাদেশের মেয়েদের উপর আক্রমণ হয়েছে, অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে চলছে নারীদের বিশ্বকাপ ফুটবল। কয়েক বছর আগে থাইল্যান্ডের চুনবুরিতে এই বিশ্বকাপের যৌথ আয়োজক ও কোয়ার্টার ফাইনালিস্ট অস্ট্রেলিয়াকে বাংলাদেশের মেয়েরা প্রায় হারিয়েই দিয়েছিল। সেদিনের সেই ম্যাচের পর অস্ট্রেলিয়া এগিয়েছে দ্রুত। এগিয়েছে বাংলাদেশও। কিন্তু খুলনার এই ঘটনা প্রমাণ করেছে এগিয়ে যাওয়ার এই পথ বড়ই দূর্গম। কবির ভাষায়, দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু। এখানে আলো আসবে। আবার রাতও নামবে। দুস্তর এই পারাবার লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে। অতএব যাত্রীরা হুশিয়ার!
(ডয়চে ভেলে বাংলার পক্ষ থেকে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন আজাদ মজুমদার)
অনন্যা/এআই