Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঢামেক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা: ঠেকাও এই আত্মবিধ্বংসী কাজ


বর্তমানে মানুষকে এক ধরনের অদৃশ্য ছায়া গভীরভাবে গ্রাস করেছে। পরস্পর সাহায্য-সহযোগিতা ও ভাবের আদান-প্রদানের লক্ষে মানবজাতি সমাজবদ্ধ ও সংঘবদ্ধভাবে বাস করতে শুরু করলেও আধুনিক যুগের যান্ত্রিক ছোঁয়ায় মানুষ বিচ্ছিন্ন। একই ছাদের নিচে বাস করেও পরস্পর থেকে এতটাই বিচ্ছিন্ন যে, অন্যের হৃদয়ের গহীনে লুকিয়ে থাকা বেদনা আরেকজনকে স্পর্শ করতে পারে না। আত্মকেন্দ্রিক মানুষ নিজের ভেতর গুমরে গুমরে মরতে থাকে। সমাজের বিধিনিষেধ, অবরুদ্ধ জীবনযাপনের ফলে নিজেকে সর্বত্র মেলে ধরাও সম্ভব হয় না সবার জন্য। আর নারীদের ক্ষেত্রে এমন বাধা অসংখ্য! ফলে মানুষের মাঝে বিরাজমান কালো ছায়া কখন যে ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলছে তা সত্যি বুঝে ওঠা দায়। যার ভুক্তভোগী এ সমাজ। তাইতো প্রতিনিয়তই বাড়ছে আত্মহত্যা প্রবণতা!

সাধারণের দৃষ্টিতে যাকে খুব সুখী মনে হয় একটা সময় গিয়ে দেখা যায়, তার হৃদয়ের গভীরেও ক্ষত! প্রতিটি মানুষের ভেতরে দুঃখ-গ্লানি-যন্ত্রণা আছে। পৃথিবীতে এমন একটি মানুষও পাওয়া যাবে না যার কষ্ট-দুঃখ-খারাপ লাগা নেই। তবু তো মানুষ বাঁচে। কারণ জীবন একটিই। আর এই মহামূল্যবান জীবন হেলাফেলায় হারানোর নয়। তবু মানুষ জীবনকে তুচ্ছ করে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতেও দ্বিধা করছেন না। তবে সত্যি বলতে জীবনের মায়া কার বা নেই! কিন্তু কী এত গভীরও বেদনা-যন্ত্রণা-ক্ষত যার ভার আর সওয়া দায় হয়ে পড়ছে! এই বিষাদ কেন? কেন মানুষ হয়ে একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়াতে পারছি না আমরা!

বর্তমানে যে ধরনের আত্মহত্যার খবর মিলছে তাতে দেখা যাচ্ছে, সবথেকেও কারো কারো কিছুই নেই! এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের “আট বছর আগের একদিন” কবিতা:

শোনা গেল লাশ কাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে
কাল রাতে—ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হ’লো তার সাধ;
বধূ শুয়েছিলো পাশে—শিশুটিও ছিলো
প্রেম ছিলো, আশা ছিলো—জ্যোৎস্নায়– তবু সে দেখিল?
কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল
লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার
এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি!”

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের (ঢামেক) হোস্টেলে জয়া কুন্ড (২৪) নামে এক মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার পরিবার ও রুমমেটদের কাছ থেকে জানা যায়, বহুদিন ধরে সে ডিপ্রেশনে ভুগছিল। এমনকি কয়েক মাস যাবৎ ডাক্তারের চিকিৎসাও গ্রহণ করছিলেন! কিন্তু তার এই অনাকাঙ্ক্ষিত অকাল প্রয়াণে মনটা ভারী হয়ে ওঠে! সবাই কেমন জানি গভীর ছায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে দিন দিন। কী যে হারিয়ে গেছে হৃদয়ের থেকে!

মানুষ যত আধুনিক হচ্ছে ঠিক ততটাই নিঃসঙ্গতা বাড়ছে! পাশে থেকেও কেউ কারো নয়। জীবন যেন এখন মরীচিকা। এই যে নেইটাই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আনন্দ! পুলক। খুশি। যে নামেই বলি না কেন জীবনে বেঁচে থাকার রসদ জোগায় এটা। যার জীবনে কিছুই নেই তবু দিনশেষে মন খুলে হাসতে পারে সে অন্তত দুঃখের বোঝাটা হালকা করতে পারে! কিন্তু এমন মানুষও কম নেই যারা নিজের ভেতরের কষ্টকে চেপে রেখে বাইরের সৌন্দর্য, মানুষের দুঃখ-কষ্টকে মূল্যায়ন করতে পারে! জীবনে যখন আনন্দ-স্ফূর্তি শেষ হয়ে যায় তখন গভীর বেদনা ছেয়ে ফেলে হৃদয়। কিন্তু তার আগে কেন নিজের জীবনকেই সবচেয়ে দুঃখী ভাবতে হচ্ছে! এগুলো নিয়ে ভাবেই না দুঃখকামী মানুষ!

জীবনের কোণে ঘনায়মান কালো মেঘ থেকেই এমন বজ্রপাত! কিন্তু এই মেঘ তো একদিনের নয়! কিন্তু মেঘ সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় কেনো কেউ রত হলেন না! পাশের মানুষের কাছে কী মানসিক অসুস্থতা কোনো অসুস্থতার মধ্যেই পড়ে না? আমাদের সমাজ আজও সত্যি বর্বর। মানুষের ব্যক্তিক দুঃখ-কষ্ট পেলে তাকে আরও খুঁচিয়ে রক্ত বের করে। দুর্বলতা, খারাপ লাগা থাকতেই পারে। সবারই আছে। কিন্তু অধিকাংশ বেকুব এগুলো নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে বলে বেড়ায়। ব্যক্তিকে হেয় প্রতিপন্ন করে। এবং অন্যজন কষ্ট পেলে বিকৃত লালসা পূর্ণ করে!

ঢামেক শিক্ষার্থীর দিকে যদি তাকানো যায়, বাংলাদেশের এমন কোন ব্যক্তি নেই যিনি প্রথম দর্শনেই বলবেন, তার আবার কিসের দুঃখ! এত ভালো ডিগ্রী নিয়ে শুধু টাকা কামাবেন। এখানে আত্মহত্যা কেন! কিন্তু একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন, যার যায় কেবল তারই হারায়। এই মেয়েটি জীবনের কোণে হয়তো এমন কিছু লুকিয়ে রেখেছে যার ভার বহন তার জন্য কষ্টের হয়ে গেছে! বা ওই জীবনানন্দের কবিতার মতো, সবই আছে কিন্তু কিছুই নেই। সেই কিছু নেই থেকেই এই বিষাদের জন্ম।

এর থেকে পরিত্রাণ পেতে সবার পারস্পরিক সহোযোগিতা প্রয়োজন। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন জরুরি। ব্যক্তির সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। মানুষ হয়ে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কারো দুর্বলতা নিয়ে খোঁচা না দেওয়া। এই ধরনের হীন প্রবৃত্তি দূর করতে হবে। নতুবা চারপাশের চাপ, কটুকথা থেকে গ্লানি, হতাশা সৃষ্টি হওয়া দূর করা সম্ভব নয়।

আমরা তো নামে অনেক আধুনিক হয়েছি। কিন্তু চিন্তার দীনতা ঘোচাতে পেরেছি কতটুকু? সমাজ, পরিবার- পরিজন সবদিক বিবেচনা করে যদি বলতে হয়, তবে বলবো এ সমাজ আরও রসাতলে গেছে! কুরুচিপূর্ণ মনোবৃত্তি বেড়েছে! নারীকে ঘরে আবদ্ধ রাখার প্রবৃত্তিও বাড়ছে। এসবের পরিত্রাণ করতে হবে। আর ভালো বই, সিনেমা, কার্টুন, ভ্রমণ, প্রকৃতির সান্নিধ্য গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, মানুষের চেয়ে এগুলো জীবনে বেশি প্রভাব ফেলবে। যারা মানসিক অবসাদে ভুগছেন তাদের জন্য আরও চমকপ্রদ কাজ হবে যতদিন জীবনবোধ পরিবর্তন না হশ ততদিন নিজের শহরে ফুটপাত ধরে দীর্ঘ সময় হাঁটা। রাস্তার ধারের পথশিশু, ভিখারী, পঙ্গু, ল্যাংড়া, প্রতিবন্ধী, মানসিক ভারসাম্যহীন, বস্তিবাসী মানুষদের পর্যবেক্ষণ করা। যদি কেউ সত্যি বিবেক দিয়ে, বোধ দিয়ে জীবনের ধারাপাতে একটু পরিবর্তন করতে পারেন তবে বুঝবেন নিজের প্রকৃত অবস্থান কী। জগতের মাঝে অপার দুঃখ। তাই নিজের দুঃখকে বাড়তে না দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।

“মানুষ তার চিবুকের কাছেও একা” কবি আবুল হাসান বলেছিলেন। ঠিক তাই মানুষ নিজেও বোঝে না তার চাওয়া কী! তাই যখন গভীর বিষাদ ভর করবে হৃদয়ে, আর এক মুহূর্তে বাঁচতে ইচ্ছে হবে না ঠিক সেই সময় একটু বিরতি নিন। খুব বেশি নয়। ২০-৩০ সেকেন্ড। জীবনের পুরোটা পর্যবেক্ষণ করুন শেষ বারের মতো। সত্যি কি নিজের জীবনে বাঁচার জন্য একটি ভেসে যাওয়া পালকও নেই! যদি নাও থাকে আপনার কী দুই হাত নেই? না থাক একটি আছে নিশ্চয়ই? তা না থাকলেও তো কত মানুষ দিব্যি বেঁচে আছে! তাহলে আপনার কিসের দ্বন্দ্ব? প্রেমিকা গেছে? প্রেমিক গেছে? স্বামী বা স্ত্রী গেছে? তাতে কী হয়েছে ভেবে দেখুন। পৃথিবীর নিয়ম বড় অদ্ভুত। এ জীবন আপনার। তাই অন্যের জন্য বিষাদে ডোবা বোকামি। পাঁচ দিনের বিরহ, এক বছরের বিরহ আসবে স্বাভাবিক। কিন্তু তারপর আপনি ইস্পাতের মতো ধারালো হবেন নিঃসন্দেহে। তাই দয়াকরে নিজের জীবনকে ভালোবাসতে শিখুন। প্রত্যেকের মধ্যে যে অপার সম্ভাবনা আছে সেই দুয়ার খুলুন। আর দেখুন জীবনের বাজিমাত কাকে বলে।

আস্থা রাখুন নিজের কর্মের ওপর। পৃথিবীতে আপনি আসার পিছনে গভীর রহস্য। এমনিতেই আপনার সৃষ্টি হয়নি। তাই কোনো মানুষ, নিজের কোনো ব্যর্থতা, দারিদ্র্য, ব্লাকমেইলিং, ধর্ষণ কিচ্ছুর জন্যই মরার মতো এত বোকামি কিচ্ছু করবেন না। আপনি আমি মানুষ। বাঁচুন প্রাণ খুলে। হাসিল করুন আপনার সাফল্য। মরার আগে নিজের অবস্থান ছাড়া বোকামি। জয় হোক শুভবুদ্ধির।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ