মাকে হত্যা: সন্তানের অধঃপতন, সমাজের অবক্ষয়
বর্তমান সময়ে অহরহ সন্তানেরা পিতা-মাতার ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। এমনও দেখা গেছে বাবার মৃত্যুর পর মাকে বাড়তি বোঝা ভেবে সন্তান তাকে রাস্তায় ফেলে গেছে। কিছুদিন আগে গণমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, ঢাকা থেকে এক মাকে একটি পানির বোতল দিয়ে তার ছেলে তাকে ট্রেনে উঠিয়ে দেয়। অশীতিপর বৃদ্ধা মা ঢাকা থেকে যাত্রা করেছেন এছাড়া আর কিছুই বলতে পারেননি। পরবর্তীকালে স্থানীয় জনগণের সহয়তায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গণমাধ্যম বরাত এমন একটি ঘটনার সাক্ষী হয়েছে পুরো দেশবাসী।
শুধু তাই নয় আজ আবার গণমাধ্যমে আরও একটি খবর সামনে আসলো। বাবা-মা দুজন অতি বৃদ্ধকে ছেলে জমিজামা সব লিখে নিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। সেই বাবা-মায়ের স্থান হয়েছে স্থানীয় মসজিদে। পরবর্তীকালে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গ্রামের গণ্যমান্যদের সহোযোগিতায় তাকে সন্তানের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে এই অসহায়-অবহেলিত-বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কপালে কী লাঞ্ছনা জুটবে তা সত্যি বলা মুশকিল!
এর আগে কোরোনাকালেও এমন ঘটনা অসংখ্য দেখা গেছে। বৃদ্ধ মা-বাবাকে রাস্তায় ফেলে গেছে! ঠিক এই ঘটনার মতোই আরও ভয়াবহ একটি ঘটনা সামনে এসেছে। ময়মনসিংহের ভালুকায় ছেলের দায়ের কোপে রুপিনা বেগম (৫৫) নামের এক মা খুন হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বুধবার (২৬ জুলাই) রাত ৮টার দিকে উপজেলার ভালুকা ইউনিয়নের খারুয়ালী গ্রামে এ হত্যার ঘটনা ঘটে। রুপিনা বেগম একই গ্রামের মৃত শাহাব উদ্দিনের স্ত্রী।
এ সমাজে বাবা-মা নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার খুব কম নয়। বরং বলা চলে, অধিকাংশ ঘরেই বৃদ্ধ বাবা-মাকে সম্মান করা হয় না। যেই বাবা-মা একসময় নিজে না খেয়ে সন্তানকে ভালো স্কুলে পড়ান, প্রতিষ্ঠা করার জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনান্ত পরিশ্রম করেন সেই বাবা-মাকে বয়স হলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে সন্তান। খুব বাজেভাবে তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়। এমনকি অনেক সন্তান বসতভিটা থেকে বাবা-মাকে উচ্ছেদ করে! কোন অবক্ষয়ের ষুগে এ সমাজ! যে সমাজ গড়ে উঠেছে পারস্পরিক সহোযোগিতার লক্ষে সেই সমাজে আজ এমন অধঃপতনের মুখে যা দেখলে নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাবতেও ঘৃণা হয়!
ভালুকায় সন্তানের হাতে মা খুন। এই নৃশংস ঘটনায় অভিযুক্তকে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে কঠোর থেকে কঠোরতর শাস্তি দিতে হবে। কোন সন্তান যেন পিতা-পাতার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার আগে একশ বার ভাবে। এ সমাজে আজ মানবিকতা নেই। মনুষ্যত্ব নেই। বিবেক খুইয়ে আবেগ-অনুভূতি খুইয়ে মানুষ এক জড়সর্বস্ব কাঠে পরিণত হয়েছে৷ তাইতো এত হিংস্রতা মনে!
এলক্ষে প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজের কথা ভাবা উচিত। সন্তান জন্ম দিয়ে তার কাঁধে ভবিষ্যতের ভার দেওয়ার আগে নিজেদের জন্য যতটা পারা যায় অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। সময় বদলেছে। মানুষের মনুষ্যত্ব ধ্বংসের পথে! সেখানে নিজের দায়-দায়িত্ব যদি নিজেদের ওপর না থাকে তবে তা সত্যিই করুণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। অভিভাবকদের মনে রাখা উচিত, সন্তান কখনও জন্মেই কুসন্তানে পরিণত হয় না। তাকে পরিবার, পরিবেশই এমবটা করে তোলে। ফলে সন্তানের পুঁথিগত বিদ্যার আগে মানবিকতার শিক্ষা আগে দিতে হবে।
যাতে শুধু বাবা-মাকেই নয় প্রতিটি প্রাণীর প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে ওঠে। পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষা দান করতে হবে। যখন সন্তান বড় করে তোলা হয় তখন স্বার্থবাদী চিন্তাকেই বড় করা উচিত নয়। সমাজ-রাষ্ট্র-পিতা-মাতার প্রতি কী দায় থাকা উচিত তাও বোঝাতে হবে। মনে রাখতে হবে, এ যুগে সন্তানদের গড়ে তুলতে বাবা-মা শৈশব থেকে তাদের সন্তানদের যেভাবে টাকার মেশিনরূপে গড়ে তুলতে চান একসময় কিন্তু সেই সন্তানই পিতা-মাতাকে আঘাত করে। সর্বোপরি অভিভাবকরা সর্বস্ব খুইয়ে সন্তানকে মানুষ না করে নিজেদের বৃদ্ধকালীন পরিস্থিতির কথা যাতে অবশ্যই মাথায় রাখে। এলক্ষে বিভিন্ন ব্যাংক একাউন্ট করে সেখানে টাকা জমালে বৃদ্ধবয়সে যখন শারীরিক পরিশ্রম করার সুযোগ থাকবে না তখন তা স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার করতে পারেন। এবং সবকিছু বাদেও যদি কোনো বাবা-মায়ের কপাল সত্যি খারাপ হয় তবে তাকে আইনের আশ্রয় নিতে হবে।
যুগ যেহেতু প্রাকটিকাল তাই সবাইকে সেভাবেই প্রস্তুত থাকা জরুরি। এতে করে বৃদ্ধ বয়সে অবহেলিত হতে হবে না। পকেটে টাকা থাকলে দেখভালের জন্য মানুষ রেখেও জীবন চালিয়ে দেওয়া সম্ভব। হ্যাঁ এখন কথা হলো যাদেড নুন আনতে পান্তা ফুরায় তারাই বা কী করবেন! কথাটা সত্যি শতভাগ। কিন্তু সেই পান্তা থেকে কিঞ্চিৎ বাঁচানোর চেষ্টা করা প্রয়োজন।
দরিদ্র ঘরে দেখা যায়, সন্তানের সংখ্যা বেশি। তাদের না পারেন ভালো মতো মানুষ করতে না পারেন নিজেরা একটু স্বচ্ছন্দে বাঁচতে। তাই এদিকেও নজর দিতে হবে। কষ্ট হলেও গায়ে শক্তি থাকাকালীন পরিশ্রম করতে হবে। এর কোনোই ব্যত্যয় নেই। নারী- পুরুষ উভয়কেই ভবিষ্যৎ ভাবতে হবে। তাহলে হয়তো ভালুকায় এই মায়ের মতো সন্তানের হাতে খুন হতে হবে না।
এবার আসুন সমাজের অবক্ষয় দূর করার বিষয়ে। এলক্ষে পরিবার-স্কুল-কলেজ সমাজকে একযোগে কাজ করতে হবে। দিন দিন যেভাবে মানুষ যান্ত্রিক দানবে পরিণত হচ্ছে তা ঠেকানো হবে। এর নিবারণ করা ছাড়া সমাজে শৃঙ্খলা আসবে না। মানবিকবোধ-বিবেকই পারে এমন অধঃপতন, অবক্ষয় থেকে সমাজকে রক্ষা করতে। সবার শুভ বোধের উদয় হোক।