কন্যাসন্তানকে এত অবমূল্যায়ন কেন
একটি পরিবার গঠনের মূল ভিত্তিভূমিই হলো নারী। কিন্তু অতি আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি নারীর মূল্য কোথাও নেই। কেউ দেয় না। আজও আমাদের সমাজে যারা গর্ভবতী নারী তাদের প্রধান এবং একমাত্র চাহিদা থাকে ছেলে সন্তানের। যে মায়ের গর্ভে দুটি বা তিনটি মেয়ে জন্মেছে সে মা নিজে মেয়ে হলেও তার গর্ভে এতগুলো কন্যাসন্তান জন্ম নেওয়ার আফসোসে বাঁচেন না। এমনকি এই মায়েদের এমন করুণ অবস্থা তার যে দুটি বা তিনটি মেয়ে সেটা বলতেও তার গলা ধরে আসে! কন্যা সন্তান কি এতই বোঝা? একজন নারী হয়ে তবেই তিনি মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করেছেন কিন্তু সেই মা যখন তার গর্ভে কন্যাশিশু জন্মানোর কথা শোনেন, তখন আঁতকে ওঠেন! আজকের যুগে যেখানে বিশ্ব এগিয়ে চলেছে সেখানে কোন সমাজে আমরা বসবাস করছি সেটা নিয়েও ভাবতে হয়!
আমাদের পরিবারগুলো এমনভাবে গড়ে উঠেছে যেখানে মেয়ে সন্তানকে মানুষ ভাবা হয় না। বাবা-মায়ের কোল আলো করে যখন প্রথম সন্তান আসে তখন তারা খুব খুশি হন। হ্যাঁ প্রথমটা মেয়ে হলে তাদের কষ্ট হয় না। কারণ তাদের পরবর্তী ধাপে তারা ছেলে পাবেন এমন মনোবাঞ্ছা তো থাকেই সেইসঙ্গে বিশ্বাসও। অর্থাৎ আমাদের সমাজে এমন বাবা-মা খুব কম বরং নেই বললেই ভালো হয় যে, তারা প্রথম কন্যা সন্তানের পর আবার মেয়ে চান। বরং প্রথম সন্তান ছেলে হওয়ার পর যদি আবারও দ্বিতীয়টা ছেলে হয় তবু ততটা মন খারাপ করেন না যতটা মেয়ে হলে করেন। কারণ বৃদ্ধ বয়সে এই ছেলেই তো তাদের ঠাঁই হবেন! আর মৃত্যু হলে কে কবরে দুমুঠো মাটি দেবে? সেও ছলে! তবে মেয়ের কী বা দরকার! খুব হাস্যকর যুক্তি হলেও আমাদের সমাজ আজও এর বাইরে বের হতে পারেনি একদমই।
গ্রামঞ্চালে নারীদের মুখে উচ্চারিত কথা শুনলে মাটির সঙ্গে মিইয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। কোল আলো করে আসা সন্তান ছেলে হলো না মেয়ে তা নিয়ে যখন জোর আলোচনা চলে! ছেলে হলে বাবা-মায়ের এমন স্বস্তি মেলে যে পরিবার-পরিজন সব জায়গা থেকে তারা জোর অভিনন্দিত হন। কিন্তু মেয়ে হলে নাকটা আজও কুঁচকে যায়। তারপর প্রসঙ্গ বদলে হয় কালো হলো নাকি ফর্সা! আজও এমন সমাজে বাস করছি আমরা। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে, যখন মেয়ে হয়ে জন্মে যিনি মা হয়েছেন তিনিই মেয়েকে দেখে কুঁকড়ে ওঠেন! বৃদ্ধ বয়সে ছেলের কাঁধে বসে খাওয়ার স্বপ্ন দেখেন! কিন্তু কয়জন বাবা-মা আসলেই ছেলে সন্তানের থেকে সত্যি তাদের প্রাপ্যটা পান! সমাজের ভেতরে গজিয়ে ওঠা কুসংস্কার-নোংরা প্রথা ও বিশ্বাস মেয়ে সন্তানের অব্যমূল্যায়নের অন্যতম কারণ।
কিন্তু একবারও এ সমাজের অধিকাংশ মানুষ বিবেচনা করেন না, সৃষ্টির রহস্য বড় বিচিত্র। আমরা কেউই তা অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু কোলের সন্তান ছেলে না মেয়ে, কালো বা ফর্সা এ নিয়ে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ি। শ্বশুরবাড়ির লোকজন নবজাতকের সঙ্গে মাকেও চরমভাবে অপদস্ত করে। কোনো সময় প্রকাশ্যে আবার কোন সময় আগোচরে! এসবের জেরে মায়ের মন বিষিয়ে তিনিও মেয়ের প্রতি অবহেলা করেন। অত্যাচার-অবিচারের চক্র নারীর জীবন থেকে তাই সরতেই চায় না। সেই যে শৈশবে তাকে দেখে পাড়া-পড়শীর যাতনা শুরু হয় সেই যাতনা আজীবন তাকে ভোগ করতে হয় পদে-পদে।
আজ পুরুষের তুলনায় নারী কোনো অংশে কম নয়। তবু নারীর জীবনে এত প্রতিবন্ধকতা। সংসার-স্বামী-সন্তান সর্বোপরি পরিবারের হাজারো প্রতিবন্ধকতাকে পায়ে ঠেলে নারীরা অর্জন করছে বিশ্বের সুনাম। সেই নারীরা আজও কেনো মেয়ে বলে অবমূল্যায়িত। বাবা-মা কেনো আজও কন্যা সন্তানকে সাদরে গ্রহণ করছেন না? মনের দৈন্য কাটাতে না পারলে কোনোদিনই এর পরিবর্তন আসবে না! বৃদ্ধ বয়সে মাথাগোঁজার ঠাঁই সব! তারজন্য কি মেয়েরা কিছু করতে পারে না! যদি মেয়েরা না পারে সেও এই সমাজের নোংরা চিন্তাভাবনার জন্য! ফলে সামগ্রিকভাবে সব হীনতা মুছে ফেলতে হবে। এবং মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে হবে। নতুবা সমাজের ঘোর অমানিশা কাটবার নয়। এজন্য কন্যা সন্তানের প্রতি অবিচার ভুলে সুদিনের পথে হাঁটতে হবে। সেই চেষ্টা অন্যকে দিয়ে নয় বরং নিজের জীবন থেকে শুরু করতে হবে।