নারীর গৃহকর্মের মূল্য দাও
আজও আমাদের সমাজে কিছু ট্যাবু বিশেষভাবে প্রচলিত। যেমন ঘরের কাজ। মূলত ঘরের কাজ বলতেই মনে করা হয় নারীর কাজ। অর্থাৎ একটি পরিবারকে সম্পূর্ণভাবে লালান-পালন-সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখার দায় নারীর। এ সমাজের নিরানব্বইভাগ পুরুষই এমনটা মনে করে। একইসঙ্গে বিশ্বাসও করে। কিছু কিছু পুরুষ আছে, তাদের ধারণাই এমন যে, পরিবারের সব কাজ স্ত্রীর। স্বামীর জল ঢেলে দেওয়া থেকে শুরু করে শ্বশুর-শাশুড়ি-সন্তান দেখভালের সব দায় স্ত্রীর। কেউ কেউ নিজেদের অপারগতা ঢাকতে জিনগত পার্থক্য নানাবিধ অজুহাত দাঁড় করান! আর এই অমূলক ও অযৌক্তিক-বদ্ধ কুসংস্কার নারীদের জন্য সংসার জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে।
খেয়াল করুন, আপনি যখন সব দায়-দায়িত্ব একা সামলাবেন, তার পেছনে শ্রম দেবেন, সেটা একটানা কতদিন করতে পারবেন? একটা সময় ক্লান্তি আসবে। ইচ্ছে করবে মুক্তি পেতে। হতাশা-বেদনা ঘিরে ধরবে! এটাই স্বাভাবিক। কারণ আমরা মানুষ। তেমনই বাড়ির নারীটিরও সেই দশা। তিনিও একটা সময় কষ্টবোধ করেন। দুঃখ তারও হয়। তাই ঘরের কাজ-বাইরের কাজ যতটা সম্ভব ব্যালেন্স করা উচিত। একজনের ওপর সবটা দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া কখনোই সুফল বয়ে আনবে না। এমনকি এটা শোভনাীয়ও নয়।
প্রত্যেক মানুষই চায় ভালোবাসা-শ্রদ্ধা-সম্মান। দাম্পত্য সম্পর্ক সুখের করে তুলতে এর ব্যত্যয় ঘটে না। যখনই দাম্পত্য সম্পর্কে প্রভুত্ব চলে আসে, স্ত্রীকে দাসী জ্ঞান করা হয়, স্ত্রীর প্রতি সব দায় চলে যায় তখন সংসার নামক কঙ্কাল টিকে থাকে। সেখানে ভালোবাসা এবং সুস্থ সম্পর্ক থাকতে পারে না। আজকের দিনে এসেও নিরানব্বইভাগ পুরুষই বউকে মনে করেন রোবট। তার বিশ্রামের প্রয়োজন নেই। আদর-আহ্লাদ-আবদারের প্রয়োজন নেই। ফলে যতটা পারা যায় স্ত্রীকে নিংড়ে তার সবটা গ্রহণ করা চায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ।
সম্প্রতি বিবাহবিচ্ছেদ ঘটছ প্রচুর। নেপথ্যে যে কারণগুলো রয়েছে, সেখানে ভালোবাসা-শ্রদ্ধা-সম্মান-পারস্পরিক হৃদ্যতার যথেষ্ট অভাব; তা একবাক্য স্বীকার করায় যায়। বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষ মাত্রই বিশ্বাস করবেন যে, সম্পর্ক একদিনে যেমন গড়ে ওঠে না ঠিক একদিনে ভাঙেও না। মূলত ভাঙতে হলেও কয়েকদিন বা কয়েক বছরের পরিকল্পনা, গ্লানি, দুঃখ-কষ্ট বিদ্যমান। অর্থাৎ হঠাৎ করে কিছু ঘটে না। সম্পর্কের ক্ষেত্রে এত এত বিচ্ছেদ মূলত এগুলোর কারণেই ঘটছে। যে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের কাজকে শ্রদ্ধা করে, সম্মান করে, একে-অপরকে ভালোবাসেন, নিজেদের মধ্যে হৃদ্যতা আছে সেখানে বিচ্ছেদ কল্পনাও করা যায় না। তাহলে এর বিপরীত হলেই সেখানেই বিচ্ছেদ! তবে কেনো পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নিজেদের শুধরে নিচ্ছেন না! ঘরের কাজ কেবল স্ত্রীর ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজে আয়সে চলছেন!
পুরুষ যেমন নারীর রূপে মজে অধিকাংশ নারীই কিন্তু তা নয়। নারীরা পুরুষের যোগ্যতা এবং দক্ষতাকে ভালোবাসে। শ্রদ্ধা করে। আমাদের সমাজ পর্যবেক্ষণ করলে বিষয়টির সত্যতা মিলবে। সুন্দরী নারীদের স্বামীর চেহারা-সুরত কিন্তু সামাজিকভাবে নির্ধারিত সুন্দরের তালিকায় তেমন পড়তে দেখা যায় না। অর্থাৎ নারীরা পছন্দ করেন পুরুষের যোগ্যতা। তদুপরি শেয়ারিং-কেয়ারিং। যে পুরুষ যত স্ত্রীর প্রতি নিবেদিত স্ত্রীও ততটাই নিবেদিত হতে বাধ্য। দু-একজন বাদে অধিকাংশ নারীই এ ধরনের। ফলে সমাজের ভারসাম্য বজায় রাখতে হলে ঘরের কাজেও পুরুষকে হাত লাগাতে হবে। অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে একজন কর্মজীবী নারীকেও কিন্তু রান্নার পাতিল হাতে নিতে হয়। সন্তানকে খাওয়াতে হয়, পড়াতে হয়, ঘুম পাড়াতে হয়। আরও নানাবিধ কাজ তাকে অবশ্যই করতে হয়। নারীরা এটাকে বোঝা ভাবে না। তারা তাদের কর্তব্য অনুযায়ী কাজ করে। কিন্তু কোনো পুরুষ যদি এক গ্লাস পানি ঢেলেও খান সেটাকে তিনি বাড়তি সাহায্য বলে মনে করেন। এমনটা মনে করার কারণ কী?
সংসার স্বামী-স্ত্রীর দুজনের। সেখানে একজন সক্রিয় আর একজন নিষ্ক্রিয় থাকলে সমস্যা হওয়া কি অস্বাভাবিক? বরং সমস্যা বাড়বে। আজকাল বড় বড় রেস্তোরাঁ, হোটেলের শেফ পুরুষ, সার্ভিং বয়ও পুরুষ এছাড়া এখন অনেক পেশায় পুরুষরা কাজ করে যাচ্ছে সম্মানের সঙ্গে। কিন্তু বাড়িতে সেই কাজই কলঙ্কের হয়ে যাচ্ছে। এই মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি।
সংসারের কাজ নারীর একার নয়৷ সংসার বা পরিবার যেহেতু স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা-শ্রদ্ধা-সম্মানে গড়ে ওঠে ঠিক তেমনই ঘরের কাজে পরস্পর সহোযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে দম্ভ বা আত্ম-অহমিকা নিষ্প্রয়োজন। সংসারকে সুখের করতে দুজনের পারস্পরিক সহোযোগিতার বিকল্প নেই। যদি পুরুষতান্ত্রিক ইগোকে পরিহার করে পরিবারকে সংগঠিত করার চেষ্টা থাকে, সংসারের দায়-দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেওয়া যায় তবে সংসার নিঃসন্দেহে সুখের হবে। বিবাহ বিচ্ছেদের মতো বর্তমান সামাজিক অবক্ষয়গুলো কমে আসবে। তাই ঘরের কাজে পরস্পরের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।